যেভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন মার্কিন গণিতবিদ প্রফেসর জেফরি ল্যাং

আবরার আবদুল্লাহ ।।

প্রফেসর ড. জেফরি ল্যাং। তিনি ৩০ জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পুরডো ইউনিভার্সিটি থেকে থেকে গণিতের ‍উপর মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব কানসাস-এর গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক হিসেবে কর্মরত।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক শৈশব ও কৈশোরে ক্যাথলিক মিশনারি স্কুলে পড়ালেখার করার সময় স্রষ্টার প্রতি আস্থা হারান। এক সময় নিজেকে নাস্তিক হিসেবে দাবি করেন। কিন্তু শিক্ষকতার জীবনে প্রবেশ করার পর একজন মুসলিম ছাত্র তার সংশয়-সন্দেহ দূর করে ইসলামের পথে আসতে সাহায্য করে। তার ইসলামগ্রহণের এই গল্পগুলোই এখানে তুলে ধরা হলো।

মিশনারি স্কুল তাকে হতাশ করে
নিজের শিক্ষা জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছি। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত আমি ক্যাথলিসিজম চর্চা করেছি। এই সময় আমার মনে স্রষ্টা ও খ্রিস্টবাদ সম্পর্কে অসংখ্য প্রশ্ন জেগেছে কিন্তু আমি তার উত্তর পাইনি।

জেফরি সত্যের সন্ধান পাওয়ার ব্যাপারে তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘১৯৬০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত অন্য পাঁচটি শিশুর মতো আনন্দ-খেলায় আমার সময় কেটেছে। এরপর বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ব্যাপারে আমার ভেতর কৌতূহল তৈরি হলো। জীবনের মূল্যবোধ এবং তার রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় রূপ ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে শিখলাম। এমনকি আমি কিশোর বয়সেই ক্যাথলিক চার্চের অনেক শীর্ষ ব্যক্তির সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়েছি।

গির্জার কাছে উত্তর না পেয়ে নাস্তিক্যবাদের দীক্ষা
১৮ বছর বয়সে প্রফেসর জেফরি নাস্তিক্যবাদের দীক্ষা নেন। তিনি স্রষ্টার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। তখন তার মনে হতো, ‘যদি পৃথিবীতে প্রভুই থাকবেন এবং তিনি দয়ালু ও সমব্যথী হবেন তাহলে পৃথিবীতে কেন এতো কষ্ট? কেন তিনি আমাদের সবাইকে সুখে রাখেন না। কেন তিনি পৃথিবীর মানুষকে এতো দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দেন। এমন অসংখ্য প্রশ্ন নাস্তিক জেফরির মনে ঘুরপাক খেতো।

ছাত্রের উত্তরে মুগ্ধ শিক্ষক
অবশেষে প্রফেসর জেফরি একটি উত্তর খুঁজে পেলেন। তিনি যখন ইউনিভার্সিটি অব সানফ্রান্সিসকো-এর গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান, তখন তিনি বুঝতে পারলেন পৃথিবীর একজন স্রষ্টা আছে এবং তিনি যা করছেন ঠিকই করছেন। কিন্তু কীভাবে? তার এই উত্তর পেতে সহযোগিতা করেছিলেন কয়েক মুসলিম ছাত্র।

তিনি বলেন, সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম লেকচারের দিনই আমি একজন মুসলিম ছাত্রের দেখা পাই। সে গণিতের একটি কোর্স করছিলো। আমি এই ছাত্র ও তার পরিবারের ধর্ম নিয়ে কখনো কথা বলিনি। এই বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোনো কথাও হয়নি। একদিন সে আমাকে একটি ‘কুরআন’ উপহার দিলো। তখন আমাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে কথা হলো।

https://images.gr-assets.com/books/1520109680l/38920873.jpg

আলোর দিশারি ছাত্রের নাম মাহমুদ
ছাত্রের নাম ছিলো মাহমুদ কাদির। সে সৌদি আরব থেকে পড়তে এসেছিলো। মাহমুদ প্রফেসর জেফরিকে ইসলাম বিষয়ক আরও অনেক তথ্য-উপাত্ত সরবারহ করেছিলো। তবে মজার বিষয় হলো তাদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়েই কথা হতো। ‘আমি মাহমুদের সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতাম। সেও ঠিক ঠিক উত্তর দিতো। তার ইংরেজিও ছিলো চমৎকার। আমি মাহমুদের উত্তরে মুগ্ধ হয়ে যায়। অথচ পেশায় সে ছিলো একজন পুলিশ অফিসার।

সমাবর্তনের সময় যেদিন ক্যাম্পাসের বাইরে বড় একটি আয়োজনে সব অনুষদের সব ছাত্র অংশগ্রহণ করেছিলো, মাহমুদ আমাকে একটি কুরআন ও কিছু ইসলামি বই উপহার দিলো। তার উপহারে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।’

কুরআনের পাতায় পাতায় নিজেকে খুঁজে পেলেন জেফরি
এরপর নিজ আগ্রহেই প্রফেসর জেফরি কুরআন পাঠ করেন এবং তার ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোও পড়তে শুরু করেন। সে কুরআন পড়ে মুগ্ধ হতে থাকেন। কুরআনের প্রথম দুই পারা অধ্যয়ন করার পর তিনি কুরআনের প্রতি বিমোহিত হয়ে গেলেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে তা অধ্যয়ন করতে লাগলেন।

প্রতি রাতেই আমার ভেতর অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হতো। কিন্তু আমি পরের দিন কুরআনে কোনো না কোনোভাবে তার সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে যেতাম। যেন আমি কুরআনের পাতায় পাতায় নিজেকে খুঁজে পেতাম।

