মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ ।।
মানুষের সব কাজ গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে :
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
যে যাররাহ পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে। আর যে যাররাহ পরিমাণ মন্দ কাজ করবে সেও তা দেখতে পাবে। -সূরা যিলযাল (৯৯) : ৭-৮
সাহাবী আবু যর গিফারী রা. বলেন-
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, ‘কোনো ভালো কাজকে সামান্য মনে করো না। যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ।’
ইমাম মুসলিম রাহ. “সহীহ মুসলিমে” ‘কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাহ’ শিরোনামের অধীনে এই হাদীসটি এনেছেন । হাদীস ও ফিকহের কিতাবে বিভিন্ন শিরোনামের শুরুতে ‘কিতাব’ শব্দটি আসে। এখানে ‘কিতাব’ মানে অধ্যায়। তাহলে ‘কিতাবুল বিররি ওয়াসসিলাহ’ অর্থ আলবির ওয়াস সিলাহ অধ্যায়। ‘আল বির’ (البر) অর্থ সদাচার। আর ‘আস সিলাহ’ (الصلة) অর্থ, সম্পর্করক্ষা। তো সহীহ মুসলিমের এই অধ্যায়টির শিরোনাম ‘সদাচার ও সম্পর্ক রক্ষা’।
আমরা যদি হাদীসের কিতাবের শুধু শিরোনামগুলো মনোযোগের সাথে পাঠ করি তাহলে ইসলামের শিক্ষার বহু দিগন্ত আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে। ইসলাম সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণাই খণ্ডিত ও সীমাবদ্ধ। কেউ মনে করেন, শুধু ইবাদত-বন্দেগী হচ্ছে ধর্মের ও ইসলামের বিষয়। কেউ আরেকটু অগ্রসর হয়ে আরো কিছু বিষয়, বিবাহ-শাদী ইত্যাদিকেও ইসলামের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। কেউ আরো কিছু বিষয়কে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, ইসলামের শিক্ষা অনেক বিস্তৃত। সহজে বোঝার জন্য বলতে পারি, ব্যাপক অর্থে জীবনের যত অধ্যায়, ইসলামের শিক্ষারও তত অধ্যায়। জীবনের প্রতিটি অনুচ্ছেদ-পরিচ্ছেদ ইসলামের শিক্ষা ও বিধানের শামিল। আর জীবন শুধু ইহজীবন নয়, ইহজীবনের পর আছে পরকালের জীবন। এই উভয় জীবন তার পূর্ণ বিস্তৃতি সহকারে ইসলামী শিক্ষার বিষয়বস্তু। তো ইসলামের বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা অর্জনের এক সহজ উপায় এই যে, বিষয়ভিত্তিক বিন্যাসে সংকলিত হাদীসের কোনো বড় কিতাব হাতে নিন, যেগুলোতে মুহাদ্দিসগণ ইসলামী শিক্ষার অধিকাংশ দিক সম্পর্কে হাদীস ও আছার সংকলন করেছেন। এরপর শুধু তার সূচিপত্রে নজর বুলান। তাহলেও বোঝা যাবে ইসলামী শিক্ষা কত বিস্তৃত।
যাই হোক, সহীহ মুসলিমের একটি অধ্যায়ের নাম, ‘কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাহ’ সদাচার ও সম্পর্ক রক্ষা। এই অধ্যায়ে চল্লিশ-পঞ্চাশটি বা তারও বেশি শিরোনাম রয়েছে। আর প্রতিটি শিরোনামে রয়েছে এক বা একাধিক হাদীস।
এই শিরোনামের কাছাকাছি আরেকটি শিরোনাম, ‘কিতাবুল আদব’ আদব-অধ্যায়। হাদীসের যে কোনো কিতাব হাতে নিন। বিশেষ করে কুতুবে সিত্তা; সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজাহ এই সকল কিতাবের যে কোনোটি হাতে নিন, তাতে একটি অধ্যায় পাবেন কিতাবুল আদব বা আদব অধ্যায়। এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু কী? এই অধ্যায়ে মুহাদ্দিসগণ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসকল হাদীস সংকলন করেছেন তা মৌলিকভাবে দু’টি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। এক. স্বভাব-চরিত্র। দুই. আচার-আচরণ। তাহলে হাদীসের কিতাব থেকে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও সীরাত থেকে জীবনের যেসব অধ্যায়ে আলো গ্রহণের প্রয়োজন তন্মধ্যে সদাচার, সম্পর্ক রক্ষা, আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র ইত্যাদিও শামিল। শুরু থেকেই আমাদের মুহাদ্দিসগণ এ সংক্রান্ত হাদীস ও আছার সংকলন করে এসেছেন।
