বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’-এর প্রতিবেদন

এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ ও এ্যান্টোনিও সাভোয়া ।।

২০১৮ সালে এশিয়ায় কিছু নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত ফলাফল দেখা গেছে। মালদ্বীপে গণতন্ত্র বিপন্ন করে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে উচ্ছেদ এবং মালয়েশিয়ায় ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের ৬১ বছরের শাসনকালের অবসান তার অন্যতম। মালয়েশিয়ার মতো বহুদলীয় গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশের প্রতি এখন মানুষের দৃষ্টি আবদ্ধ।

আগামী ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ৩০০ সংসদীয় আসনে ১০ কোটিরও বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। যদিও গত দশকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ধারা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।

বিভিন্ন বিবেচনায় বাংলাদেশের এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। এই মাসে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৪৮ বছর পূর্ণ করছে। এর আগের সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল উল্লেখযোগ্য বিরোধী দল এবং নির্বাচনী প্রতিক্রিয়া শেষ হয়েছিল রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে। এই বছর বিরোধী দলগুলো যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে টিকে থাকতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহম্মদের মতো বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের সাবেক সদস্য ড. কামাল হোসেন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছেন। ড. কামাল বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানে ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং দেশের সংবিধান রচয়িতাদের একজন। তিনি শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে একটি অর্থবহ বিরোধী জোট গঠনে সক্ষম হয়েছেন।

বলা যায়, ক্ষমতাসীন সরকার এখন একটি কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। যদি তারা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান দিতে ব্যর্থ হয়, তবে আইনের শাসন ব্যর্থ হবে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হবে এবং দেশের উন্নয়ন আবারও হুমকির মুখে পড়বে।

অন্যদিকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতি টানবে। পরিস্থিতি বলছে, বাংলাদেশ অতীতের পথেই হাঁটছে। এখন দেখার বিষয় হলো, ৮১ বছর বয়সী বাংলাদেশি আইনজীবী কি ৯৩ বছর বয়সী মাহাথিরের ম্যাজিক দেখাতে পারবেন?

১০ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, নির্বাচনী প্রচারণার সময় একাধিক বিরোধী দলীয় নেতা ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হাতে প্রকাশ্যে মার খেয়েছেন অথবা তাদের জেলে পাঠানো হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কমপক্ষে ২১ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এছাড়াও বিরোধী দলীয়দের প্রচার অফিস ভাংচুর করা হয়েছে। লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন নারী প্রার্থীরা। স্বয়ং ড. কামাল হোসাইনের উপরও হামলার ঘটনা ঘটেছে। যা সু-স্পষ্ট নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নির্বাচন কমিশনের অনেক কর্মকাণ্ড সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায়। যেমন, নির্বাচনের দিন সংবাদ সংগ্রহের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ, ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা বা কোনো অনিয়ম মোবাইল ফোনে ধারণ নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি। সমালোচকদের দাবি, এসব কর্মকাণ্ড অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে কর্তৃত্ববাদী সরকারের অনাগ্রহের কথাই প্রকাশ করে।

তবে নির্বাচনী সহিংসতা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অবরোধে একাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে এবং সাধারণ মানুষের সহায়-সম্পত্তির বিপুল ক্ষতিসাধন হয়।

নির্বাচন পূর্ব ভয়-ভীতি ক্ষমতাসীনদের অনেক অন্যায় সুযোগ-সুবিধা এনে দেয়। বিরোধীদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা প্রদান প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা কমায়। নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলকে প্রভাবিত করে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিলো ২২ ভাগেরও কম। শতাধিক ভোটকেন্দ্র দ্রুততম সময়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ক্রসফায়ার করা হয়।

এখন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের আচরণে ৩০ ডিসেম্বর ভোটাররা ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকবে না তো? যে কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার নির্বাচন পূর্ব সহিংসতায় আগ্রহী। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও একই চিত্র দেখা যায়। যেমন, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গো এবং বুরুন্ডি।

