ডাকসু ইস্যুতে ইসলামি ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন : ড. আহমদ আবদুল কাদের

অধ্যাপক ড. আহমদ আবদুল কাদের। এক সময়ের সাড়াজাগানো এই ছাত্রনেতা এখন দায়িত্বপালন করছেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব হিসেবে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও ছাত্রনেতা। ডাকসু নির্বাচনে জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন একাধিকবার। নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলে তখন আলোচনায়ও আসেন তিনি।  

সম্প্রতি ছাত্রলীগ ও বাম সংগঠনের ‘ধর্মভিত্তিক দলের ছাত্র সংগঠনকে ডাকসু নির্বাচনে নিষিদ্ধ করা হোক’ মর্মে করা দাবি নিয়ে কথা হয় এই সাবেক ছাত্রনেতার সঙ্গে। একান্ত আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেছেন তার সময়ের ক্যাম্পাস রাজনীতির চিত্র, ছাত্র রাজনীতির পরিবর্তন এবং ছাত্রলীগসহ বাম ছাত্রসংগঠনগুলির দাবির অসারতা। সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও দিয়েছেন তরুণ ছাত্রনেতাদের প্রতি। তার সঙ্গে কথা বলেন আতাউর রহমান খসরু।  


 

ইসলাম টাইমস : সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের বৈঠকে ডাকসু নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনকে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার প্রস্তাব করেছে ছাত্রলীগ। বাম ছাত্র সংগঠনগুলোসহ ছাত্র দল এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

ড. আহমদ আবদুল কাদের : দাবিটি সম্পূর্ণ অন্যায়। ধর্মভিত্তিক দলগুলো বৈধভাবে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে জাতীয় রাজনীতিতে কাজ করছে। সুতরাং তারা ক্যাম্পাসেও সুযোগ পাবে এটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে তারা ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না, নির্বাচন করতে পারবে না -এসব দাবি অবশ্যই অন্যায়। এই দাবি যেই করুক; ছাত্র দল যদি সমর্থনও করে তবুও এটা অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য।

আমি মনে করি, কর্তৃপক্ষের এই প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিৎ হবে না। এটা করলে অবিচার হবে এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। এছাড়াও স্বাভাবিক রাজনীতির পরিবেশ নষ্ট হলে তার সার্বিক ফলাফল অবশ্যই ভালো হয় না।

ইসলাম টাইমস : প্রস্তাবকারীরা বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা কখনোই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে গ্রহণ করেনি। আপনি নিজে ছাত্র রাজনীতি করেছেন। আপনি কী দেখেছেন?

ড. আহমদ আবদুল কাদের : আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। এই কথা তারা কোথায় পেল? এর ভিত্তিই বা কী? তারা যদি ছাত্র-শিক্ষক বলতে বামধারার ছাত্র-শিক্ষক বোঝায় তাহলে ভিন্নকথা। নতুবা আমরা ক্যাম্পাসে ইসলামি রাজনীতির পক্ষে বহু ছাত্র-শিক্ষককে পেয়েছিলাম। আমি মনে করি, এখনও ক্যাম্পাসে যদি সুস্থ ও অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে বহু ছাত্র-শিক্ষক ইসলামি রাজনীতির পক্ষে কথা বলবেন।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সাফল্য লাভের পর ক্যাম্পাসে এই প্রবণতা শুরু হয়েছে। এর আগে ডাকসু, চাকসু ও রাকসু সব নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক দলের ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণ ছিলো।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ছাত্র-শিক্ষকরা চান না। তবুও তো নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে। কারণ, এটা মানুষের অধিকারের প্রশ্ন। এই দেশের মানুষ ধর্ম চায়, তারা ধর্মভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমর্থন করে। সুতরাং তাদের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ক্যাম্পাসেও হওয়া দরকার।

হ্যা, কোনো ছাত্র সংগঠনের যদি রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত থাকার প্রমাণ থাকে তাহলে তাদের নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। আমি আবারও বলছি, তাদের এই দাবির ঐতিহাসিক, আইনত ও তাত্ত্বিক কোনো বৈধ ভিত্তি নেই। এটা অন্যায় ও অমূলক।

ইসলাম টাইমস : তারা বলছে, ক্যাম্পাসের অলিখিত নিয়ম এটা?

ড. আহমদ আবদুল কাদের : অলিখিত নিয়মের কোনো ভিত্তি নেই। আর লিখিতও যদি থাকতো তবুও তা সংবিধান ও মৌলিক অধিকার বিরোধী হওয়ায় তা গ্রহণযোগ্য হতো না। এখন যদি চাপিয়ে দিতে চান তবে ভিন্নকথা।

ইসলাম টাইমস : ক্যাম্পাসে ধর্মভিত্তিক দলের ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব যদি গৃহীত হয়। তবে জাতীয় রাজনীতিতে তার কী প্রভাব পড়তে পারে?

ড. আহমদ আবদুল কাদের : প্রভাব তো অবশ্যই পড়বে। ইতিমধ্যে একটি শ্রেণি দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলছে। তাদের দাবির পক্ষে এই পদক্ষেপ একটি যুক্তিতে পরিণত হবে। দাবিও জোরালো হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনেক ক্ষেত্রেই অনুসরণীয় মনে করে। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ক্যাম্পাসেও একই দাবি উঠতে পারে। এতে ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চায়ও বাধা আসতে পারে।

তবে আমার মনে হয়, জাতীয় রাজনীতিতে এর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। কারণ, আমাদের দেশের রাজনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যমান প্রভাব খুব বেশি নেই।

ইসলাম টাইমস : এর বিপরীতে ধর্মবিদ্বেষী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠতে পারে?

