মানব পাচার রোধ করা যাচ্ছে না কেন? বিশিষ্ট দুই আলেম যা বললেন

আতাউর রহমান খসরু ।।

মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসন একটি বৈশ্বিক সংকটে রূপ নিয়েছে। এই সংকটের মুখোমুখি পৃথিবীর প্রায় সবদেশ। অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে মানুষ নানা উপায়ে উন্নত দেশগুলোতে যাচ্ছে। এতে একদিকে নাগরিকের জীবন ও সম্পদ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে, তেমনি সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃংখলা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

বাংলাদেশেও মানবপাচার ও অবৈধ অভিবাসন চরম সংকটে পরিণত হয়েছে। মানুষ উন্নত জীবনের আশায় ভিটে-মাটি বিক্রি করে বিদেশ যেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।

বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ মনে করেন, মানবপাচার সামাজিক অবক্ষয়ের নমুনা এবং তা নানা কারণে হয়। দারিদ্র্যতা, অর্থলোভ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের শৈতল্য এমন অনেক কারণ কাজ করে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সমাজ থেকে শিশুদের পাচার করা হয় দাস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের জন্য, নারীদের পতিতাবৃত্তির জন্য পাচার করা হচ্ছে। একটি দালাল চক্র আছে যারা অশিক্ষিত ও মূর্খ মানুষদের উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখায়। দেশে-বিদেশে বিশাল একটি চক্র এর পেছনে কাজ করছে। তাই জনগণ সচেতন না হলে শুধু সরকারের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

ড. খালিদ আরও মনে করেন, মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল-কলেজসহ সব সামাজিক প্রতিষ্ঠান যদি সচেতনতার পক্ষে কাজ করে, প্রশাসন যদি কঠোর হয়, অভিভাবকরা বুঝে-শুনে কাজ করেন তাহলেই কেবল অবৈধ মানব পাচার রোধ করা সম্ভব হবে

সিলেট জামিয়া কাসেমিয়া দরগাহ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আতাউল হক এর সঙ্গে সরকারের দায়কেও যুক্ত করেন। তিনি বলেন, সরকার এই দায় এড়াতে পারে না। সরকারের অনুমোদনের বাইরে কেউ এই ধরনের তৎপরতা চালাবে এটা সরকারের ব্যর্থতা। সরকার যাদের জনশক্তি রপ্তানির অনুমোদন দিচ্ছে অভিযোগ আছে তা দলীয় বিবেচনায় ও অর্থের বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে। শৃংখলার সব দায় সরকারের। সরকারের দায়িত্ববোধের অভাব আছে।

‘হজরত ওমর রা. বলেছিলেন, ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুর মারা গেলেও আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। সরকারের দায়ের পরিধি এই পর্যন্ত। এখন যদি সরকার বলে আমাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, তাহলে তাদের ক্ষমতায় থাকার অধিকারই নেই।’ যোগ করেন মাওলানা আতাউল হক।

কেন মানুষ আজ দেশের বাইরে যেতে মরিয়া –এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. খালিদ হোসাইন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, সুষ্ঠু জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণীত না হওয়া, অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত বিকাশ না হওয়া ইত্যাদির কারণে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ সেই অর্থে হয়নি। যার কারণে, আমাদের দেশ থেকে বিদেশে কাজের খোঁজে যাচ্ছে মানুষ। সমুদ্র ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই শুধু সীমান্ত পাহারা দিলে হবে না। কর্ম দিতে হবে মানুষকে।

অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া এবং দালাল ও পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ার পেছনে দেশের দারিদ্র্যতাকে দায়ি করলেও মাওলানা আতাউল হক এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন। তার দাবি হলো, আমাদের দেশকে যতোটা দরিদ্র বলা হয়, ততোটা দরিদ্র না। সম্পদ আছে তবে সম্পদের সুষ্ঠু ও সুষম বণ্টন নেই। অন্যায়ভাবে একশ্রেণির মানুষ দেশের সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছেন। দেশের পুঁজিবাদী ও সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা ধনীর সম্পদের সুরক্ষা দেয়, দরিদ্র-অসহায় মানুষের কোনো স্থান সেখানে নেই। মানুষ বিদেশ যাচ্ছে বঞ্ছনা থেকে।

অবশ্য তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, উচ্চাশা ও উচ্চ বিলাস থেকেও মানুষ দেশের বাইরে যাচ্ছে। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো ইউরোপ-আমেরিকা; বরং বিদেশকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যে সাধারণ মানুষ মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়েছে যায়। তারা হীনমন্যতায় ভোগে। তখন্ গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা মনে করে, বিদেশ যাওয়াই সম্মানের।

