ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ. : খেলাফতে রাশেদার শেষ ঝলক

শাহ মুহাম্মাদ খালিদ ।।

হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর ইন্তিকাল হয় ৬০ হিজরিতে। এরপরই উমাইয়া খিলাফত তার স্বরূপ পাল্টাতে থাকে। পরবর্তী খলিফাগণ যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছিলেন, সেটাকে ঠিক ইসলামি শাসন যায় না। গর্ব, অহমিকা, গোত্রীয় পক্ষপাতিত্ব বা স্বজনপ্রীতি যেগুলোকে খেলাফতে রাশেদার আমলে ভীষণ অন্যায় বলে মনে করা হত, সেগুলো পুনরায় প্রশংসনীয় গুণে পরিণত হয়। চাটুকারদের আখড়া বসে খলিফার দরবারে।

ঠিক এমনই সময়ে আমিরুল মুমিনিনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ.। তার এই দায়িত্বগ্রহণও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। খলিফা সুলাইমান ইবন আব্দুল মালিক যখন অসুস্থ হয়ে মৃত্যুশয্যা গ্রহণ করেন তখন তার ছেলেরা ছিল একেবারেই নাবালক। তাদেরকে বড় বড় পোশাক ও আলখেল্লা পরানো সত্ত্বেও খেলাফতের মসনদে বসার উপযুক্ত মনে হচ্ছিল না। ফলের রজা’ ইবনে হায়াতের পরামর্শে আপন চাচাতো ভাই একই সাথে দুলাভাই ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব সমর্পণ করে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ইতিহাসবিদগণ বলেছেন রজা’ ইবনে হায়াতের এই পরামর্শ অনেক বেশি মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ. খেলাফতের মসনদে আরোহণ করে পুরো খেলাফতের চেহারাই পাল্টে দেন। পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাগণ রাজতান্ত্রিক ও পরিবারতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন ওমর এসে সেসব ধুলোয় মিশিয়ে দেন। ফিরিয়ে আনেন খেলাফতে রাশেদার সেই সোনালীকাল।

ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ৬১ হিজরিতে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করার পূর্বে তিনি মদিনার গভর্নর ছিলেন। মদিনার গভর্নর থাকাকালে তার উঠা-বসা চলা-ফেরা এবং বেশভূষায় ছিল একজন অভিজাত ও সৌখিন যুবকের ছাপ। মানুষ আতরের ঘ্রাণ শুঁকলেই বুঝতে পারত একটু আগে এ রাস্তা দিয়ে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ গিয়েছেন। তার পাগড়ি-টুপি, পোশাক, জুতা, আতর এবং অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মূল্য ছিল আকাশছোঁয়া।

কিন্তু সেই ওমর যখন খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন সাথে সাথেই তার চলাফেরা ও বেশভূষায় আমূল পরিবর্তন চলে এলো। পূর্বের জৌলুস ভরা জীবন পরিত্যাগ করে সরল ও সাধারণ জীবন গ্রহণ করলেন। নিজের সংস্কার সাধন করার পর তিনি রাষ্ট্রীয় সংস্কার কাজে হাত দিলেন।

রাষ্ট্র তখন নানা উপায়ে জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় এবং তা আমির ওমরাদের পিছনে ব্যয় করার একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছিল। তিনি সমস্ত অন্যায়মূলক কর ও ট্যাক্স বাতিল করে দিলেন। মহলে দাসী ও বাদীর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনেন।

চার খলিফার আমলে খলিফার দরবারের যে সরল ও সাদাসিধে চেহারা ছিল উমাইয়া খলিফাগণ এসে তা পাল্টে দিয়েছিলেন। এর মূল কারিগর ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া। সিংহাসন, রাজকীয় বেশভূষা, প্রহরী, দরবারে গণমানুষের প্রবেশ সীমাবদ্ধ করে দেয়া -এসব তারই সংযোজন।

পরবর্তী খলিফাদের আমলে রাজদরবার পরিণত হয়েছিল কবি, বাগ্মী, বিতার্কিক ও চাটুকারদের এক আখড়ায়। ওই সময়ে রাজদরবারের ছত্রছায়ায় কবি ও গায়কদের দৌরাত্ম্য কতটা বেড়েছিল একটা ঘটনার মাধ্যমে তা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে -একবার ইরাকের প্রখ্যাত গায়ক হুমায়ূনকে মদিনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। একটি ঘরে তার গানের জলসা বসেছিল। সেই ঘরে দর্শকদের এত ভিড় হয়েছিল যে ছাদেও দর্শক উঠেছিল তার গান শোনার জন্য। একপর্যায়ে তাদের চাপে সেই ঘরের ছাদ ধসে যায়, স্বয়ং গায়ক হুমায়ূনও নিহত হয়।

