হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ শামসুল হক রহ. জীবনের এক ঝলক

ইসলাম টাইমস ডেস্ক : গত ২৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিন শেষে রাত ১২টার আগে ৯৫ বছর বয়সে দেশের বর্ষীয়ান আলেমেদীন, দেশবিখ্যাত বহু যোগ্য আলেমেদীনের উস্তায হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ শামসুল হক ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী খেড়িহর মাদরাসার দীর্ঘকালীন মুহতামিম। বর্ষীয়ান এই আলেমেদীন মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়া ঢাকার রঈস মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ও প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ, মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়ার আমীনুততালীম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব-এর পিতা।

মরহুমের নাতি মাওলানা নূরুল্লাহ ও ছোট ছেলে মাওলানা আবদুল আলীমের সংগৃহীত পারিবারিক তথ্য থেকে সহযোগিতা নিয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনচিত্র তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশের বর্ষীয়ান আলেম মাওলানা শামসুল হক রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৩৩০ বঙ্গাব্দে রোজ শুক্রবার কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ (লাকসাম) থানাধীন শরসপুর গ্রামের দক্ষিণবাড়িতে এক দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

জন্ম ও বংশ পরিচয়: মাওলানা শামসুল হক রহ.-এর পিতার নাম আব্দুর রহমান ও দাদার নাম উমিদ আলী। পিতা মরহুম আব্দুর রহমান একজন পরহেজগার ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বর্ষাকালে নৌকাযোগে লাকসাম থেকে ধান এনে এলাকায় বিক্রি করতেন। হালাল ব্যবসার সামান্য এই আয় দিয়েই তিনি সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহ করতেন।

মাওলানা শামসুল হক রহ.-এর মায়ের নাম শামসুন্নাহার। তিনি ছিলেন একজন আবেদাহ নারী। এই নারীর কোল আলোকিত করে ৯ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে।

বাল্য শিক্ষা: ৬ ভাই ও ৩ বোনের মাঝে মাওলানা শামসুল হক রহ. ছিলেন ৪র্থ। ছোট বয়সে বড় দুই ভাই মারা যাওয়ায় পিতার ভালোবাসা যেমন সিক্ত করতো তেমনি মায়ের মমতা তাকে আগলে রাখত সবসময়। বাবা-মায়ের কাছ থেকেই তিনি ‘বিসমিল্লাহ’র সবক গ্রহণ করেন। এরপর শরসপুর দক্ষিণপাড়ার হুজুর হাফেজ সাহেব ও হাসান আহমাদের কাছে এলাকার কাচারীঘরে কায়দা, আমপারা, উর্দু পেহলি ও কারিমা হতে শুরু করে প্রাথমিক পড়াশোনা সমাপ্ত করেন।

পাঠ্ জীবন: মাওলানা শামসুল হক রহ. মাসদার ফুয়ুজ, গুলিস্তাঁ, বোস্তাঁ, মিজান-মুনশাইব, নাহবেমির ও হেদায়াতুন্নাহু কিতাবাদি পাঠ করেন নোয়াখালীর আমানতপুর মাদরাসায়। আমানতপুর মাদরাসায় তিনি মোট ৪ বছর পড়াশোনা করেন। এরপর চলে আসেন কুমিল্লার বরুড়া মাদরাসায়। বরুড়া মাদরাসায় তিনি মাওলানা ইয়াছিন-এর তত্বাবধানে অত্যন্ত সুনামের সাথে আবার হেদায়াতুন্নাহু জামাতে পড়েন।

শৈশব হতেই লেখাপড়ার প্রতি গভীর মনোযোগ এবং আদব আখলাক ও শান্ত স্বভাবের কারণে তিনি আসাতেযায়ে কেরামের নেকদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। অন্য ছাত্রদের থেকে তাঁর মেজাজ ও স্বভাব ছিল কিছুটা ভিন্ন। সারা দিন ক্লাস শেষে যখন অন্য ছাত্ররা খেলাধুলায় ব্যস্ত, তিনি তখনও পড়ালেখা ও তাকরার-মুতাআলায় নিমগ্ন থাকতেন।