যারা জেনে বুঝে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন তাদের কী কোনো দায় নেই? ড. খালিদ বলেন, যারা যাচ্ছেন, তাদেরও দায় আছে। তবে অধিকাংশ যাচ্ছে বাধ্য হয়ে। হয়তো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়নি অথবা দেশে কোনো প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যার কারণে সে বিদেশ গিয়ে নিজের জীবন ও ভবিষ্যত নিরাপদ করতে চায়।

মাওলানা আতাউল হক এ ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা তুলে ধরে বলেন, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে ঠেলে দিও না। এজন্য ইসলাম আত্মহত্যাকে হারাম করেছেন। যেখানে ক্ষতি নিশ্চিত সেখানে যাওয়া হারাম। যেখানে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি সে কাজ থেকেও বিরত থাকতে হবে। সুতরাং এভাবে যাওয়া ইসলাম অনুমোদন করে না।

তিনি সাথে সাথে বৈধ পথে যারা যাচ্ছেন তাদের ব্যাপারেও বলেন, যারা জীবনের প্রয়োজনে বা দ্বীনি প্রয়োজনে বিদেশ যান সেটা দোষণীয় নয়। কিন্তু যারা অমুসলিম দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য যান তাদের ব্যাপারে বলবো বিনা প্রয়োজনে এমন না করাই উচিৎ। কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে সর্বোচ্চ দ্বিতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত পরিবারে ইসলাম থাকে। এরপর তারা ধর্মহীন হয়ে যায়। এটার দায় আগ থেকে চিন্তা করতে হবে। আমার কারণে আমার ভবিষ্যত প্রজন্ম ধর্মহীন হয়ে যাবে এর দায় আমি কীভাবে এড়াবো। তারা মসজিদে যাবে না, তারা মদ খাবে, ধর্মহীন হয়ে যাবে।

মানব পাচার ও অবৈধ পথে শ্রমিক পাঠানোর পেছনে বারবার সিন্ডিকেটের কথা উঠে আসে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার চাইলে কী এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভব নয়? ড. খালিদ মনে করেন, সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেওয়া সরকারের পক্ষে কঠিন কিছু না। রাষ্ট্র আন্তরিক হলে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেওয়া সময়ের ব্যাপার। আমাদের দেশের অপরাধ বিরোধী অভিযানে চুনোপুটি ধরা পড়ে। রাগব বোয়ালরা বেঁচে যায়।

যারা সিন্ডিকেট করে, অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠিয়ে ও মানব পাচার করে অর্থ উপার্জন করছে তাদের পরিণতি কী হবে? মাওলানা আতাউল হক তাদের পরিণতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যারা দেশের বাইরে মানুষ পাঠান তারা দুই ধরনের। এক. যাদের আন্তরিকতার অভাব থাকে না এবং অসৎ ইচ্ছেও থাকে না। কিন্তু পুরো ব্যবস্থা যেহেতু তার হাতে না তাই যেভাবে সে চায় তা হয় না। যেটা জানতো না এদেরকে দোষারোপ করা যাবে না।

কিছু সিন্ডিকেট আছে যাদের ভিত্তি হলো মিথ্যা ও প্রতারণা। তারা জেনে বুঝে মানুষের জীবন ও সম্পদকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। এদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যে প্রতারণা করে সে আমাদের (উম্মতে মুহাম্মাদি) অন্তর্ভূক্ত নয়।

তাদের সঙ্গে যে চুক্তি করা হয় সেই চুক্তি ভঙ্গ করা হয়। আর আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, ‘তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর’।

পরিশেষে অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন একটি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বৈধ পথে যেসব নারীদের পাঠানো হচ্ছে, তারাও নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। নারী শ্রমিক পাঠানো অবশ্যই দুঃখজনক। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন এখন নারী শ্রমিক প্রেরণ বন্ধ করেছে। অথচ আমরা নতুন করে নারী শ্রমিক পাঠাচ্ছি।

সাথে সাথে তিনি সরকারকে দুটি প্রস্তাব দেন। তাহলো, আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে সক্রিয় হতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে প্রবাসী ভাইদের অনেক অভিযোগ। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করতে হবে। দক্ষ শ্রমিকরা দেশের সুনাম ও অর্থ দুটোই আরও বেশি অর্জন করতে পারবে।

পূর্ববর্তি সংবাদমাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া রহ.-এর সহধর্মীনি গুরুতর অসুস্থ: দোয়া কামনা সবার কাছে
পরবর্তি সংবাদতেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত নেতাকর্মীরা মামলায় জর্জরিত : মির্জা ফখরুল