দায়িত্ব গ্রহণ করামাত্রই এসব দরবারি কবি ও চাটুকারদেরকে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ. বিদায় করেন। সাধারণ মুসলমানদের মধ্য থেকে জাহিলি যুগের এই ধরনের প্রবণতা দূর করার জন্য তিনি ব্যাপক দাওয়াতি কর্মকাণ্ড হাতে নেন।

আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. তার তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমাত কিতাবে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ.-এর জীবনের একটি অনন্য দিকে তুলে ধরেছেন। মুসলিম বাহিনীর উদ্দেশ্যে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ. বলেছিলেন আমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে যে জয় লাভ করি সেটা শুধুমাত্র এই কারণে যে তাদের পাপ ও গুনাহ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। অন্যথায় শক্তি-সামর্থ্য, অস্ত্র ও সৈন্য সংখ্যা ইত্যাদির বিবেচনায় আমরা কোনভাবেই তাদের সাথে জয়লাভ করার মত নই। এখন আমরা নিজেরাই যদি গুনাহ করতে থাকি এবং আমাদের গুনাহের পরিমাণ যদি তাদের গুনাহের সমান হয়ে যায় তাহলে তো আমাদের বিজয় লাভ করার শেষ উপায়টুকুও শেষ হয়ে গেল।

বর্তমান সময়ে মুসলিম জাতি বিশ্বব্যাপী যে মার খাচ্ছে উপরোক্ত কথা চিন্তা করলে সেটার কারণ আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। রাষ্ট্রের সংস্কার, মুসলমানদের মধ্যে সংস্কারকাজ, দেশজয় এবং বিশ্বের বিস্তৃত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের বিশাল কর্মযজ্ঞ ওমর একসাথে হাতে তুলে নেন। তাঁর নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে রঙ হারাতে বসা মুসলিম সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে খেলাফতে রাশেদার রূপ ফিরে পেতে থাকে। এমনকি ইতিহাসবিদগণ ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে পঞ্চম খলিফায়ে রাশেদা এবং তাঁর খেলাফতকালকে খেলাফতে রাশেদার অন্তর্ভুক্ত মনে করেন।

এই জাতির দুর্ভাগ্য, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তাদের খেদমত করার জন্য খুব একটা সময় পাননি। খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার দুই বছরের মাথায় মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বিশুদ্ধ বর্ণনামতে সময়টা ছিল ১০১ হিজরি। এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ আছে, তাঁর বংশের লোকেরাই বিষ প্রয়োগ করে তাঁকে হত্যা করেছে। কারণ, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ.-এর কারণে তাদের রাজকীয় জীবন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার, মানুষের উপর জোর-জুলুম, মনচাহি জীবনযাপন এবং নানারকম গুনাহে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

রাজ পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং রাষ্ট্রীয় আমলারা যেকোন উপায়ে তাদের পুরানো বিলাসী ও গুনাহের পূর্ণ জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছিল। এ কারণে তারা এমন একজন ব্যক্তিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি যার দায়িত্ব গ্রহণ ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে এই জাতির উপর এক বিরাট অনুগ্রহ। এই ধরনের পদলোভী স্বার্থান্বেষী গাদ্দার যতদিন মুসলিম রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে থাকবে ততদিন ন্যায় ও ইনসাফের শাসন কায়েম করার কোন একক প্রচেষ্টা কোনোভাবেই সফল হবে না। সামান্যতম সম্ভাবনা তৈরি হওয়া মাত্রই ওই সমস্ত গাদ্দার এরা গলাটিপে এই সম্ভাবনাকে হত্যা করে ফেলবে।

পূর্ববর্তি সংবাদঅনলাইন পত্রিকার জন্য নীতিমালা হচ্ছে, রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা হচ্ছে : হাছান মাহমুদ
পরবর্তি সংবাদবিবাড়িয়ায় বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাস খাদে পড়ে নিহত ৫