আবরার আবদুল্লাহ ।।
১৫ ডিসেম্বর ২০১৬। ৪৯ বছর বয়সী তিউনিসিয়ান ড্রোন ইন্জিনিয়ার মুহাম্মদ আল জাওয়ারি নিজ বাড়ির কাছেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
স্থানীয়দের কাছে তিনি একজন বিমান প্রকৌশলী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তবে তারা জানতো তিনি ড্রোন প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী। তার ভিন্ন একটি পরিচয়ও ছিলো লোকচক্ষুর আড়ালে। তা হলো, তিনি হামাসের সামরিক শাখা কাসসাম ব্রিগেডের ড্রোন ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের প্রধান।
গত ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ আল জাওয়ারি হত্যার ২ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত আলজাজিরার আরবি বিভাগের প্রতিবেদক তামির আল-মিসালের অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আল জাওয়ারি হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে বিভিন্ন পক্ষ নানাভাবে জড়িত ছিল। তার স্ত্রীসহ পরিচিতদের দাবি- তার হত্যাকাণ্ড ছিল দীর্ঘপরিকল্পিত।
প্রতিবেদক আল-মিসাল বিশ্বাস করেন, এটা ছিল ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি দুর্ধর্ষ হত্যা মিশন। তাদের অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের মতো এই হত্যাকাণ্ডের সকল নিদর্শন ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ফলে এই হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ হাজির করা অসম্ভবপ্রায়।
আল-জাওয়ারি তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক জয়নুল আবিদিন বিন আলির শাসন আমলে একজন ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে ১৯৯১ সালে দেশের বাইরে চলে যান। এ সময় তিনি জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। দেশ ছেড়ে তিনি সুদান যান এবং সুদানের একটি সমরাস্ত্র কারাখানায় কাজ করেন। ২০১১ সালে আরব বসন্ত আন্দোলনে বিন আলি সরকারের পতন হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
২০১৬ সালে তার মৃত্যুর কয়েকদিন পর হামাস ঘোষণা দেয়, ড্রোন বিশেষজ্ঞ আল জাওয়ারি এক দশক যাবত তাদের সামরিক শাখা কাসসাম ব্রিগেডের জন্য কাজ করছিলেন। ২০১৪ সালে গাজায় হামাস ব্যবহৃত ‘আবাবিল’ ড্রোন উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।
২০০৮ সালে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের সময় হামাস ড্রোন উৎপাদন শুরু করে। প্রথম ৩০টি ড্রোন তৈরি হয় ইরানের একটি সামরিক কারখানায়। কাসসাম ব্রিগেডের সদস্য আবু মুজাহিদ বলেন, ড্রোন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, এর মাধ্যমে সামরিক লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা লাভ এবং সাধারণ মানুষ এড়িয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা সম্ভব।
আল-জাওয়ারি ড্রোনের আদলে রিমোট কন্ট্রোলড সাবমেরিন তৈরি করছিলেন কাসসাম ব্রিগেডের জন্য। যেন তারা তা যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
ইসরাইলি সাংবাদিক মোয়াব ওয়ারদি আল-জাওয়ারির হত্যাকাণ্ড বিষয়ে অনুসন্ধান করতে তিউনিসিয়া আসেন। তার অভিমত, এটা স্থানীয় কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের হত্যাকাণ্ড নয়। এই হত্যাকাণ্ডের লক্ষণ দেখে বলা যায়, ইসরাইল তার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল এবং এমন হত্যা মিশন পরিচালনার ক্ষমতা তাদেরই আছে।
নিজ ভূ-খণ্ডের বাইরে একাধিক হত্যা মিশনের পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বিরুদ্ধে। যেমন, ১৯৮৮ সালে সিনিয়র ফিলিস্তিনি কমান্ডার আবু জিহাদ –যার প্রকৃত নাম ছিলো খলিল আল ওয়াজির– তাকে তিউনিসিয়ার তিউনিসে হত্যা করা হয়। ইসরাইল এই হত্যাকাণ্ডের দায়ও স্বীকার করে। ওয়াজির ছিলেন পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাতের বন্ধু ও সহযোগী।
২০১০ সালে দুবাইয়ের একটি হোটেলে হামাসের লজিস্টিক কমান্ডার মুহাম্মদ আল মাবহুহকে হত্যার পেছনেও মোসাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করা হয়।
চলতি বছরের মার্চে আল-জাওয়ারি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন, ক্রোয়েশীয় অ্যালেন ক্যামডজিক এবং বসনিয়ান এলভির সারাক। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার সর্বোচ্চ আদালত ক্যামডজিককে তিউনিসিয়ার হাতে তুলে দেয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায়। একইভাবে বসনিয়ার আদালত সারাককে মুক্তি দেন। কারণ, উভয় দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই।
দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত মুহাম্মদ আল-জাওয়ারির হত্যা মামলাটি নিষ্পত্তিহীন অবস্থায় পড়ে থাকবে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
তবে তিউনিসিয়ার সরকার দাবি করছে, তারা নিশ্চিত অ্যালেন ক্যামডজিক ও এলভির সারাক আল জাওয়ারির হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। তারপরও দেশটির জুডিসিয়াল কাউন্টার টেররিজম বিভাগের মুখপাত্র সোফিয়েন সেলিটি ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮ জানান, সন্দেহভাজন যে দুই অপরাধীর বিরুদ্ধে তারা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল বসনিয়া কর্তৃপক্ষ তাদেরকে তিউনিসিয়ার কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছে।
আলজাজিরা অবলম্বনে