‘কিতাবুল বিররি ওয়াসসিলাহ’য় (সদাচার ও সম্পর্ক রক্ষা অধ্যায়ে) একটি অনুচ্ছেদ আছে-
অর্থাৎ ‘হাসিমুখে সাক্ষাৎ কাম্য ও পছন্দনীয় হওয়া।’ সহীহ মুসলিমের এই অনুচ্ছেদ-শিরোনামগুলো ইমাম মুসলিম রাহ. দেননি; এসব শিরোনাম দিয়েছেন সহীহ মুসলিমের বিখ্যাত ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ.। এই শিরোনামে হযরত আবু যর গিফারী রা.-এর ঐ হাদীস উল্লিখিত হয়েছে যে, আমাকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
’তুমি কোনো ভালো কাজকে সামান্য মনে করো না, যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ।‘
এই হাদীসে একজন মুসলিমের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎকেও ‘মারূফ’ ও ভালো কাজ বলা হয়েছে এবং এই ভালো কাজের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবীকে এই বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। তাহলে ধর্মীয় দিক থেকে একজন মুসলিমের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ কাম্য।
আমরা বিভিন্ন সময় ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব, মুস্তাহসান এই সকল পরিভাষা শুনে থাকি। শরীয়তের বিভিন্ন বিধানের পর্যায় ও গুরুত্ব বোঝাবার জন্য এই পরিভাষাগুলো ব্যবহৃত হয়। এই কাজটি ফরয, এই কাজটি ওয়াজিব, এই কাজটি সুন্নত, এই কাজটি মুবাহ, ইত্যাদি বিভিন্ন পরিভাষার মাধ্যমে শরীয়তে ঐ বিষয়টির বৈধতা ও কাম্যতার পর্যায় বোঝানো হয়ে থাকে। আমরা এই সকল বিষয়কে ধর্মীয় বিষয় মনে করি। যেমন আমরা বলি, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া ফরয। আমরা মনে করি পাঁচ ওয়াক্ত নামায ধর্মীয় কাজ। আর ধর্মীয় বিধানের দিক থেকে তা অপরিহার্য। এটা আদায় করতেই হবে, ছাড়া যাবে না। এরকম বিভিন্ন কাজকে আমরা ওয়াজিব বলি, সুন্নত বলি, মুস্তাহাব বলি। এগুলোকে আমরা ধর্মীয় কাজ মনে করি। এই যে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব-এগুলোর গণ্ডিও অনেক বিস্তৃত। সচরাচর আমরা যেসকল কাজকে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব মনে করি এর বাইরেও অনেক ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব আছে। আমাদের লেনদেন ও সামাজিক জীবনের অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাবের পর্যায়ভুক্ত। তেমনি স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণগত অনেক বিষয় আছে, যা ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত-মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম মুসলিম রাহ. হযরত আবু যর গিফারী রা.-এর যে হাদীসটি এনেছেন এই হাদীসের উপর সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ. -যিনি অনেক বড় ফকীহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন,শিরোনাম দিয়েছেন-
‘হাসিমুখে সাক্ষাৎ কাম্য ও মুস্তাহাব হওয়া’।
হাসিমুখে সাক্ষাৎ-ও একটি ধর্মীয় কাজ।
