নাটক-ফিল্মের খলচরিত্রে ইসলামি ব্যক্তিত্বের লেবাস ব্যবহার : কী বলছেন আলেমরা?

আতাউর রহমান খসরু ।।

নাটক-চলচ্চিত্রে মাঝে মাঝেই দেখা যায়, সবচেয়ে বিতর্কিত ও মন্দ চরিত্রের উপর একটি ধর্মীয় প্রলেপ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামের দুশ্চরিত্র মাতব্বর, হাসপাতালের দালাল, ভূমিদস্যু চেয়ারম্যান বা ডাকাত দলের সর্দারের মুখে এক মুঠ দাড়ি ও গায়ে পাঞ্জাবি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের মুখেও উঠিয়ে দেওয়া হয় অল্প-বিস্তর ধর্ম বাণী ও নীতিকথা। কিন্তু তাদের চরিত্রে থাকে চরম পর্যায়ের গলদ।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নাটক-ফিল্মের খলচরিত্রে ধর্মীয় পোশাক ও বেশভুষার ব্যবহারে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা ও জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতার মতো কিছু ব্যাপার। গত দেড় দশকের টিভি নাটক ও ফিল্মে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ইসলাম ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের সাজানো চরিত্রের সঙ্গে যুক্ত করে যুদ্ধাপরাধ ও উগ্র সশস্ত্র তৎপরতার নানারকম ঘটনা ও আচরণ উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে এমন একটি চিত্র ও আবহ নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে যেন ইসলামি ব্যক্তিত্ব মানেই যুদ্ধাপরাধী কিংবা উগ্রবাদী।

খল চরিত্রের অবয়বে ধর্মের এই আবরণ দেওয়ার বিষয়টি যে ঐচ্ছিক তাতে কোনো সন্দেহ নেই বলে মনে করেন লেখক-সাংবাদিক ও মাদরাসা দারুর রাশাদের শিক্ষা সচিব মাওলানা লিয়াকত আলী। তিনি মনে করেন, সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ, ইসলামি সংস্কৃতিকে খাটো করার জন্যই খল চরিত্রের গায়ে ইসলামি পোশাক চড়ানো হয়। বামধারার প্রগতিশীলরাই এই কাজ করেন এবং জেনে-বুঝেই করেন। কেননা একজন সাহিত্যিক, স্ক্রীপ্ট রাইটার ও চলচ্চিত্রকারকে আর যাই বলা যাক অসচেতন বলার সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, নাকট-সিনেমা এমনিতেই একটি নেতিবাচক বিষয়। তার সঙ্গে যখন ইসলাম, মুসলমান ও ইসলামি মূল্যবোধকে খাঁটো করার মতো বিষয় থাকে তখন আরও বেশি নিন্দনীয় বিষয়ে পরিণত হয়।

মাওলানা লিয়াকত আলী এই প্রবণতার একটি প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এই প্রবণতা তৈরির পেছনে একটি প্রেক্ষাপট আছে। ইসলামের নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং সমাজে ইসলাম ও ইসলামি রাজনীতি চর্চা শুরু হলে এই দেশের একদল মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। বিশেষত বামধারার রাজনীতিক, কবি ও সাহিত্যিকরা আশাহত হন। তাই সেই ষাটের দশক বা তার একটু আগ থেকে আমরা বাংলা সাহিত্যে ইসলাম, ইসলামি জীবন ও মূল্যবোধকে খাটো করার প্রবণতা শুরু হতে দেখি। যেমন, আয়না, লালসালু ও আব্দুল্লাহ ইত্যাদি উপন্যাসে এই প্রবণতা দেখা যায়।’

অবশ্য সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নজরুল ইসলাম মনে করেন এই ধারাটি আরও পেছনের। তার দাবি, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিকৃতির এবং ইসলামি মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি বিরোধী প্রচারণার যে ধারা তৈরি হয়েছিলো তারই ধারাবাহিকতায় আজও সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতিকে নানাভাবে খাটো করার চেষ্টা চলছে।

উভয় আলেমই মনে করেন, যারা সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে খল চরিত্রের সঙ্গে ইসলামি পোশাক ও সংস্কৃতিকে মিশিয়ে উপস্থাপন করছে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য সমাজে ইসলামি মূল্যবোধকে অপছন্দনীয় বানানো বা বিতাড়িত করা। ইসলামি জীবনব্যবস্থা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। ইসলামের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি করা।