বরুরা মাদরাসায় দুই বছর পড়াশোনার পর ট্রেনে চড়ে তৎকালীন মায়মনসিংহর প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান বালিয়া মাদরাসায় চলে আসেন। এখানে তিনি মাওলানা দৌলত আলী ও টাঙ্গাইলের হুজুর-এর তত্ত্বাবধানে জামাতে কাফিয়া শেষ করেন। এখানে বছরের মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন। কাফিয়া জামাত শেষ করে আবার পুনরায় কুমিল্লার বরুড়া মাদরাসায় শরহে জামি জামাতে ভর্তি হন।

আরও পড়ুন : বর্ষীয়ান আলেমেদ্বীন মাওলানা শামসুল হকের জানাযা ও দাফন সম্পন্ন

আরও পড়ুন : চাঁদপুর খেড়িহর মাদরাসার মুহতামিম বর্ষীয়ান আলেমেদ্বীন মাওলানা শামসুল হকের ইন্তেকাল

এখানে শরহে জামি ও শরহে বেকায়া জামাত শেষ করে চলে আসেন দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায়। এখানে তিনি হেদায়া জামাতে ভর্তি হন। হেদায়া আউয়ালাইন, হেদায়া আখেরাইন, জালালাইন, মেশকাত ও দাওরায়ে হাদীস হাটহাজারীতেই শেষ করেন।

মাওলানা শামসুল হক রহ. এখানে মোট পাঁচ বছর পড়াশোনা করেন। হাটহাজারী ছিল তাঁর জন্য একেবারেই নতুন। সবকিছু অচেনা, অজানা, নতুন পরিবেশ। এই নতুন পরিবেশেই নতুন করে শুরু হয় তাঁর পাঠ্জীবন। হাটহাজারীতে তিনি মাওলানা নাদেরুজ্জামানের কাছে হেদায়া আওয়ালাইন ও মাওলানা আবুল হোসাইনের কাছে হেদায়া আখেরাইন, সুল্লামুল উলুম কিতাব পড়েন। এছাড়া তৎকালীন হাটহাজারীর নাজেমে তালিমাত মাওলানা আবদুল আযীয রহ. ছিলেন তাঁর তালিমি মুরব্বি।

হাটহাজারী মাদরাসায় তাঁর দরসের সাথী ছিলেন মাওলানা শামসুল আলম , মাওলানা নুর আহমদ, মাওলানা হাবীবুর রহমান, কচুয়া।

কর্মজীবন: হাটহাজারী মাদরাসা থেকে পড়ালেখা শেষ করে মাওলানা শামসুল হক রহ. ১৩৮০ হিজরিতে লাকসামের তৎকালীন কাশিপুর মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্যদিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। মাদরাসা থেকে তাঁর জন্য হাদিয়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৫ টাকা। এখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে লাগাতার ১৪ বছর খেদমত করেন। ১৪ বছর পর তার বেতন ছিল ২০০ টাকা।

এ সময়ে তিনি যে সকল কিতাবের দরসদান করেন তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হল মিজান, ইলমুস সিগাহ, হেদায়াতুন্নাহু, কাফিয়া, শরহে জামি, মুখতাসারুল মাআনি ও কুতবি। বর্তমান ঢাকার জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদরাসার মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমী এবং নারায়ণগঞ্জের জামিয়া হোসাইনিয়া হাজীগঞ্জ মাদরাসার সাবেক শাইখুল হাদিস মরহুম মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ রহ. ও কাশিপুর মাদরাসার বর্তমান মুহতামিম মাওলানা উবায়দুল্লাহসহ বর্তমান সময়ের অনেক সুযোগ্য আলেম তাঁর থেকে নাহব ও সরফের ইলম অর্জন করেন।

