নির্বাচনের আগে মুসলিম পরিবার উচ্ছেদ করা হচ্ছে আসামে

নিজের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গৌহাটি হাসপাতালের করিডোরে আশ্রয় নিয়েছেন রামিসা, ছবি: আল জাজিরা

ইসলাম টাইমস ডেস্ক: ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের রাজধানী গৌহাটির একটি হাসপাতালে টানা পাঁচদিন ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ১১ মার্চ মারা গেলেন কুলসুমা বেগম। তার শাশুড়ি অভিযোগ করেন, পুলিশ আর আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা উচ্ছেদ অভিযানের সময় জোর করে ঘরে ঢুকে কুলসুমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কুলসুম এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়ার মাত্র দুই ঘন্টা পরে এই ঘটনা ঘটে। গৌহাটির ১৫০ কিলোমিটার পূর্বে মধ্য আসামের হোজাই জেলায় এই অভিযান চালানো হয়।

কারবি আংলং অটোনোমাস কাউন্সিল (কেএএসি) এলাকার কর্তৃপক্ষ ছয় শতাধিক মুসলিম পরিবারকে জোর করে হোজাই এলাকায় তাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারা বলছে সরকারি জমিতে বসত গড়েছে এরা। এই উচ্ছেদকৃতদের মধ্যে কুলসুমও একজন।

রামিসা খাতুন আল জাজিরাকে বলেন, “সাত থেকে আটজন পুলিশ ঘরে ঢুকে সবকিছু তছনছ করে। আমি যখন ফিরে আসি, তখন কুলসুম মেঝেতে পড়ে ছিল, কোন নড়াচড়া করছিল না”।

৫০ বছর বয়সী রামিসা বলেন, “আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিই। আমার ভয় হচ্ছিল, তাকেও হয়তো মেরে ফেলতে পারে ওরা”। কুলসুমকে যখন ঘর থেকে বের করে দেয়া হচ্ছিল, তখন মাথা ঘুরে পড়ে যায় সে।

২২ বছর বয়সী কুলসুমকে হোজাইয়ের স্থানীয় হাসপাতালে নেয়া হলে সেখান থেকে তাকে গৌহাটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ডাক্তাররা বলেন, সে মারাত্মক ‘মানসিক আঘাত’ পেয়েছে।

গৌহাটি হাসপাতালের করিডোরের এক কোনায় সদ্যজাত শিশুটি রামিসার পাশে ময়লা একটি কম্বলের উপর ঘুমাচ্ছে। শিশুটিকে এখন পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।

এফআইআর দাখিল

জনগণের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পর, আনুষ্ঠানিকভাবে কেএএসি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।

হোজাই ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) তন্ময় বোর্গোহাইন আল জাজিরাকে বলেন, “মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে”।

কেএএসি’র মুখ্য নির্বাহী সদস্য এবং আসামের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা তুলিরাম রংহাং অভিযোগ করেছেন যে, কাগজপত্র ছাড়া বাংলাদেশী অভিবাসীরা এখানে জমি দখল করে আছে, যে জমিগুলো আসলে কারবি আংলংদের।

তবে, উচ্ছেদকৃতা রোংহাংদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তারা ভারতের আসল নাগরিক। কিছু মানবাধিকার কর্মী এই পুরো অভিযানের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেছেন সার্কেবাস্তি গ্রাম হোজাই জেলার অধীনে পড়েছে, কেএএসি’র কর্তৃত্বের অধীনে নয়।

কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির হোজাই জেলা কমিটির প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান আল জাজিরাকে বলেন, “কারবি আংলং জেলার কোন আইনগত অধিকার নেই এই মানুষদের উচ্ছেদ করার”।

আসামের মুখ্য সচিবের কাছে পাঠানো এক শীর্ষ হোজাই কর্মকর্তার চিঠিতেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি লিখিত ওই চিঠিতে বিদেশী কর্তৃক জমি দখলের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে এ ধরনের অভিযানের ব্যাপারে সতর্কতা উচ্চারণ করা হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ এবং আইনি প্রচেষ্টার পরও কারবি আংলং প্রশাসন তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে এবং আগামী এপ্রিল-মে’তে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের আগ দিয়ে কয়েকশ’ পরিবারকে বাস্তচ্যুত করেছে।

গৌহাটির একটি আদালত শেষ পর্যন্ত এই উচ্ছেদ বন্ধের নির্দেশ দিয়ে হোজাই ও কারবি আংলং প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে, যাতে তারা তাদের সীমান্ত বিবাদ আগে নিস্পত্তি করে।