আরও পড়ুন : আমি ইসলামবিরোধী নই : তীব্র সমালোচনার মুখে ফারুকী

কিন্তু তারা কতোটা সফল হচ্ছে? মাওলানা লিয়াকত আলীর ভাষায় ‘সামাজিক জীবনে এর প্রভাব অনেকভাবেই পড়ছে। মানুষ ইসলাম ও ইসলামি জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল বার্তা পাচ্ছে। তাদের মনের ভেতর ইসলাম ও ধার্মিক মানুষের যে চিত্রটা বসে যাচ্ছে তা ভয়ঙ্কর ও অগ্রহণযোগ্য। এসব সাহিত্য ও চলচ্চিত্র দেখে মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে যে, ইসলাম প্রচারকরা যে পবিত্র জীবনের কথা বলেন তা একটা খোলস মাত্র।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে যুবক ও উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরাই। কারণ, তাদের ভেতর অনুকরণের প্রবণতা কাজ করে। তারা অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসপ্রবণও হয়। তাই যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। আর যা বিশ্বাস করে তাই অনুসরণ করার চেষ্টা করে।’

মাওলানা নজরুল ইসলামও মনে করেন নতুন প্রজন্ম -যারা ইসলামি কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে জানে না, তাদের ইসলাম সম্পর্কিত জ্ঞানের পরিধি কম এবং মিডিয়া ও বিনোদনের উপকরণাদির উপর অনেক বেশি আস্থাশীল- তাদের জীবনের গতিপথই পাল্টে দিচ্ছে। এসব নাটক- চলচ্চিত্র তাদের সামনে ইসলামি জীবনব্যবস্থাকে ভীতিকর রূপে উপস্থাপন করছে।

তিনি মুসলিম সমাজকে মন্দ সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের হাত থেকে রক্ষা করতে আলেমদেরকে আরও বেশি সমাজঘনিষ্ঠ হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘মসজিদ, মাদরাসা, ওয়াজ-মাহফিলের পাশাপাশি আলেমদের অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও সক্রিয় হতে হবে। সেখানে সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকারদের অপপ্রচারের বিপরীতে ইসলামি জীবনের সৌন্দর্য্য তুলে ধরা যাবে।’

আর মাওলানা লিয়াকত আলী পরামর্শ দেন তাদের সাংস্কৃতিক আক্রমণের বিপরীতে ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা বৃদ্ধি ও তার প্রচার-প্রসারে মনোযোগী হওয়ার। তিনি বলেন, তারা যেহেতু শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক মাধ্যমে ইসলামের উপর আক্রমণ করছে তাই তাদের মোকাবেলাও করতে হবে এই পথে।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালিত একটি ফিল্ম নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। গুলশানের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা উপজীব্য করে তৈরি  ছবিটির অভিনেতা জাহিদ হাসানের মুখে দাঁড়ি ও অভিনেত্রী তিশার মাথায় হিজাব থাকায় এই সমালোচনা শুরু হয়। যদিও ফারুকী আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন এবং এটাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি এই ফিল্মে জাহিদ হাসান ও তিশার চরিত্রটি ইতিবাচক না নেতিবাচক, তবে ফারুকীর পরিচালিত অন্য ফিল্মে এবং সাম্প্রতিককালের আরও কিছু নাটক- চলচ্চিত্রে ইসলামি শিক্ষা ও মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা বারবার দেখা গেছে।

এজন্য নাটক-মুভিতে ধর্মীয় বেশভুষার কোনো চরিত্রের আলামত দেখা গেলেই আঁতকে উঠেন ধর্মপ্রাণ মানুষেরা। নাটক-মুভিতে ইসলামি ব্যক্তির অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক উপস্থাপনার ধারা বন্ধ না হলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মনোভাব বদলাবে কি না বলা মুশকিল।

পূর্ববর্তি সংবাদনাস্তিক মুরতাদের বিরুদ্ধে আলেমদের আন্দোলন চলবে : আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী
পরবর্তি সংবাদচাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুকুর থেকে নারীর লাশ উদ্ধার