মাওলানা শামসুল হক রহ.-এর দরদমাখা দরসের সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন জায়গা থেকে তালেবে ইলম আসতে শুরু করে কাশিপুর মাদরাসায়। এদিকে চাঁদপুর জেলার প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান খেড়িহর মাদরাসার মুতাওয়াল্লি জনাব আব্দুল ওয়াদুদ খান আত্মীয়তার সূত্রে কাশিপুর মাদরাসার পাশে লৎসর বেপারি বাড়িতে যাতায়াত করতেন। এই যাতায়াতের সুবাদে তিনি মাওলানা শামসুল হক রহ.-এর দরসের সুনাম ও সুখ্যতি শুনে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তার ইচ্ছা ছিল কীভাবে তাঁকে তার প্রতিষ্ঠিত খেড়িহর মাদরাসায় উস্তাদ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায়।

একপর্যায় আবদুল ওয়াদুদ খান খেড়িহর মাদরাসার প্রবীণ উস্তাদ ও মাওলানা শামসুল হক রহ.-এর শাগরিদ মাওলানা সাইফুল্লাহর (লৎসরের হুজুর) মাধ্যমে তাঁর কাছে এই মর্মে খবর পাঠান যে, তিনি যদি কাশিপুর থেকে খেড়িহর মাদরাসায় চলে আসেন তাহলে এ এলাকার অনেক ছাত্র তাঁর দ্বারা উপকৃত হবে। পরবর্তীতে মাওলানা শামসুল হক রহ. কাশিপুর থেকে ১৩৯৫ হিজরিতে খেড়িহর মাদরাসায় চলে আসেন।

সে সময় কারী ইবরাহীম রহ.-এর খলিফা আল্লামা নুরুজ্জামান রহ. ছিলেন এই মাদরাসার জিম্মাদার এবং খতিবে আজ ম আল্লামা সিদ্দীক আহমদ রহ. ছিলেন মাদরাসার মুরব্বি। খেড়িহর মাদরাসায় যোগদানের ২/৩ মাসের মধ্যে মাওলানা শামসুল হক রহ.-কে মুহতামিমের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৩৯৫ হিজরি থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর তিনি খেড়িহর মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন।

পরিবার ও সন্তান: পারিবারিক জীবনে মাওলানা শামসুল হক রহ.-এর জীবন ছিল দীনদারি ও সৌভাগ্যের এক অপূর্ব সমাহার। আবেদা, যাহেদা ও হাফেজা এক সহধর্মিনীর সঙ্গে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়। তাঁর ঘর প্রায় সময়ই থাকতো আশপাশের বালিকা ও নারীদের দীন শিক্ষার ঘরোয়া কেন্দ্র।এ ধারাটি এখনো বিদ্যমান। তাঁর ৫ ছেলের সবাই যোগ্য আলেমেদীন।তাঁর একমাত্র কন্যাও দীনী শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিতা।

তাঁর বড় ও মেঝো ছেলে মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ও মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব –এর যোগ্যতা,গ্রহণযোগ্যতা ও খ্যাতির কথা দীন ও দীনী ইলমের অঙ্গনের সবাই জানেন । ঢাকা সাহবানিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদীস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মরহুমের তৃতীয় ছেলে হাফেজ মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মজীদ। চতুর্থ ছেলে হাফেজ মাওলানা আবদুল হামীদ উচ্চতর পড়াশোনা করছেন মিসরের আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেরানিগঞ্জের বৌনাকান্দিতে পঞ্চম ছেলে হাফেজ মাওলানা আবদুল আলীম পরিচালনা করছেন শিশু-কিশোরদের একটি মাদরাসা।

আল্লাহ তাআলা দীনী ইলমের এই মহান খাদেম মাওলানা শামসুল হক রহ.- কে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন।

পূর্ববর্তি সংবাদসিরিয়ার রাজধানীতে ইসরায়েলের হামলা
পরবর্তি সংবাদভোট পাবে না জেনে বিএনপি সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে : প্রধানমন্ত্রী