শায়েখ হওয়ার গল্প : একদিন তার স্বপ্ন পূরণ হবেই!

মুহাম্মাদ আদম আলী ।।

মানুষের কত স্বপ্ন থাকে—বড় হওয়ার স্বপ্ন, বাড়ি-গাড়ি করার স্বপ্ন। দুনিয়ার শিক্ষা দুনিয়ার দিকেই ধাবিত করে। স্বপ্ন বাড়তে বাড়তে এক সময় সে মরতেও চায় না। আর ভাগ্যক্রমে ‘বড়’ হয়ে গেলে মরার কথাই ভুলে যায়। ক্ষমতা-দাপট আর ভোগ-বিলাসে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। প্রফেসর হামিদুর রহমান চাইলেই সেদিকে যেতে পারতেন।

প্রচণ্ড দারিদ্রের কষাঘাতে বেড়ে উঠেছেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বড় বেতনে ইংলিশ ইলেকিট্রক কোম্পানিতে চাকুরী করতেন। বাড়ি-গাড়ি করা কোনো ব্যাপার ছিল না। কুলি থেকে যারা কোটিপতি হয়, তাদের ভাব দেখে মনে হয়, সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছিল! হযরত সেদিকে পা মাড়াননি। আল্লাহর করুণা, সততা আর মানবিক উৎকর্ষতা তাকে হেদায়েতের পথ দেখিয়েছে। আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে নিয়ে গেছেন। সেখানে জীবনকে নতুন করে উপলব্ধি করেছেন।

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে মক্তব প্রতিষ্ঠাই জীবনের আসল সাফল্য—এ সত্য উপলব্ধি করেছেন। তারপর থেকে এ স্বপ্নই তিনি লালন করেছেন এবং এখনো করছেন। আটষট্টি হাজার গ্রামে আটষট্টি হাজার মক্তব! এখন গ্রামের সংখ্যা বেড়েছে। তবে হাফেজ্জী হুযুর রহ.-এর উক্তিটাই তিনি আওড়ে যাচ্ছেন। আসলে কয়টা মক্তব হয়েছে? হাফেজ্জী হুযুরের এই কথাটা কতজন মনে রেখেছে? মনে রাখলেও কতজন কাজ করছে? সে হিসেব তিনি কখনো করেননি। নিজে একা, সন্তোর্পনে শায়েখের তামান্না পূরণ করে চলছেন। এরকমই একটি স্বপ্ন ছিল তার—চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকায় একটি মক্তব করা।

এ স্বপ্নের কাজ শুরু হয় দুজন যুবককে সামনে রেখে। তারা তখনো বিয়ে করেননি। তারা বিয়ে করবে। সন্তান হবে। সেই সন্তানেরা হবে এই মক্তবের প্রথম ছাত্র। তারা বিয়ের আগেই হযরতের সোহবতে এসেছে। সঙ্গতকারণেই আশা ছিল, তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের কুরআন পড়াবে, হাফেজ-আলেম বানাবে। ১৯৯৬-৯৭ সাল থেকে এই স্বপ্নের শুরু। ঐ দুজন যুবক একটি ছোট বাসা ভাড়া করে থাকত। হযরত তাদের সঙ্গে শেয়ার করে একটি বড় বাসা নিলেন। নিজের জন্য একটি রুম নির্ধারণ করলেন। তিনি সেখানে যেতেন। থাকতেন। কিছু প্রোগ্রাম করে চলে আসতেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। নিয়মিত। প্রতি মাসে একবার।

সময় গড়াল। তারা বিয়ে করলেন। সন্তান হলো। হযরত খুশিতে আলাদা একটি ফ্লাট ভাড়া নিলেন। হযরত চট্টগ্রামে গেলে থাকতেন। একদিন-দুদিন। তারপর পুরো মাস সেটি খালিই পড়ে থাকত। ঐ যুবকদের ছেলেরা যখন একটু বড় হয়েছে, পড়তে শিখেছে, তখন হযরত ওই ভাড়া বাসায় মক্তব চালু করলেন। একজন উস্তাদ রাখলেন। তার জন্য একজন খাদেম নিয়োজিত করলেন। হযরতের স্বপ্নের ফলন দেখার আশায় থাকলাম আমরাও।

কিছুদিন যেতে না যেতেই ওই যুবকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করে দিল। তারা মক্তবে অনিয়মিত হয়ে গেল। তাদের দিয়ে হেফজখানা চালু করার স্বপ্ন ভেঙে গেল। তারপর একসময় তারা আর মক্তবেই পড়তে এলো না। হযরত খুব আক্ষেপ করে বললেন, ‘যাদের জন্য মক্তব বানালাম, তারাই নেই!’

হযরত এখনো সেটি চালু রেখেছেন। নতুন কেউ হয়তো আসবে। আবার কোনো যুবক এসে দাঁড়াবে। তাদের ছেলেদের হাফেজ বানাতে মিনতি করবে। আশা আর প্রতিক্ষায় দিন এখনো পুরোনো ঘড়ির কাটায় ঘুরছে। হযরত দেখে যেতে পারবেন কিনা, জানেন না। দেখে যাওয়া জরুরিও না। চেষ্টা-সংগ্রামই আসল। এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে প্রতি মাসে একবার হলেও সেই মক্তবে শেষরাতে একা একা লাঠি ভর করে হাঁটেন। একদিন তার স্বপ্ন পূরণ হবেই!

এক স্বপ্ন থেকে আরেক স্বপ্ন। স্বপ্ন চলতেই থাকে। কেউ দুনিয়ার, কেউ আখেরাতের। আখেরাতের স্বপ্নের দাম বুঝলে আমরাও একই স্বপ্নে বিভোর থাকতাম; যুবকদের মতো হতাম না।

পূর্ববর্তি সংবাদ‘নির্বাচন পূর্ব হামলায় মানুষের মাঝে উৎসবের পরিবর্তে বিরাজ করছে আতঙ্ক’
পরবর্তি সংবাদচট্টগ্রামে ইভিএম বিতরণ, আগামীকাল মক ভোটিং