দেখুন, এটা ইসলামের এক অনুপম বৈশিষ্ট্য। ইসলামী শরীয়ত মানুষের জীবনের প্রতিটি আচরণের উপর ধর্মীয় বিধান আরোপ করেছে। মানব-জীবনের কোনো আচরণ এমন নেই, যে সম্পর্কে ফরয, ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ, মাকরূহ, হারাম ইত্যাদি বিধান আরোপিত হয় না।
তাহলে এটাও জানা গেল যে, ধর্মীয় কাজ আমরা যতটা সীমাবদ্ধ মনে করি ততটা সীমাবদ্ধ নয়। শুধু নফল নামায পড়াই ধর্মীয় কাজ নয়। নিঃসন্দেহে নফল নামায পড়া অনেক বড় ধর্মীয় কাজ। দান-সদকা করা অনেক বড় ধর্মীয় কাজ। একইভাবে একজন মুসলিমের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও একটি ধর্মীয় কাজ। একটি মুস্তাহাব ও পছন্দনীয় আমল। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি সুন্নাহ। প্রিয় সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী রা.-কে তিনি এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন।
এ হাদীসে মুসলিম ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ হচ্ছে একটি উদাহরণ। আল্লাহর রাসূল একটি মূলনীতি উল্লেখ করে এই বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে এনেছেন। মূলনীতিটি হচ্ছে-
“তুমি কোনো ভালো কাজকেই সামান্য মনে করো না।” এটা করণীয় সম্পর্কে এক বড় মূলনীতি। কোনো ভালো কাজকে সামান্য মনে করে ত্যাগ করো না। এটা যদি আমরা ভালোভাবে বুঝি তাহলে অনেক রকমের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারি।
সামান্য মনে করার বিভিন্ন কারণ হতে পারে-কাজটি ছোট বলে সামান্য মনে করা, নিজের অবস্থার নিরিখে কাজটিকে সামান্য মনে করা ইত্যাদি। অনেক মানুষের এমন ধারণা আছে যে, আমি তো অনেক গুনাহ করেছি, অনেক পাপ করেছি, আমার সামান্য নেক আমলে আর কী হবে? না, ইসলামী শরীয়ত বলে, তুমি সামান্য নেক আমলকেও সামান্য মনে করো না। হতে পারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই ভালো কাজের বিনিময়ে তোমাকে আরো ভালো কাজ করার তাওফীক দান করবেন এবং হতে পারে এই ভালো কাজের কারণে আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দিবেন। সুতরাং কোনো ভালো কাজকে সামান্য মনে করো না।
ভালো কাজ কাকে বলে? ইবাদত-বন্দেগীও ভালো কাজ। এই মূলনীতি ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমি মসজিদে এসেছি। জামাত আরম্ভ হতে এক মিনিট সময় বাকী আছে। এক মিনিটে দুই রাকাত নামায পড়তে পারব না, কিন্তু আধা পৃষ্ঠা কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করতে পারব। দশবার
سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر
বলতে পারব। তো হাদীসের নির্দেশনা হল, এখন যেহেতু দশবার সুবহানাল্লাহ বলার সময় আছে, আধা পৃষ্ঠা কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করার সময় আছে, একে কাজে লাগাই এবং কিছু ভালো কাজ, কিছু ইবাদত করে নিই। যদি এই চেতনা থাকে তাহলে মসজিদে আসার পর অযথা গল্পগুজবে, গীবত-শেকায়েতে সময় নষ্ট হবে না। এই জন্য আমাদের বুযুর্গানে দ্বীন তাদের সংশ্লিষ্টদের এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, মসজিদে এসেছ, এক মিনিট সময় আছে, একটি আয়াত তিলাওয়াত করার সময় আছে, কুরআন মাজীদ খুলে একটি আয়াত তিলাওয়াত কর। আল্লাহ পাক এই এক আয়াতের আজর ও সওয়াব তোমাকে দান করবেন। আর আখেরাতে কিয়ামতের দিনে এই এক আয়াতের আজর ও সওয়াবেরও প্রয়োজন হবে।
