কওমি মাদরাসা থেকে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হারিয়ে যাচ্ছে : মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া। জামিয়া কাসেমুল উলুমের প্রিন্সিপাল। সিলেট দরগাহ মাদরাসা নামেই বেশি পরিচিত। দেশের খ্যাতিমান এই আলেম লেখাপড়া করেছেন সিলেট দরগাহ মাদরাসাতে। লেখাপড়া শেষে শিক্ষকগণ তাকে স্নেহ করে এ মাদরাসায়ই শিক্ষক হিসেবে রেখে দেন। তার সঙ্গে কথা হয় কওমি মাদরাসায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অতীত ও বর্তমান এবং এর গুরুত্ব, প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। ইসলাম টাইমসের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা বলেন আতাউর রহমান খসরু


 

ইসলাম টাইমস : ইলমে দ্বীন চর্চায় ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সম্পর্ক কতোটা জরুরি?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : আকাবিরদের আলোচনা করার সময় ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ককে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। ছাত্রের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি ধরা হয় শিক্ষকের সঙ্গে তার সম্পর্ককে। বিচার করে দেখা হয়, ছাত্র তার কোন শিক্ষকের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক রেখেছে। মুহাদ্দিসিনের আলোচনা যখন আমরা পড়ি-দেখি, কোন মুহাদ্দিস তার কোন শিক্ষক থেকে কতোটুকু উপকৃত হয়েছেন।

সুতরাং আমি মনে করি, শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক ছাত্রের জীবনে উন্নতির চাবিকাঠি। তবে সম্পর্ক হতে হবে আকিদাত (বিশ্বাস) ও ইহতেরামের (সম্মান)।

ইসলাম টাইমস : ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক কেন জরুরি?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : শিক্ষার সঙ্গে তরবিয়্যাতের (দীক্ষা) একটা সম্পর্ক আছে। আর সেটা শুধু দরসের মাধ্যমে হয় না। সেটা হয় সোহবত-সান্নিধ্যের মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, (অর্থ) ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সাদিকিনদের সাহচার্য গ্রহণ কর।’ এই আয়াত থেকেও বোঝা যায় মানুষের তরবিয়্যাত হবে সাহচর্য থেকে।

শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছাত্রের আখলাক-চরিত্র, মর্যাদা ও সম্মান তথা তার মানবিক গুণাবলী বিকশিত হওয়ার একটি মাধ্যম।

ইসলাম টাইমস : এই ক্ষেত্রে আপনি কাউকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করবেন?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি রহ. তার শিক্ষক শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ.-এর সঙ্গে বিনা কারণে জেলে গিয়েছিলেন। শুধু শিক্ষকের সেবা করা এবং তার ইলম ও সোহবত দ্বারা উপকৃত হওয়ার জন্য। কেমন সম্পর্ক হলে বিনা কারণে জেলখাটা সম্ভব! এই সম্পর্কের বরকতে তিনি আজ শায়খুল আরব ওয়াল আজম হিসেবে স্বীকৃতি ও খ্যাতি লাভ করেছেন।

ইসলাম টাইমস : আপনারা আপনাদের শিক্ষকদের কেমন দেখেছেন?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : আমরা আমাদের শিক্ষকদেরও দেখেছি, তারা তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তখন এমন ফোন ছিলো না। তাই তারা চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। খোঁজ-খবর রাখতেন।

ইসলাম টাইমস : আপনি আপনার কোন শিক্ষকের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখতেন এবং তার দ্বারা আপনি কীভাবে উপকৃত হয়েছেন?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : আমার ছাত্রজীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে সিলেটের কাসেমুল উলুম দরগাহ মাদরাসায়। এখানে আমি শরহে জামি থেকে দাওরা পর্যন্ত পড়েছি। মাদরাসার সব শিক্ষকের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো। ফলে, দাওরার বছর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার সময় শিক্ষকরা আমাকে জানিয়ে দেন আমাকে শিক্ষক হিসেবে রেখে দেয়া হবে। সুতরাং আমি যেন সেভাবেই চলি।

তবে সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক ছিলো আমার শিক্ষক মুফতি রহমতুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে। ইলমি বিষয়ে আমি হুজুরের সঙ্গে পরামর্শ করতাম। বিশেষত ফতোয়ার সম্পর্ক ছিলো তার সঙ্গে। ফতোয়া লেখা আমি হুজুরের কাছ থেকে শিখেছি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আমাকে দিয়ে ফতোয়া লেখাতেন। ফতোয়া বিষয়ে আমরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছি হুজুরের কাছে।

ইসলাম টাইমস : বর্তমানে কওমি মাদরাসায় ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সম্পর্ক কোন পর্যায়ে রয়েছে?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষার উপর পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব পড়েছে। সেটা খুব বেশি প্রভাবিত করেছে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ককে। এখন মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষক ক্লাসরুমের বাইরে পরস্পরের প্রতি কোনো যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন মনে করে না। এই বিষয়ে না ছাত্রের আগ্রহ আছে, না শিক্ষকের।