তবে এটি বিরোধীদের প্রতি আশীর্বাদও হতে পারে। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার ভোটারদের মধ্যে বিরোধীপ্রবণ মানসিকতা প্রবল। বিরোধীদের উপর প্রকাশ্য হামলা এবং বিভিন্ন বাহিনীর অন্যায় ব্যবহার আওয়ামী লীগের সম্ভাবনাকে কমিয়েও আনতে পারে।

‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ ক্ষমতাসীন দলের একটি জনপ্রিয় স্লোগান। তাদের আচরণে প্রকাশ পায়, তারা উন্নয়ন ব্যাহত করে এমন গণতন্ত্রে আগ্রহী নয়। কিন্তু গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন কতোটা সম্ভব? এটা সত্য যে, বাংলাদেশ একাধিক উন্নয়ন সূচকে পুরস্কৃত হয়েছে এবং প্রসংশা কুড়িয়েছে। বিশেষত জাতিসংঘ নির্ধারিত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) লক্ষ্যপূরণ বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। প্রতিকূল ভৌগলিক অবস্থান ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা অনিয়মের পরও স্বাধীনতার পর থেকে ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবুও বলতে হবে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ক্ষীণ। আশাব্যঞ্জক উন্নয়নের বিপরীতে এমডিজি চ্যাম্পিয়ন দেশ কর্তৃত্ববাদের দিকে ফিরে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে। যা গণতন্ত্রের চর্চা ও আচরণকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সামর্থ্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকর বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা বাতিল করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে প্রধান বিরোধী দল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে এবং শাসক দল অর্ধেকের চেয়েও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করে। কার্যত জাতীয় সংসদ বিরোধী দলহীন হয়ে পড়ে এবং কোনো প্রকার চ্যালেঞ্জ ছাড়াই সরকার তার শাসনকাল পূর্ণ করে।

প্রতিবাদের স্বাধীনতা না থাকলে অর্থনৈতিক সাম্য ও সুবিচার ব্যহত হয়। একটি কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি, গণমাধ্যমের পরাধীনতা, রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং আর্থিক অনিয়ম দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘নব্য ধনী’দের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বিশ্বমিডিয়ার আলোচনায় এসেছে।

বিশ্লেষকগণ মনে করেন, সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও দীর্ঘ মেয়াদি কর্তৃত্ববাদী পরিকল্পনার অংশ। এর মাধ্যমে মূলত কর্তৃত্ববাদী সরকার জনগণের মনে ভবিষ্যতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। উদ্দেশ্য, বিরোধীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিনিময়ে একটি অর্থহীন নির্বাচন করা। কর্তৃত্বাবাদী সরকারের উন্নয়নের ব্যাখ্যা নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেন, উন্নয়ন ও জীবন যাত্রার মানকে সবকিছুর উপর কেন্দ্রিভূত করা হয়।

অগ্রহণযোগ্যভাবে ক্ষমতা গ্রহণ ক্ষমতাসীনদের ভুল পথে পরিচালিত করবে। মানুষ রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারালে ১৯৯১ সালের পর শুরু বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অর্জনগুলো হুমকির মুখে পড়বে। কেননা বৈশ্বিক উন্নয়নের নতুন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজিএস-এর ১৬টি ধারার অন্যতম মৌলিক স্বাধীনতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।

দুই বছর পর বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করবে। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার মাসে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে যদি মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয় এবং দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে তা স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মত্যাগীদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন হবে। অন্যদিকে মানুষ যদি তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পায় তবে তা হবে জাতি হিসেবে গৌরবের বিষয়।

(ঈষৎ সংক্ষেপিত)

এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ, প্রফেসর, ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিকস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব মালায়া

এ্যান্টোনিও সাভোয়া, সিনিয়র লেকচারার, ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিকস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার্স

পূর্ববর্তি সংবাদপ্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারতের লোকসভায় বিতর্কিত ‘তিন তালাক’ আইন পাশ
পরবর্তি সংবাদতুরস্কে দুই ঘণ্টায় রোবটের মাধ্যমে স্থানান্তর করা হলো ৬ শ বছরের পুরোনো মসজিদ (ভিডিও)