এটা তো হল ইবাদত-বন্দেগী। এরকম মুআমালা-লেনদেন। লেনদেনের ক্ষেত্রেও ইচ্ছা করলে ছোট ছোট ভালো কাজ করা যায়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক ঐ ব্যক্তিকে রহম করুন, যিনি নরম ও কোমল,বিক্রি করার সময়, কেনার সময় এবং হক ও প্রাপ্যের তাগাদা করার সময়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৭৬
তো বেচা-কেনার সময় এমন হতে পারে যে, একটি জিনিসের বাজার দর দশ টাকা। বিক্রেতা কিছু বেশি চাচ্ছেন। আমি জানি তিনি বেশি চাচ্ছেন। এখন আমার দিয়ে দিলেও কোনো অসুবিধা হবে না। অন্য কারো হকও নষ্ট হবে না। তাহলে ঠিক আছে তাকে কিছু বেশিই দিলাম। যিনি বিক্রি করছেন, তিনি ক্রেতার অবস্থা দেখে বুঝছেন, বেচারা এক টাকা কম দিতে চাচ্ছে। এক টাকা কম নিলে আমারও কোনো সমস্যা হয় না, আমার পাশের যেসব ব্যবসায়ী তাদেরও সমস্যা হবে না। এটা একটা সামান্য বিষয়। তো ঠিক আছে আমি এক টাকা কমেই তাকে দিয়ে দিলাম।
আচ্ছা, এতে তো কিছু হলেও স্বার্থ-ত্যাগের ব্যাপার রয়েছে। স্বার্থত্যাগ ছাড়াও হাসিমুখে কথা বলে, ক্রেতার উদ্দিষ্ট দোকানটি দেখিয়ে দিয়ে, ভালো মানের জিনিস সম্পর্কে ধারণা দিয়ে বা অন্য দোকান থেকে এনে দিয়ে, ভেজাল সম্পর্কে সতর্ক করে এবং আরো নানাভাবে একজন মানুষের উপকার করতে পারি। আমার প্রাপ্য আমি কারো কাছে পাই। আমি বুঝছি যে, এই মুহূর্তে তার দেওয়ার সামর্থ্য নেই, সে আসলেই অভাবী, তাকে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়েও দিতে পারি। তার সাথে নম্র-কোমল ব্যবহার করতে পারি। এতে আমার ক্ষতি নেই। তার অনেক উপকার। তো লেনদেনের ক্ষেত্রে ইচ্ছা করলেই মানুষের ছোট বড় উপকার করা যেতে পারে।
আমরা রিকশায় চড়ি, বাসে চড়ি, রিকশাওয়ালা পাঁচ টাকা বেশি চাইল। রিকশার আরোহী যিনি তিনি হয়তো একটা হোটেলে বসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতেও কুণ্ঠা বোধ করেন না। আবার পাঁচ হাজারের সাথে পঞ্চাশ টাকা বখশিশও দিয়ে দেন। কিন্তু রিকশাওয়ালা যখন পাঁচ টাকা বেশি চায় তখন তিনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন। রিকশাওয়ালাকে যদি পাঁচ টাকা বেশি দিয়ে দেই তাহলে কী অসুবিধা? ঐ মানুষটার একটু উপকার হল, আমার কোনো ক্ষতি হল না। এ শুধু মানসিকতার ব্যাপার। ইচ্ছা করলেই আমরা তা করতে পারি। মাঝে মাঝে এমনও তো করতে পারি যে, তোমার ভাড়া বিশ টাকা। নাও, তোমাকে আরো বিশ টাকা বখশিশ দিলাম। আপনি ঐ সময় ঐ রিকশাওয়ালা গরীব মানুষটির ঘর্মাক্ত মুখে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার যে অভিব্যক্তি দেখতে পাবেন অন্য অনেক স্থানে বিশ হাজার টাকা খরচ করেও তা পাবেন না। একজন গরীব মানুষের হাসিমুখের অনেক মূল্য।
অনেক সময় দেখা যায়, বাসে হেল্পারের সাথে মারমুখী তর্ক-বিতর্ক। ভালো ভালো শিক্ষিত মানুষের দ্বারাও এটা হয়। এটা এখন এক ধরনের রেওয়াজ হয়ে গেছে। হেল্পারের সাথে, রিকশাওয়ালার সাথে তর্ক-বিতর্ক করা, কষাকষি করাকেই কিছু মানুষ বীরত্ব মনে করেন। আসলে এটা বীরত্ব নয়। বীরত্বের ক্ষেত্রগুলোতে আমরা অনেকেই বীরত্ব প্রদর্শন করতে পারি না। সমাজের দরিদ্র অভাবী অশিক্ষিত মানুষগুলোর সাথেই আমাদের বীরত্ব! এটা ঠিক যে, অশিক্ষিত হওয়ার কারণে ওদের আচরণও সব সময় সভ্য-শালীন হয় না। কিন্তু সে তো অশিক্ষিত। আল্লাহ পাক আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা দিয়েছেন। সভ্যতা ভব্যতা দান করেছেন। আমরা কেন ওদের পর্যায়ে নেমে আসব?