ইসলাম টাইমস : পারস্পরিক সম্পর্কহীন হওয়ায় কী কোনো ক্ষতি হচ্ছে?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : ক্ষতি অবশ্যই হচ্ছে। একজন ছাত্র তার মেধার জোরে পুঁথিগত বিদ্যা বা যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, যাকে আমরা কাবিলিয়্যাত বলি। কিন্তু উম্মতের খেদমতের সুযোগ তথা আল্লাহর কাছে এবং মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া, যাকে আমরা মাকবুলিয়্যাত বলি, এটা আল্লাহপ্রদত্ত। আমরা আমাদের আকাবিরদের জীবনপাঠ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এটা নির্ভর করে শিক্ষকদের সু-দৃষ্টি ও দোয়ার উপর। আর মাকবুলিয়্যাতই আমাদের কাছে বড়।

ইসলাম টাইমস : এজন্য কার দায় বেশি?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : গাফলতি উভয় দিক থেকে রয়েছে। ছাত্ররা বয়সের কারণে, যুগের প্রভাবে তারবিয়্যাতের গুরুত্ব বোঝে না, বা বুঝেও শিক্ষকদের কাছে ভিড়তে চায় না। অন্যদিকে আমরা শিক্ষকরা মনে করি, পাঠদানই আমাদের দায়িত্ব। ছাত্রদের তরবিয়্যাতের বিষয়টি গুরুত্ব দেয় না। শিক্ষকরা যদি ছাত্রদের তরবিয়্যাতের বিষয়গুলোর দেখভাল নিয়মিত করেন তাহলে ছাত্ররাও আমাদের কাছে ভিড়বে। কিন্তু তাদেরকে কাছে ভেড়ানোর চেষ্টা খুব একটা করি না।

ইসলাম টাইমস : একজন আদর্শ শিক্ষকের সঙ্গে একজন আদর্শ ছাত্রের সম্পর্ক কেমন হবে?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : ওই যে বললাম, আকিদাত (বিশ্বাস) ও ইহতেরামের (সম্মান) সম্পর্ক হবে। ছাত্র তার শিক্ষকের প্রতি আস্থাশীল হবে, তাকে অন্তর থেকে সম্মান করবে এবং তার নির্দেশনা মেনে চলবে। অন্যদিকে শিক্ষক তার ছাত্রকে নিজের সন্তানের মতো দেখবেন। নিজের সন্তানের মতো তার কল্যাণ কামনা করবেন। উভয় উভয়ের কল্যাণ ও উন্নতি কামনা করে দোয়া করবেন। জীবনের প্রয়োজনে দূরে চলে গেলেও পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবেন।

ইসলাম টাইমস : আর কোনো উপকারি বিষয় যা আপনাদের সময় ছিলো কিন্তু এখন আর নেই?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মতো একজন শায়খের সঙ্গে ইসলাহি সম্পর্কও মাদরাসার অঙ্গন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এর দুটো কারণ, এক. শিক্ষকই কারো সঙ্গে ইসলাহি সম্পর্ক রাখেন না। তাই তিনি ছাত্রদেরও এই বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেন না। দুই. ছাত্ররা এখন শিক্ষক থেকে দূরে দূরে থাকে। শিক্ষকের কাছাকাছি থাকলে ছাত্রের অনেক কিছু এমনিই ইসলাহ হয়ে যায়। আমরা নিজের রোগ-ব্যাধি বুঝতে পারি না। কিন্তু শিক্ষকের কাছাকাছি থাকলে তিনি আমাদের রোগ-ব্যাধিগুলো ধরিয়ে দিতে পারেন।

ইসলাম টাইমস : মাদরাসার শিক্ষকদের জন্য ইসলাহি সম্পর্ক কতোটা প্রয়োজন?

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : আমি মনে করি, যারা দ্বীনি ইলম শেখাবেন তাদের শুধু শায়খের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাই যথেষ্ট নয়; বরং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যও চেষ্টা করা জরুরি। কারণ, দ্বীনি শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে ইসলাহের বিষয়টি জড়িত। যেমন, দ্বীনি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য আমল করা। আমার আমলে যদি রুহ আনতে হয় আমার আত্মা পবিত্র হতে হবে। না হলে আমলে রুহ আসবে না। আমলের বরকত লাভ করা যাবে না। আত্মা পরিশুদ্ধির জন্য কোনো শায়খের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যাবশ্যক নয়। কিন্তু সাধারণত শায়খের মাধ্যমেই মানুষ পুতঃপবিত্র হতে পারে। এই হিসেবে ইলম ও আমলের স্বার্থেই একজন শায়খের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা দরকার। আমাদের সময়ে এমন কোনো শিক্ষককে পাইনি যার কারো সঙ্গেই ইসলাহি সম্পর্ক ছিলো না।

ইসলাম টাইমস : ইসলাম টাইমসকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া : আপনাকেও ধন্যবাদ।

পূর্ববর্তি সংবাদঐক্যফ্রন্ট বনাম প্রশাসনের নির্বাচন চলছে : মমিনুল হক
পরবর্তি সংবাদখাওয়ার সময় সালাম দেয়া কি আসলেই জায়েজ নেই?