এখানে কী করছো তোমরা?
সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০ বছরে বহু মুসলিম শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেছে এবং তারা কৃতিত্বের সঙ্গেই পড়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু ভিন্ন ব্যবস্থাপনাও ছিলো।

প্রফেসর জেফরি যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন তখন একটি চমৎকার ঘটনা ঘটে। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্চের নিচ তলায় একটি ছোট্ট রুম খুঁজে পান। এই রুমে কয়েকজন মুসলিম শিক্ষার্থী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতো।

তার মাথা ছিলো প্রশ্ন আর কৌতূহলে ভরা। তিনিও তাড়াতাড়ি নামাজের জায়গায় প্রবেশ করলেন। এটা ছিলো মাগরিবের নামাজের সময়। তারই এক ছাত্র তাকে নামাজ পড়তে ডাকলো। তিনি সেই ছাত্রের ডান পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সব কাজে তাকে অনুসরণ করলেন। এই সময় তিনি ছাত্রের চোখে পানি দেখতে পান।

প্রফেসর জেফরি বলেন, আমি তাদের সাথে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করলাম। আমার মাথায় যেসব প্রশ্ন ছিলো এবং আমি যা যা ভাবতাম তা তুলে ধরলাম। আমি সত্যিই মুগ্ধ ছিলাম তাদের উপস্থাপন শৈলীতে। তাদের উত্তরগুলো ছিলো যৌক্তিক ও সহজেই বোধগম্য। তারা ইসলামের বক্তব্যই তুলে ধরেছিলো। আমি মুসল্লাহ (নামাজের জায়গা) ত্যাগ করার পর কালেমায় শাহাদাহ পাঠের আগ্রহবোধ করলাম।

নামাজে এতো প্রশান্তি!
প্রফেসর জেফরি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে লাগলেন এবং অবিশ্বা্স্য আত্ম প্রশান্তি খুঁজে পেলেন। ফজরের নামাজকে তার কাছে মনে হলো সবচেয়ে সুন্দর ইবাদত। কখনো নামাজ পড়তে না পারলে তিনি মনের ভেতর গভীর হতাশা বোধ করতেন।
একদিন প্রফেসর জেফরির আট বছরের মেয়ে তাকে প্রশ্ন করে, বাবা! আমরা কেন নামাজ আদায় করি?

আমি তার প্রশ্নে হতচকিত হলাম। আমি ভাবতেও পারিনি একটি আট বছরের শিশু এমন প্রশ্ন করতে পারে। আমি তাকে নামাজের উপকারিতা ও তৃপ্তির বিষয়গুলো বলতে চাইলাম। কিন্তু সে কী বুঝবে? আমি তাকে বললাম, আমাদের নামাজ পড়া উচিৎ কারণ আল্লাহ আমাদের নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

আমার ছেলে পাল্টা প্রশ্ন করলো, কিন্তু বাবা! কিন্তু নামাজ আদায় করলে আমরা কী পাবো? আমি বললাম, বাবা! এটা বোঝা তোমার জন্য কঠিন। তবে এতোটুকু বলতে পারি, তুমি যদি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত পড়ার অঙ্গীকার করতে পারো তোমার বাবা নিশ্চিত যে, তুমি তার উত্তর পেয়ে যাবে।

জামিলা প্রশ্ন করলো, নামাজ কী আমাদের সুখী করতে পারে বাবা? প্রিয় মেয়ে! নামাজ আমাদের আত্মাকে প্রশান্ত করে। এছাড়াও নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর ভালোবাসা লাভে সক্ষম হই। আর এটাই অনেক বড় আনন্দের। তোমার বাবা কাজ করতে করতে অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে যান, তবে নামাজ ছুটে গেলে তিনি আরও বেশি ক্লান্তি অনুভব করেন।

গণিত চর্চা আমাকে ইসলাম গ্রহণে সাহায্য করেছে
ড. প্রফেসর জেফরি ল্যাং আমেরিকার খ্যাতিমান গণিতবিদদের একজন। তিনি বলেন, গণিতের অভিজ্ঞতা তাকে ইসলাম গ্রহণে সাহায্য করেছে। গণিত একটি যৌক্তিত বিষয়। সঠিক উপাত্তগুলো সাজিয়ে সঠিক উত্তর লাভে সাহায্য করে গণিত।

গণিত নিয়ে কাজ করায় অনেক সময় আমি হতাশা বোধ করতাম। যখন আমি কোনো সঠিক উত্তর খুঁজে পেতাম না। ইসলাম আমাকে যা বলেছে তার সবই যৌক্তিক, বুদ্ধিগ্রাহ্য ও সহজে বোধগম্য।

১৯৯৪ সালে প্রফেসর জেফরি রেকা নামের এক আরব নারীকে বিয়ে করেন। তাদের ৩টি সন্তান রয়েছে। জামিলা, সারাহ ও ফাত্তিন। গণিতের উপর তার শতাধিক মৌলিক গবেষণা রয়েছে। এছাড়াও তিনি কয়েকটি ইসলামি বইও লিখেছেন। যা আমেরিকান মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তার রচিত ‘ইভেন অ্যাঞ্জেল আস্ক : অ্যা জার্নি টু ইসলাম ইন আমেরিকা’ বইটি আমেরিকার সর্বাধিক বিক্রিত বইগুলোর অন্যতম। এটি মূলত তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে রচিত।

সূত্র: ইংরেজি ব্লগ কনভার্ট টু ইসলাম ও উইকিপিডিয়া

পূর্ববর্তি সংবাদসদরঘাটে নৌকাডুবি: আরো এক লাশ উদ্ধার
পরবর্তি সংবাদআওয়ামী লীগ ভেঙে চুপসে গেছে: ওবায়দুল কাদেরকে পাল্টা বক্তব্যে রিজভী