কেন হারিয়ে যাচ্ছে কিশোরদের আদব-কায়দা : কী বলেন আলেমরা?

আতাউর রহমান খসরু ।।

ঢাকার রূপনগর আবাসিক এলাকার ৭ নং রোডে চাকরিজীবী নারী রাবেয়া খাতুনের বাসা। গলির শেষ মাথায় বাসা হওয়ায় কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হয় তাকে। প্রতিদিন এই সামান্য জায়গাটুকু পার হতে হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। কারণ, তিনি যখন বাসায় ফেরেন রাস্তায় জটলা বেধে আড্ডা দেয় পাড়ার একদল কিশোর। তারা সবাই ছেলের বয়সী হলেও প্রায় অশালীন মন্তব্য শুনতে হয় তাকে। আজ বাস থেকে নেমেই যখন দেখলেন কিশোরদের সেই আড্ডাটা আজ নেই, তখন তিনি মনে মনে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন।

ঢাকার নিউ মার্কেট থেকে কেনাকাটা শেষ করে মেয়েকে নিয়ে বাসে উঠলেন আফজাল হোসাইন। সামনের দিকে সিট না পেয়ে পেছনের দিকে এগিয়ে যান তারা। কিন্তু একটু সামনে বাড়তেই ভীষণ বিব্রত হতে হলো তাকে। বাসের পেছন দিকের সিটে বসে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গিতে ব্যস্ত একটি কিশোর যুগল। আফজাল হোসাইন সামনে না বেড়ে তাড়াতাড়ি একটি সিটে বসে পড়লেন। কিন্তু তাতে রেহাই হলো না তার। পেছন থেকে অনবরত ভেসে আসতে লাগলো কিশোর-কিশোরীর প্রেম নিবেদনের শব্দমালা।

নগরজীবনের দুই প্রান্তের এই দুটি ঘটনা বিরল বা বিচ্ছিন্ন কোনো চিত্র নয়; বরং এমন চিত্র আজকাল দেখা যাচ্ছে নগরের প্রায় সবখানে। সমাজের উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীরা ক্রমেই হয়ে উঠছে বেপরোয়া। লাগামহীন হচ্ছে দিনদিন। পরিবার, সমাজ , আদব ও সংস্কার সবকিছুই তাদের কাছে হয়ে যাচ্ছে মূল্যহীন। ব্যক্তিগত জীবন হোক বা সামাজিক জীবন কোথাও কোনো শৃঙ্খলা নেই তাদের। অথচ মাত্র এক দশক আগেও এই কিশোরদের মধ্যে নিরীহ ও ভদ্র প্রকৃতিটাই ছিলো প্রবল। সব কৌতুহল ও দুরন্তপনা আড়াল করার একটা চেষ্টা ছিলো তাদের মধ্যে।

জামিয়া ইসলামিয়া হোসাইনিয়া, আরজাবাদের পরিচালক মাওলানা বাহাউদ্দিন যাকারিয়া কিশোর-কিশোরীদের বেপরোয়া জীবনযাত্রার জন্য তার শিক্ষার সার্বিক ত্রুটিগুলোকেই দায়ী মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব রয়েছে, এখন বাবা-মা দুজনই কর্মজীবী তাই শিশুর মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে তাদের অবদান থাকছে না, অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক চিন্তায় আক্রান্ত, সমাজের প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতো ব্যস্ত যে সমাজের ভালো-মন্দ তাকে ভাবিত করে না তাহলে কিশোররা শিষ্টাচার ও ভদ্রতা, উন্নত সামাজিক জীবনের পথনির্দেশ কোথায় পাবে!