সামাজিকতার ক্ষেত্রেও অনেক ছোট ছোট ভালো কাজের সুযোগ আমাদের সামনে আসে। এক গুরুত্বপূর্ণ ভালো কাজ, যা আমাদের জন্য খুব সহজ, কিন্তু প্রয়োজনগ্রস্তের জন্য অনেক বড়। তা হচ্ছে, আগন্তুককে পথ চেনানো। একজন মানুষ কোনো এলাকায় নতুন। যে বাসায় তিনি যাবেন তা খুঁজে পাচ্ছেন না। তার জন্য এটা অনেক বড় পেরেশানী। তার অনেক সময় ব্যয় হবে। অনেক পেরেশানী হবে। কিন্তু আমি যদি চিনিয়ে দিই, আমার জন্য খুব সহজ। আমি তো এই এলাকায়ই থাকি, এলাকার গলি কয়টা, বাসা কয়টা, কোন বাসা কোথায়, এগুলো সবই আমার জানা। আমি খুব সহজেই শুধু দু’টি বাক্য ব্যবহার করে, দুই মিনিট সময় ব্যয় করে এই ব্যক্তির সহযোগিতা করতে পারি। আমার জন্য খুবই সহজ। তার অনেক উপকার।
এভাবে নিজের কোনো কাজের সাথে অরেকজনের একই ধরনের কাজটি করে দেওয়া সহজ। আমি টিউবওয়েল চেপে পানি নিচ্ছি বা অজু করছি, আরেকজন এল, দুই মিনিট সময় ব্যয় করে তার পাত্রটি ভরে দিলাম। দুটো চাপ দিয়ে তার অজু করা সহজ করে দিলাম। বাজার থেকে নিজের জিনিসের সাথে সঙ্গীর বা প্রতিবেশির টুকটাক জিনিসটি এনে দিলাম। এরকম কত কিছুই তো হতে পারে।
বিখ্যাত মনীষী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে-
‘তোমাদের জুতার ফিতার চেয়েও জান্নাত তোমাদের হাতের নাগালে আর জাহান্নামও তেমনি।’ -সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিকাক, হাদীস ৬১২৩
আল্লামা ইবনুল জাওযী রাহ. বলেন, হাদীসের অর্থ, জান্নাতে যাওয়া খুব সোজা। শুধু নিয়ত শুদ্ধ কর আর আল্লাহর হুকুম মান। তেমনি জাহান্নামের যাওয়াও কঠিন নয়। মনমতো চল আর গুনাহ কর।
ইবনে বাত্তাল রাহ. বলেন, উপরের হাদীসে এই বার্তা আছে যে, আল্লাহর ফরমাবরদারী জান্নাতে পৌঁছায় আর আল্লাহর না-ফরমানী জাহান্নামে নিক্ষেপ করে। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফরমাবরদারী ও নাফরমানী দুটোই হয় খুব সহজ কাজে।
উপসংহারে সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, সুতরাং প্রত্যেকের কর্তব্য, সামান্য ভালো কাজও সামান্য ভেবে ছেড়ে না দেওয়া। আর সামান্য গুনাহতেও সামান্য ভেবে লিপ্ত না হওয়া। কারো তো জানা নেই, কোন ভালো কাজটি তার জন্য আল্লাহর করুণা বয়ে আনবে। তেমনি কোন মন্দ কাজ তাকে আল্লাহর নারাজির শিকার করবে। -ফতহুল বারী ১১/৩২১
দেখুন, এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, মানুষ যখন একটি নেক আমল করে আল্লাহ পাক এর বিনিময় এভাবেও দান করেন যে, তার আরেকটি নেক আমলের তাওফীক হয়। সুতরাং ছোট ছোট ভালো কাজের মাধ্যমে বড় বড় ভালো কাজেরও তাওফীক হয়ে যায়।
আর সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, ইসলামের এই যে এত সব শিক্ষা ও নির্দেশনা এর সারকথা কী? একজন বড় জ্ঞানী ব্যক্তি অনেক কিতাব-পত্রের মাঝে বসে গবেষণা করছেন। এক মাজযুব মানুষ এসে হঠাৎ করে সেই বড় আলিমকে জিজ্ঞাসা করলেন-
আপনি জানেন কি আপনার চারপাশের এই বই-পত্র আপনাকে কী বলছে? আলিম সাহেব বুঝতে পারলেন, এই মানুষটির মনে বিশেষ কোনো ভাবের উদয় ঘটেছে। তিনি বললেন, আপনিই বলে দিন, এই সকল বই-পত্র আমাকে কী বলছে? ঐ মাজযুব বললেন, এই সকল বই-পত্র আপনাকে বলছে-
‘তুমি একজন ভালো মানুষ হয়ে যাও’।
তো আমাদের সকল শিক্ষা-দীক্ষা, সেটা জাগতিক শিক্ষা হোক বা ধর্মীয় শিক্ষা, প্রকৃত অর্থে যা শিক্ষা তার সারকথা হচ্ছে ‘তুমি একজন ভালো মানুষ হও’।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পবিত্র হাদীসে এবং তাঁর মোবারক সীরাত ও জীবনাদর্শে আমাদেরকে ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই দান করে গেছেন। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাঁর সীরাত ও হাদীস থেকে নূর ও আলো গ্রহণের তাওফীক দান করুন। আমীন।
শ্রুতিলিখন : আনাস বিন সাদ
