পূর্ব তুর্কিস্তান : উইঘুর মুসলমানের হারানো মানচিত্র

আবরার আবদুল্লাহ ।।

এক সময়ের স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানই আজ চীনের জিংজিয়াং উইঘুর স্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত এই অঞ্চলের বর্তমান আয়তন ১৬ লাখ ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার (৬ লাখ ৩৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার)।তবে স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের আয়তন ছিলো ১৮ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। চীনের বর্তমান কিংঘাই ও গাংসু অঞ্চল দুটিও পূর্ব তুর্কিস্তানের অংশ ছিলো। ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর অঞ্চল দুটো পৃথক করা হয়।

পূর্ব তুর্কিস্তানের বৃহৎ অংশজুড়ে আছে মরুভূমি, আকাশছোঁয়া পাহাড়, সুন্দর নদী-নালা, বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ও বাগান।

http://www.iuhrdf.org/sites/default/files/Map-of-East-Turkestan.gif
স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের সর্বশেষ মানচিত্র

চীন সরকারের তথ্যমতে পূর্ব তুর্কিস্তানে বর্তমান ১১ মিলিয়ন মুসলিম বসবাস করে। যার মধ্যে ৮.৬৮ মিলিয়ন উইঘুর মুসলিম। উইঘুর ছাড়াও এখানে কাজাক, কিরঘিজ, তাতার, উজবেক ও তাজিক বংশোদ্ভূত মুসলিমরা বসবাস করে। মুসলিমরা প্রধানত তার্কিক ভাষায় কথা বলে। তবে উইঘুরদের দাবি পূর্ব তুর্কিস্তানে কমপক্ষে ১৫ মিলিয়ন উইঘুর বসবাস করে।

ভৌগলিকভাবে পূর্ব তুর্কিস্তানের অবস্থান চীন সীমান্তে। ঐতিহাসিকভাবে তা কখনও চীনের অংশও ছিলো না। পূর্ব তুর্কিস্তান মধ্য এশিয়ার অংশ। এখনকার অধিবাসীরা যেমন চীনা নয়, তেমন চীনা সংস্কৃতির থেকে ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী তারা। জাতিগতভাবে তারা ‘মধ্য এশিয়ান তুর্কি’।

৪ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে উইঘুররা পূর্ব তুর্কিস্তানে বসবাস করছে। উইঘুররা মনে করে চীনের এক ষষ্ঠাংশ ভূমির মালিক তারা। যা অন্যায়ভাবে দখল করে রাখা হয়েছে। ইতিহাস বিখ্যাত সিল্ক রোড এই অঞ্চলের উপর দিয়ে অতিক্রম করেছে। মনে করা হয়, সিল্ক রোড পূর্ব ও পশ্চিম তুর্কিস্তানকে বিভক্ত করেছিলো। সিল্ক রোডের কারণে, ঐতিহাসিক কাল থেকে পূর্ব তুর্কিস্তান উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী।

দাবি করা হয়, উইঘুররাই পূর্ব তুর্কিস্তানের আদিবাসী। যদিও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে মধ্য এশিয়ার আরও কিছু ‍নৃ-তাত্ত্বিক জাতির বসবাস ছিলো। যেমন, কাজাক ও কিরঘিজ। এখনও উইঘুর সমাজের সঙ্গে যাদের সমাজব্যবস্থার মিল রয়েছে। তবে তারা নানা কারণে মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে উইঘুররা এখানেই স্থায়ী হয়। তারা স্থানীয় কৃষি, ব্যবসা ও সাংস্কৃতির উন্নয়নে অব্যাহতভাবে অবদান রেখে গেছে।

https://i.ytimg.com/vi/GpAQpVnJ-oE/hqdefault.jpg
পূর্ব তুর্কিস্তানের পতাকা

৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কারাহানিদ রাজত্বকালে উইঘুররা ইসলাম গ্রহণ করে। কারানাহিদের রাজধানী ছিলো কাশগড়। কাশগড় খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র ভূমিতে পরিণত হয়। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও বিজ্ঞান ইত্যাদি চর্চার বিখ্যাত সব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় কাশগড়ে। কারানাহিদ শাসনামলেই শতাধিক উইঘুর মুসলিম পণ্ডিতের জন্ম হয়। যারা পরবর্তীতে সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হাজারও মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয় তখন। যার মধ্যে ইউসুফ আল হাজিব রচিত ‘দ্য নলেজ অব হ্যাপিনেস’ এবং মাহমুদ কাশগড়ি রচিত ‘অ্যা ডিকশনারি অব তুর্ক ল্যাঙ্গুয়েজ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

