ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা কাসেম নানুতবি রহ.

আতাউর রহমান খসরু ।।

হজরত মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ.। পাক-ভারত উপমহাদেশের অন্যতম ইসলামি মনীষী। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার এবং দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই আলেম তার জীবনকে উম্মতের কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। উম্মতের যে সংকট যখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সেই সংকটের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছেন হজরত মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ.। তাই জীবনপাঠ করলে দেখা যায় তিনি একই সাথে একজন জ্ঞানসাধক, একজন দক্ষ পরিচালক ও সংগঠক, একজন সমাজ-সংস্কারক, একজন প্রাজ্ঞ লেখক আবার সম্মুখ সমরের একজন সাহসী সিপাহসালার।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিরলপ্রজ মনীষী হজরত কাসেম নানুতবি রহ. ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যুগ যুগ ধরে তার পরিবার ভারতবর্ষের ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও জিহাদ-সংগ্রামের সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন।

হজরত নানুতবি রহ.-এর জীবনী রচয়িতাদের দাবি হজরত নানুতবি রহ.-এর পূর্ব পুরুষগণ দিল্লির শাসক সেকেন্দার লোদির আহবানে ভারতবর্ষে আগমন করেন। তার পূর্বপুরুষ শায়খ মাজহারুদ্দিন সিদ্দিকির জ্ঞান-গরিমার কথা শুনে তাকে দিল্লিতে এসে বসবাসের আমন্ত্রণ জানান সেকেন্দার লোদি। পরবর্তীতে এই বংশে হজরত হজরত মাওলানা মুহাম্মদ মামলুক আলি রহ.-এর মতো জ্ঞানী, গুণী ও পণ্ডিতজনের জন্ম হয়। যার হাতে ভারতবর্ষের ইসলামি জ্ঞানচর্চা ও সংগ্রামের নতুন ধারার সূচনা হয়।

হজরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি রহ. দিল্লি ও সাহরানপুরের পার্শ্ববর্তী নানুতাহ নামক স্থানে শাওয়াল ১২৪৮ হিজরি মোতাবেক মার্চ ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ পরিবারেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। হজরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেমের কাছে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা (আরবি ও ফার্সি ভাষা) অর্জন করেন। এরপর হজরত কাসেম নানুতবি রহ. মাওলানা মাহতাব আলি দেওবন্দি ও মাওলানা মুহাম্মদ নেওয়াজ সাহরানপুরী রহ.-এর তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া করেন।

১২৬১ হিজরিতে দিল্লি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মদ মামলুক আলি রহ.-এর তত্ত্বাবধানে উচ্চতর লেখাপড়া শুরু করেন এবং অসামান্য মেধা ও ধী-শক্তির পরিচয় দেন। হজরত কাসেম নানুতবি রহ.-এর সহপাঠী মাওলানা ইয়াকুব নানুতবি রহ. বলেন, ‘মৌলভি সাহেবের গতি এতো বেশি ছিলো যে, তার সঙ্গে সমানতালে চলা কারো পক্ষে সম্ভব ছিলো না। মানতেকের কঠিন কঠিন কিতাব যেমন জাওয়াহেদ (মির জাহেদের রচনাবলী), কাজি (কাজি মুবারক রচিত কুতবির শরাহ), সদরা (সদরুদ্দিন সিরাজির রচনা), শামসে বাঝেগাহ এমনভাবে পড়তেন যেমন হাফেজরা সবক শোনায়।

কোনো প্রকার শিক্ষক ছাড়াই উচ্চতর গণিত শেখেন। ফিকহ, মানতিক, ইলমে কালামসহ অন্যান্য পাঠ্য বিষয়ে শিক্ষা সমাপ্তির পর হজরত শাহ আবদুল গনি মুজাদ্দেদি দেহলভি রহ.-এর কাছে সিহাহ সিত্তা (হাদিসশাস্ত্রের বিশুদ্ধ ছয় কিতাব)-এর পাঠগ্রহণ করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সাথে সাথে তিনি আত্মিক উন্নতির জন্য যুগের বিশিষ্ট বুজুর্গ হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.-এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন এবং তার কাছ থেকে খেলাফতও লাভ করেন। হজরত হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. তার এই মুরিদ ও শিষ্য বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। তার প্রতি উচ্চ ধারণাও পোষণ করতেন। তার রচনা ‘জিয়াউল কুলুব’ স্থান পাওয়া এক চিঠি থেকে এমনটিই ধারণা পাওয়া যায়। চিঠিটি তিনি হজরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি রহ.-এর পিতা শায়খ আসাদ আলি নানুতবি রহ.-কে লেখেন।

শিক্ষা সমাপনের পর তিনি শিক্ষকতা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি হজরত মাওলানা আহমদ আলি মুহাদ্দেসে সাহরানপুরি রহ. প্রতিষ্ঠিত মাতবায়ে আহমদি এবং মুনসি মুমতাজ আলি প্রতিষ্ঠিত মাতবায়ে মুজতাবায়িতেও কাজ করেন। তবে তিনি মাদরাসা থেকে কোনো অর্থগ্রহণ করতেন না।

