খসরু খান ।।
প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ। আওয়ামী লীগ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালে ছাত্র রাজনীতিতে তার ভূমিকার কথা গৌরবের সাথে আলোচনা হয়। ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর প্রধান চারজনের একজন। ভোলা থেকে নির্বাচিত বহুবারের সংসদ সদস্য। তার ওজনদার পরিচয়ের কোনোই কমতি নেই।
সেই তিনিই এবার নির্বাচনের আগে আগে অদ্ভূৎ ও রহস্যপূর্ণ সব সংখ্যাতত্ত্বের কথা বলে কৌতূহল সৃষ্টি করছেন। রাজনীতি মনষ্ক মানুষেরা তার মুখে অগ্রিম সংখ্যাতত্ত্বের এসব কথা শুনে রহস্য খুঁজতে শুরু করেছে। তিনি ২২ ডিসেম্বর ভোলায় হঠাৎ বলে বসলেন, ‘আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, আওয়ামী লীগ ২৪০ আসন পেয়ে বিজয়ী হবে।’
সংখ্যা উচ্চারণ করে এভাবে বিজয়ের কথা আওয়ামী লীগের আর কেউ এখন পর্যন্ত বলেননি। ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, মাহবুবুল আলম হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের মতো বড় মাপের নেতারা বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের পরাজয়ের কথা বারবার বলছেন। আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কথাটাও বলছেন প্রায় নিশ্চয়তার সঙ্গে।
কিন্তু ২৪০ আসনের সংখ্যা বরাদ্দ করে বিজয়ের কথা বলার মতো তথ্য বা অনুমান তারা কেউ খুঁজে পাননি। একমাত্র তোফায়েল আহমেদই পেয়েছেন। নির্বাচনের আগেই তিনি এই সংখ্যা কোথায় পেলেন? ভোটাভুটির আগে তো এতো নিশ্চিত হয়ে আসন সংখ্যার ব্যাপারে কথা বলতে পারার যোগ্যতা কারো থাকার কথা নয়। তবে কি তিনি অন্য কোনোভাবে জানেন- কৌতূহলীদের মনের মধ্যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রবীণ এই রাজনীতিকের আরেকটি বক্তব্য নিয়েও চর্চা চলছে খুব। ১২ ডিসেম্বর ভোলার এক সমাবেশে বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতার স্বাদ পেলে ১ লাখ মানুষ হত্যা করবে।’ একই রকম বক্তব্য কয়েক মাস আগেও দিয়েছেন তিনি। ২০ আগস্ট বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রথম দিনই লাখ লাখ মানুষ হত্যা করবে।’ একই কথা অবশ্য ওবায়দুল কাদের দু-একবার বলে থেমে গেছেন। তোফায়েল আহমেদ থামেননি, তিনি বলেই যাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতায় এলে বিএনপির প্রথমদিনই এক লাখ মানুষ হত্যা করার এই ‘গোপন’ প্রস্তুতির কথা এতবড় পোড় খাওয়া একজন রাজনীতিক আগেভাগেই জেনে গেলেন কীভাবে? বিএনপির কেউ কি গোপনে তাকে জানিয়ে দিয়েছে? দেশজুড়ে এক লাখ লোক একদিনে হত্যা করা হলে প্রতি জেলায় গড়ে দেড় হাজারের মতো মানুষকে মারতে হবে! এই কঠিন ও ভয়াবহ কাজটা কে কীভাবে একদিনের মধ্যে আঞ্জাম দেবে- এই তথ্যটাও তো তাহলে তার কাছে থাকার কথা! তবে কি সামনের কোনো বক্তব্যে তিনি এসব সম্ভাব্য হত্যার খুঁটিনাটি পরিকল্পনাটাও তুলে ধরবেন? যেভাবে সংখ্যাতত্ত্ব ও আগাম তথ্য তিনি দিচ্ছেন, হতেও তো পারে একদিন সবিস্তারেই খুলে বলবেন সব।
যদি তার এসব সংখ্যার বক্তব্য নিছক অনুমানের কথাই হয় –তাহলে বড় দুটি প্রশ্ন সেই অনুমানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে যায়। প্রশ্ন দুটি হলো, ২৪০টি আসনের প্রায় নিশ্চিত সংখ্যার কথা যদি আপনি নিশ্চিত অনুমানের ভিত্তিতে বলেই দেন তাহলে আর দলীয় সরকারের অধীনে আটঘাঁট বেঁধে নির্বাচনে নামা কেন? এত মারমুখি নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণাই বা কেন? দরকার কি এত নির্বাচনী কর্মযজ্ঞ ও মারধরের? চুপচাপ থাকলেই তো হয়।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, বিএনপি জোট বিজয়ী হলে ‘প্রথম দিনই একলাখ লোক হত্যার’ মতো তথ্য যদি অনুমান-আন্দাজেই উচ্চারিত হয়ে থাকে –তাহলে লাখো মানুষ হত্যার হুমকি ও আতঙ্ক ছড়ানোর নৈতিক দায়টা কে নেবে? আতঙ্ক, উত্তেজনা ও হত্যাগন্ধী এই নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে কি নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের কিছুই পড়ে না? লাখ লাখ খুন-জখম-হত্যার আগাম অনুমান ভিত্তিক তথ্যের বাজার গরম করার এ জাতীয় অধিকার কি তার মতো অন্যরাও রাখেন? এমন অধিকার কি কারো থাকা উচিত?
প্রশ্ন হচ্ছে, সংখ্যা উল্লেখ করে আতঙ্কের রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়ে প্রবীণ এই রাজনীতিক আসলে কতোটা শোভন রাজনীতির চর্চা বাড়াতে চান? নিছক রাজনৈতিক বিজয়ের জন্যই কি এসব কথা তিনি বলছেন? না কি এসব বিষয়ে তাদেরই কোনো উল্টো চিন্তাভাবনা রয়েছে? কৌতূহলী মানুষ এসব রহস্য ও প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন –যদি তিনি মুখ ও মন খুলে দিয়ে সব কথা বলেন! তিনি কি সেটা বলবেন? সংখ্যাতত্ত্বের রহস্যটা কি কাটবে?