ড. আহমদ আবদুল কাদের : আমাদের দেশের আইনে ধর্মবিদ্বেষের সংজ্ঞা ও পরিধি সুস্পষ্ট নয়। সুতরাং ধর্মবিদ্বেষী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিটাও সুনির্দিষ্টভাবে করা যায় না। আমি এটাকে কোনো সমাধানও মনে করি না। আমি মনে করি, যারা ধর্মবিদ্বেষী রাজনীতিকে উস্কে দিতে চায় এবং সমাজে ধর্ম বিদ্বেষ ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া যায়। ধর্মবিদ্বেষ অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটা সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতি নষ্ট করে। রাষ্ট্রীয় আইনেও এটা দণ্ডনীয়।

ইসলাম টাইমস : আপনাদের দলের ছাত্র সংগঠন ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে?

ড. আহমদ আবদুল কাদের : নব্বইয়ের দশকে ছাত্র মজলিস যাত্রা শুরু করার সময় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় তারা ক্যাম্পাসের নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশ নেবে না। সম্ভব তারা সেই নীতিতেই আছে। তবে তারা চাইলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও করতে পারে। নিজেদের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা স্বাধীন।

ইসলাম টাইমস : ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন ডাকসু নির্বাচন করতে চাচ্ছে এবং পূর্ণ প্যানেলেই করতে চাচ্ছে। তারা নির্বাচনে সব ছাত্র দলের অংশগ্রহণ দাবি করছে। অন্যান্য ইসলামি ছাত্র সংগঠন তাদেরকে সমর্থন করতে পারে কী?

ড. আহমদ আবদুল কাদের : নির্বাচনে সমর্থনের বিষয়টি প্রত্যেক দলের নিজস্ব। কিন্তু অংশগ্রহণের দাবির সঙ্গে সবাই একমত হবে পারে। আমি মনে করে, এটি অভিন্ন স্বার্থ। সবার সমর্থন করা উচিৎ। আইন করে ধর্মভিত্তিক সংগঠনের অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করে দেবে -এর প্রতিবাদ সবারই করতে হবে। এটা অন্যায় ও অবিচার।

ইসলাম টাইমস : আইন করে ইসলামি ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করার দাবির প্রতিবাদ কী শুধু ছাত্র সংগঠনই করবে নাকি মূল দলেরও করা উচিৎ?

অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের : সবারই করা উচিৎ বলে মনে করি। মূল দল ও ছাত্র সংগঠন পরস্পরের সহযোগী। সুতরাং পরস্পরের স্বার্থ সংরক্ষণেও সহযোগী হতে হবে।

ইসলাম টাইমস : ক্যাম্পাস রাজনীতি ইসলামি ধারায় আপনি একজন সফল ছাত্রনেতা। ক্যাম্পাস রাজনীতিতে যারা সফল হতে চায় তাদের ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?

অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের : আমাদের সময়ের রাজনীতি এবং এখনকার রাজনীতির মধ্যে মৌলিক ও গুণগত অনেক পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমাদের সময়ে ক্যাম্পাস রাজনীতি ছিলো প্রধানত ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। কখনও কখনও বৃহত্তর জাতীয় ইস্যুতে তারা সক্রীয় হয়েছে। কিন্তু এখন ক্যাম্পাস রাজনীতি মূল দলের লেজুরবৃত্তি ছাড়া কিছু না। তারপরও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে ক্যাম্পাস রাজনীতির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

ক্যাম্পাস রাজনীতিতে যারা সফল হতে চায় তাদের ব্যাপারে আমার পরামর্শ থাকবে, ছাত্রদের সাধারণ দাবির প্রতি মনোযোগী হওয়া। ছাত্রদের দাবি ও অধিকার ছোট হোক আর বড় হোক -তা যদি আইনসিদ্ধ হয় তবে তার প্রতি সমর্থন জানানো। তা আদায়ের চেষ্টা করা। সাধারণ ছাত্রদের সমস্যা ও সংকটে যথাসাধ্য পাশে থাকার চেষ্টা করা। সর্বোপরি, সমগ্রিক চিন্তা থেকে রাজনীতি করা।

আরেকটি কথা মাথায় রাখতে হবে, দ্বীন প্রচারই ক্যাম্পাস রাজনীতির শেষকথা নয়। আদর্শ ও চেতনার চর্চা থাকবে তবে তা যদি একমাত্র কার্যক্রমে পরিণত হয় তবে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে সফল হওয়া যাবে না। ছাত্রদের অধিকার, দাবি, সংকট ও সমস্যা ক্যাম্পাস রাজনীতির প্রাণ। সুতরাং দলীয় কার্যক্রমে তার অন্তর্ভূক্তি যতো বেশি হবে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়া যাবে।

পূর্ববর্তি সংবাদধর্ষণ মামলার আসামিদের খুনি কে?
পরবর্তি সংবাদসিরিয়াকে আরবলিগে সদস্যপদ ফিরিয়ে দিতে রাশিয়ার সাথে সুর মেলাল তিউনিশিয়া