হজরত কাসেম নানুতবি রহ. শিক্ষা জীবন শেষ করার কিছু দিনের মধ্যে ঐতিহাসিক সিপাহি বিপ্লব সংগঠিত হয়। এই বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু দিল্লি হলেও তার স্ফূলিং ছড়িয়ে পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রতিটি জনপদে। মূলত ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে মুসলমান ও সাধারণ মানুষের তীব্র ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছিলো ১৮৫৭ সনে। দিল্লির মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে কেন্দ্র করে এই বিদ্রোহ গড়ে উঠলেও এর প্রাণশক্তি ছিলো মুসলিম মুজাহিদ বাহিনী। ভারতীয় ইতিহাসে তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাসে অমর থাকবে।

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে সেনানায়কের ভূমিকা পালন করেন হজরত কাসেম নানুতবি রহ.-এর পীর হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.। তিনি থানাভবনে মুজাহিদ বাহিনীর একটি স্বতন্ত্র সেনা ছাউনিও গড়ে তোলেন। তার নেতৃত্বে তার খলিফা, শিষ্য ও মুজাহিদ বাহিনী ১৮৫৭-এর সিপাহি বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন। হজরত হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা হাফেজ মুহাম্মদ জামিন রহ. এই যুদ্ধে শহিদ হন।

হজরত কাসেম নানুতবি রহ. সিপাহি বিদ্রোহের সময় দিল্লির গোলন্দাজ বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। ব্রিটিশদের বাহিনীর আক্রমণ থেকে রাজধানী দিল্লিকে রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইংরেজ সেনা বাহিনীর বিভিন্ন দলিলেও তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার বিবরণ পাওয়া যায়। যদিও পরবর্তী সংঘবদ্ধ আক্রমণে –যেখানে শিখ ও হিন্দু রাজারা ইংরেজদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে- দিল্লি মুসলমানের হাতছাড়া হয়ে যায়।

১৮৫৭ সালের দিল্লির পতন হলে ভারতীয় মুসলমানের উপর চূড়ান্ত বিপর্যয় নেমে আসে। বিশেষত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আলেম-উলামার উপর খড়গহস্ত হয় ইংরেজ সরকার। লাখ লাখ আলেমকে নির্বিচারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এককথায় ভারতীয় উপমহাদেশে অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয় মুসলিম জাতি। ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতি ও তাহজিব-তামাদ্দুন রক্ষায় বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়।

জাতির এই সংকটকালে হজরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি রহ. ভারতীয় মুসলমানের জন্য এক অভিনব শিক্ষা পদ্ধতি এবং একটি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন আরও কয়েকজন পূন্যাত্মা মনীষী। তারা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একটি কালজয়ী নীতিমালা প্রণয়ন করেন। যা এই প্রতিষ্ঠানকে শুধু কালের বিপর্যয় কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করেনি; বরং যুগে যুগে কালের কালো ছায়া থেকে রক্ষা করেছে সর্বতভাবে।

দেশের বিশিষ্ট আলেম ও সিনিয়র সাংবাদিক মাওলানা লিয়াকত আলী মনে করেন, দারুল উলুম দেওবন্দের মতো একটি স্বতন্ত্র দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠাই হজরত কাসেম নানুতবি রহ.-এর শ্রেষ্ঠ অবদান। তার ভাষায়, যদিও হজরত কাসেম নানুতবি রহ. বহুমুখী খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং তার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই স্বাতন্ত্র তবুও আমি বলবো একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাই তার শ্রেষ্ঠ অবদান।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ১৮৫৭ সালের পর ভারতীয় মুসলমানের উপর যে চতুর্মুখী বিপর্যয় নেমে আসে তার থেকে মুসলিম সমাজ ও ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতিকে রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দারুল উলুম দেওবন্দ বা দেওবন্দি শিক্ষাধারা।

মাওলানা লিয়াকত আলী এরপরই হজরত কাসেম নানুতবি রহ.-এর বিপ্লবী জীবনকে সামনে আসতে চান। তিনি বলেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে হজরত কাসেম নানুতবি রহ. তার পীর হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.-এর নেতৃত্বে স্বশরীরে অংশগ্রহণ করেন এবং সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ এবং সাহসী ভূমিকা পালন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা, সেখানে তার পাঠদান, তার পরিচালনা; এমনকি রচনায়ও সেই বিপ্লবী চিন্তার চাপ পাওয়া যায়।

তিনি আরও মনে করেন, হরজত কাসেম নানুতবি রহ. সময় ও কালকে শুধু ধারণই করেননি; বরং তাকে আলোড়িত করেছেন দারুণভাবে। তাই তার পরবর্তী ভারতীয় উলামায়ে কেরামের ভেতর দীর্ঘকাল পর্যন্ত তার চিন্তাছাপ স্পষ্টতই খুঁজে পাওয়া যায়।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এই সিপাহসালার ও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা কাসেম নানুতবি রহ. ১৮৮০ সালের এই দিনে ইন্তেকাল করেন।

পূর্ববর্তি সংবাদযুক্তরাষ্ট্রে ১০ বছরে ৭১ শতাংশ সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে শ্বেতাঙ্গরা
পরবর্তি সংবাদআমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়: প্রধানমন্ত্রী