চীন সরকার উইঘুর ভাষা ও ভাষার উপাদানের উপর নানা ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। যা উইঘুর সাহিত্যভাণ্ডার সংরক্ষণে বাধা সৃষ্টি করছে। বিশেষত হান জাতি গোষ্ঠির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো সাহিত্য উপাদান চীন সরকার সংরক্ষণ করতে দিচ্ছে না।

১৮৭৬ সালে চীনের মাঞ্চু রাজ বংশের আক্রমণের আগ পর্যন্ত পূর্ব তুর্কিস্তানে স্বাধীন-সার্বভৌম ও সমৃদ্ধ ইসলামি উইঘুর রাজত্ব টিকে ছিলো। দীর্ঘ আট বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৮ নভেম্বর ১৮৮৪ সালে মাঞ্চু রাজা পূর্ব তুর্কিস্তান দখলে সক্ষম হয়। দখলের পর পূর্ব তুর্কিস্তানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন জিংজিয়াং। অর্থ নতুন ভূমি বা অঞ্চল। মাঞ্চু রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর উইঘুরদের সামাজিক মর্যাদা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংসের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/4/4d/Tomb_of_Sultan_Satuk_Bughra_Khan_%2827778560748%29.jpg
উইঘুরের প্রথম মুসলিম শাসক সুলতান সাতুক বুগরা খানের সমাধিসৌধ

১৯১১ সালে মাঞ্চু সম্রাজে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর পূর্ব তুর্কিস্তান চীনের জাতীয়তাবাদী সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সে সময় থেকে উইঘুররা স্বাধীনতার জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করে এবং দুইবার (১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে) ‘পূর্ব তুর্কিস্তান রিপাবলিক’ নামে স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হয়।

তবে স্বাধীনতাকামীদের দমনে চীনের নির্মমতা উইঘুর অঞ্চলে বারবার মানবিক সংকট তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে চীন ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার মিথ্যা অভিযোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

জিংজিয়াংয়ে নানা ধরনের সংকট তৈরি করেছে চীন সরকার। যেমন, ১৯৪৯ সালের পর থেকে অতিরিক্ত সেনা ও পুলিশ মোতায়েন করে রাখা, এই অঞ্চলে পরমাণু পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বন্দী শিবির স্থাপন করা।

যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট সরকারের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় বহিরাগত ‘হান’দের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে জনসংখ্যার ৪০ ভাগে। বর্তমানে ৭.৫ মিলিয়ন হান বসবাস করে জিংজিয়াংয়ে। সরকার বিপুল সংখ্যক অমুসলিমকে এই অঞ্চলে পুনর্বাসনে উৎসাহিত করছে।

অন্যদিকে মুসলিমদের নানাভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। যেমন, রাজনৈতিক কারণে আটক করা, নির্যাতন করা ও নির্বাসনে বাধ্য করা। সাথে সাথে মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এবং শিক্ষার ভাষা হিসেবে উইঘুরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতিগত উইঘুরদের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পে বিনা বেতনে শ্রমদানে বাধ্য করা হচ্ছে।

সেপ্টম্বর ২০১১ সাল থেকে চীন সরকার স্বাধীনতাকামী ও সন্ত্রাস দমনের অযুহাতে ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু করেছে উইঘুর অঞ্চলে। যা উইঘুরদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছে। প্রতিনিয়ত প্রশাসন ও বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। সারা পৃথিবীর নিন্দার মুখেও সরকার তার নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে।

পূর্ববর্তি সংবাদবিনামূল্যের সরকারি বই ২০০ টাকা করে বিক্রি করলেন প্রধান শিক্ষক
পরবর্তি সংবাদ৩২ হাজার পরিবার পাকা বাড়ি পাবে : ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী