মুহাম্মাদ ইলিয়াছ খান ।।
হযরত মনসুর ইবনে মুতামির ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তাবেয়ী । তিনি ১৩২ হিজরী বা এর কাছাকাছি সময়ে ইন্তেকাল করেছেন। তার জন্ম সন নিয়ে ইতিহাসের গ্রন্থগুলো নীরব। তিনি ছিলেন কুফা নগরের বাসিন্দা। ইসলামের ইতিহাসে কুফা নগরীর রয়েছে বরেণ্য ইতিহাস। অসংখ্য খ্যাতিমান মনীষী জন্ম নিয়েছেন এ নগরীতে।
মনসুর ইবনে মুতামির অনেক বড় বড় ইমাম থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাদের অন্যতম হলেন বিখ্যাত ফকীহ ইবরাহীম নাখায়ী, সাঈদ ইবনে জুবায়ের এবং মুজাহিদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ। তার থেকে যারা হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের তালিকাও অনেক দীর্ঘ। ইমাম সুলাইমান আলআমাশ, ইমাম সুফিয়ান ছাওরী এবং ইমাম শুবা ইবনুল হাজ্জাজের মত বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাব সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে তিরমিযি, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ী এবং সুনানে ইবনে মাজাহ- এগুলোর প্রত্যেকটিতেই তার সনদে বর্ণিত হাদীস রয়েছে।
তিনি ছিলেন নিজ যুগের অনেক বড় মুহাদ্দিস। ইমাম যাহাবী রহ. তার সম্পর্কে বলেন, তিনি ছিলেন ইলমের আধার। তার সমগ্র সত্ত্বাই যেন ছিল ইলম।
আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেন, তার সময়ে কুফা নগরীতে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় হাদীসের হাফেজ।
রাত জেগে জেগে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি নামাজ আদায় করতেন ।
সারা দিন হাদীস চর্চায় মগ্ন থাকতেন। আর রাত হলে দাঁড়িয়ে যেতেন জায়নামাযে। সিজদায় নত হতেন মহান প্রভুর দরবারে। ভুলে যেতেন সারা দিনের ইলম মগ্নতার ক্লান্তি।
তিনি সাধারণত ছাদে নামায আদায় করতেন । একবারের ঘটনা । তার এক প্রতিবেশীর সন্তান তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা!উনার ঘরের ছাদে যে একটি কাষ্ঠখণ্ড ছিল সেটি কোথায় গেল?
বাবা বললেন, সেটি আসলে কাঠ ছিল না। বরং আমাদের প্রতিবেশী মনসুর। রাতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ নামাজআদায় করতেন।
আবু বকর ইবনে আইয়াশ রহ. বলেন, মানসুর যখন নামাজে দাঁড়াতেন অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে নামায আদায় করতেন। বিনীত মস্তক। বিগলিত হৃদয়। দীর্ঘ শশ্রুগুলো বুকস্পর্শ করে থাকত। অত্যন্ত ধীর-স্থিরতার সাথে নামায আদায় করতেন । আল্লাহ তায়ালা তার উপর রহমত বর্ষণ করুন। তিনি দীর্ঘ নামাজ আদায় করতেন । অনেক রোজা রাখতেন। কেউ যদি মনসুর ইবনে মুতামির, আমের ইবনে আবী রাশেদ এবং আসেম ইবনে আবিননিজাদ রহ.-কে নামাজে দেখত তাহলে অবশ্যই বলত, আহ! কত সুন্দর তাদের নামায!
যায়েদা রহ. বলেন, মনসুর রহ.-কে বিচারকের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ইবনে হুবায়রা অনেক চাপাচাপি করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব থেকে দূরেই থাকেন।
তিনি আরো বলেন, মনসুর রহ. চল্লিশ বছর রোজা রেখেছেন এবং রাত্রি জাগরণ করে নামায আদায় করেছেন। তিনি অনেক কান্নাকাটি করতেন। তার অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে তার মা বলতেন, হে আমার ছেলে! তুমি কি এভাবে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে!
তিনি বলতেন, আমি কী করছি সে ব্যাপারে আমি ভালো করেই জানি।
সকাল বেলা তিনি চোখে সুরমা দিয়ে এবং মাথায় তেল দিয়ে বের হতেন। সুন্দরভাবে সেজে বের হতেন। যেন কেউ তার ব্যাপারে কিছু বুঝতে না পারে।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রহ. মনসুরের কথা উল্লেখ করে বলতেন, তিনি তো কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
ফকীহ ও মুহাদ্দিস সুফিয়ান সাওরী রহ. তার নামাযের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন,মনসুর এত সুন্দর করে নামাজ আদায় করতেন যে কেউ যদি দেখত তাহলে সে বলত, তিনি তো এখনই মারা যাবেন। একবার তার মা তাকে বললেন, হে আমার ছেলে! তোমার দুই চোখেরও তো তোমার উপর কিছু হক আছে। শরীরেরও তো তোমার উপর কিছু হক আছে।
তখন তিনি বললেন, মা,মনসুরকে নিজ হালতে থাকতে দিন। কারণ শিঙ্গার দুইবারের ফুঁৎকারের মাঝে ঘুমের জন্য অনেক দীর্ঘ সময় আছে।
সূত্র: সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইমাম যাহাবী। হিলয়াতুল আওলিয়া, আবু নুয়াইম।