উচ্ছেদ অভিযান

বিজেপি সরকারের আমলে আসামে এই উচ্ছেদ অভিযানের মাত্রা বেড়ে গেছে। ২০১৬ সালে অভিবাসী বিরোধী শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসে দলটি।

আসামের ক্ষমতায় আসার ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তারা বিখ্যাত কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্কের কাছে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। ‘অবৈধ বসতি’ গড়ার অভিযোগ তুলে ওই অভিযান চালিয়েছিল তারা।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার আসামের অ্যাসেম্বলিতে জানায় যে, ১৩টি জেলা থেকে প্রায় ৩,৪৮১ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগ মুসলিম হলেও অন্যান্য সংখ্যালঘু উপজাতীয় মানুষেরাও এর মধ্যে রয়েছে।

তবে, সরকারি রেকর্ডে দেখা গেছে শত শত মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, যেগুলো বৈধভাবেই তাদের অধিকারে ছিল।

আসামের লুমডিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ বেজবারুয়াহ বলেন, যাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তারা হয় বন্যা কবলিত এলাকা থেকে আসা ইন্টার্নালি ডিসপ্লেসড পার্সনস (আইডিপি), সঙ্ঘাত-কবলিত বোরোল্যান্ড জেলাগুলো থেকে আসা আইডিপি, অথবা আদিবাসী কাচারি মুসলিম জণগোষ্ঠি, যারা সত্তরের দশক থেকে ওই এলাকায় বাস করে আসছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, জাতিগত দাঙ্গা এবং আসামের বন্যার কারণে এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি আইডিপি জড়ো হয়েছে। ২০১৫ সালে, আসামের আইডিপি’র সংখ্যা ছিল পুরো দেশের আইডিপি’র ৭৪.৪ শতাংশ।

মুসলিম আইডিপি

কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্ক্সিস্ট (সিপিএম)-এর নেতা সুপ্রকাশ তালুকদার অভিযোগ করেছেন যে, ১৯৬৫ সালের পর থেকে কোন ধরনের ভূমি জরিপ চালায়নি আসাম সরকার। সে কারণে ভূমিহীনরা এখনও অসহায় রয়ে গেছে এবং তাদেরকে জোর করে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

আসামের রাজস্ব ও বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ভবেশ কালিতা বলেছেন, নদী ভাঙনের কারণে যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছে, তাদেরকে পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছে তাদের সরকার।

কালিতা বলেন, “নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারাদের পুনর্বাসনের জন্য আমাদের নীতি রয়েছে। যাদের জমির কাগজপত্র রয়েছে, তারাই কেবল এই সুবিধা পাবেন। আমরা তাদের পুনর্বাসন করছি”।

“এ বছর এক লাখ মানুষকে জমির কাগজপত্র দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে আমাদের সরকার। এ যাবত কোন সরকারই এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি”।

গৌহাটি-ভিত্তিক মানবাধিকার কর্মী হাফিজ আহমেদ বলেন, আসামের মুসলিম আইডিপিরা অতিরিক্ত ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই সূত্রে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হতে পারে।

আহমেদ অভিযোগ করেন যে, মুসলিমদের একঘরে করার জন্য সরকার একটা মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাব গড়ে তুলেছে।

জাতীয় নির্বাচনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষকে পুঁজি করে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত তারা এই ঘৃণা বিদ্বেষ জিইয়ে রাখতে চায়”।

আসামের মন্ত্রী কালিতা অবশ্য নির্দিষ্ট একটি গ্রুপকে লক্ষ্য করে এই ধরনের অভিযোগ নাকচ করে দেন।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “বর্ণ, জাত বা ধর্মের ভিত্তিতে উচ্ছেদ নীতিতে কোন বৈষম্য রাখা হয়নি”।

গৌহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী সাইয়েদ বুরহানুর রহমান বলেন, উচ্ছেদের ফলে ঘর বাড়ি হারা মুসলিমদের রাজ্যহীন ঘোষণা করার ঝুঁকি রয়েছে।

গত জুলাই মাসে প্রায় চার মিলিয়ন মানুষ যাদের অধিকাংশই মুসলিম – তাদেরকে খসড়া নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয় এবং এর মাধ্যমে কার্যকরভাবে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়া হয়।

সূত্র : আল জাজিরা

পূর্ববর্তি সংবাদযুদ্ধে ইয়েমেনের ৩৩ লাখ মানুষ ঘরহারা : ফেইম
পরবর্তি সংবাদগোলান মালভূমি : ট্রাম্পের স্বীকৃতি ইসরাইলের উপকারে আসবে তো?