অবশ্য আবহাস এডুকেশন এন্ড রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান ড. শামসুল হক সিদ্দিক কিশোর-কিশোরীদের এই পরিবর্তনের পেছনে বৈশ্বিক পরিবর্তনকেই বেশি দায়ী মনে করেন। তার ভাষায়, বৈশ্বিক পরিবর্তন এবং তার আবহ আমাদের সমাজে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মতে আছড়ে পড়ছে। সম্ভাব্য সব পথেই আমাদের ক্ষতি করছে। স্থানীয় সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রভাবেই।

তবে তারা উভয়ে কিশোর প্রজন্মের মানসিকতা ও আচার-আচরণের পরিবর্তনে মিডিয়া ও প্রযু্ক্তির প্রভাব গুরুতর বলে মন্তব্য করেন। মাওলানা বাহাউদ্দিন যাকারিয়া বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রচারিত স্থানীয় ও বিদেশি মিডিয়াগুলোই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে স্বাধীন(!)জীবনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে। তাদের শেখানোই হচ্ছে তোমার ইচ্ছের উপরে কোনো কিছু থাকতে পারে না।’

ড. শামসুল হক সিদ্দিকের কথায় ব্যাখ্যা মেলে মাওলানা বাহাউদ্দিন যাকারিয়ার বক্তব্যের। তিনি বলেন, কিশোর বয়সে সবার ভেতর একটি ‘হিরোইজম’ কাজ করে। আর মিডিয়া তাদের সামনে এমন সব চরিত্রকে হিরো হিসেবে উপস্থাপন করে যারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে চূড়ান্ত পর্যায়ের স্বেচ্ছাচারী এবং অতি মাত্রায় স্বাধীন।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘প্রযুক্তি আপনার অজান্তেই আপনার কিশোর সন্তানকে এমন একটি জগতের সাথে সম্পৃক্ত করে দিচ্ছে যা তাকে উগ্র, উচ্ছৃঙ্খল ও জীবনের প্রতি হতাশ করে তুলতে পারে।’

কিশোর-কিশোরীদের এই আদব-কায়দাহীন পথযাত্রা থেকে ফেরানোর উপায় কী? ড. শামসুল হক সিদ্দিকের মতে তাদেরকে ফেরানো খুব সহজ ব্যাপার নয়; বরং অসম্ভব প্রায়। কারণ, তাদেরকে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী করার জন্য দেশি-বিদেশি প্রচেষ্টাগুলো এতো প্রবল যে তার মোকাবেলা করা অসম্ভবই বলা যায়। তাদের উদ্যোগ, কৌশল ও কর্মপরিধির তুলনায় আমাদের (উলামায়ে কেরাম) প্রচেষ্টা খুবই দুর্বল ও সীমিত পরিধির।

তবে তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে কিশোর-কিশোরীদের জীবন সুন্দর করা ও আদব-তমিজের রঙে রাঙিয়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে বলে মত দেন। তিনি বলেন, উলামায়ে কেরাম নিজ নিজ জায়গা থেকে সমাজের ইতিবাচক কাজের ধারাগুলো অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন। ভবিষ্যতেও করবেন। পরিস্থিতি যতো প্রতিকূলই হোক না আমাদের চেষ্টা থাকবে মানুষ যেন পুরোপুরি ইসলামের উপর থেকে জীবনযাপন করে।

এই ব্যাপারে আশাবাদী মাওলানা বাহাউদ্দিন যাকারিয়া। তিনি মনে করেন, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দেওয়া, পারিবারিক বন্ধন ও অনুশাসন প্রতিষ্ঠা, পরিবার ও সমাজে নূন্যতম শাসন-তরবিয়তের নিশ্চয়তা; সর্বোপরি বাবা-মায়ের সযত্ন মনোযোগ কিশোর-কিশোরীদের জীবনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে।

আর শিশু-কিশোররা যেহেতু অনুকরণপ্রবণ তাই তাদের সামনে মানব ইতিহাসের স্বর্ণমানবদের জীবন ও ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। যেন তারা তাদেরকে নিজের জীবনের নায়ক ভাবতে পারে।

পূর্ববর্তি সংবাদআল্লামা শফী নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে নয়, তাদের নিরাপত্তার কথা বলেছেন : আল্লামা হবিগঞ্জী
পরবর্তি সংবাদকুড়িলে বাস চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত