শত বছরেও মুছেনি যে হত্যাকাণ্ডের দাগ

আতাউর রহমান খসরু ।।

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তখন তুমুলে। ব্রিটিশ দুঃশাসন, ভারতীয় ও ভারতবর্ষের সম্পদ লুট, সাধারণ নাগরিকের উপর অমানবিক অত্যাচারের সাথে যোগ হয়েছে নতুন প্রতারণা ও বঞ্ছনার অভিযোগ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দেওয়া হবে -এমন আশ্বাসে ব্রিটিশের পক্ষে প্রথমযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ১০ লাখ ভারতীয় নাগরিক। যাদের মধ্যে ৬০ হাজার নিহত এবং আহত হয় লক্ষাধিক সেনা। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তীতে স্বাধীনতা প্রশ্নে শুরু হয় ব্রিটিশদের নানান তালবাহানা। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ১০ লাখ ভারতীয়কে চাকরিচ্যূত করা হয়। আহতদেরও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি তখনও।

ব্রিটিশদের প্রতারণার মুখে আবারও আন্দোলনে নামেন ভারতের স্বাধীনতাকামী নেতারা। আন্দোলন দমাতে গ্রেফতার করা হয় সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা সাইফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপালকে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষ।

Image result for saifuddin kitchlew
ভারতীয় ডাক টিকিটে সাইফুদ্দিন কিচলু

কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত মুসলিম নেতা সাইফুদ্দিন কিচলু ছিলেন পাঞ্জাব কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তীতে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্বপালন করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম ও জার্মানি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী।

শাসনের নামে শোষণ ছাড়াও পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষ ব্রিটিশদের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন আরেকটি কারণে। তাহলো, পাঞ্জাবে খ্রিস্টান মিশনারির তৎপরতা। শিখ ধর্মের তীর্থভূমিতে অন্যধর্মের প্রচারের কারণে শিখরা এবং সাধারণ মুসলিমরাও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মিশনারি তৎপরতায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলো। এতে পাঞ্জাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম দৃড় ঐক্য গড়ে ওঠে।

ক্রমবর্ধমান আন্দোলন দমনের জন্য ১৯১৯ সালে কুখ্যাত ‘রোলেট অ্যাক্ট’ পাস করে ব্রিটিশ সরকার। যার অধীনে সন্দেহভাজন যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া হয় ব্রিটিশ বাহিনীকে। ভারতীয় কংগ্রেস এই আইনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। একই আইন পাশের প্রতিবাদে মুসলিম লিগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতীয় পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেন।

ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালগুলো

চলমান আন্দোলনের মধ্যে ১০ এপ্রিল পাঞ্জাবে আন্দোলনরত জনতার উপর গুলি নির্বিচারে গুলি চালায় ব্রিটিশ বাহিনী। এই সময় কয়েকজন ভারতীয় নিহত হন। ভারতীয় নিহত হওয়ার ঘটনার পর পাঞ্জাবে কয়েকটি ব্রিটিশ স্থাপনার উপর হামলা হয়। হামলায় একজন নারী যাজকসহ কয়েকজন ইউরোপীয় নিহত হয়। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষ ও ব্রিটিশ বাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। বিক্ষিপ্তভাবে একপক্ষ অপরপক্ষের উপর হামলা চালাতে থাকে।

১৩ এপ্রিল পরিত্যাক্ত পাবলিক পার্ক (মোগল আমলে নির্মিত) জালিয়ানওয়ালা বাগে পাঞ্জাবের দুই নেতার মুক্তির দাবিতে সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। অন্যদিকে এই সমাবেশ পণ্ড করতে ১২ এপ্রিল রাত ২টার পর অমৃতসরে কারফিউ জারি এবং সবধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও অমৃতসরের সেনা কর্মকর্তা মাইকেল রেগনল্ড ডায়ার। যা অধিকাংশ মানুষের কাছে পৌঁছায় না।

মানুষ কারফিউ ও নিষেধাজ্ঞার কথা জেনে বা না জেনেই জালিয়ানওয়ালাবাগে উপস্থিত হয় এবং ব্রিটিশ বাহিনীর হামলা, মামলা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাতে থাকে। দুপুর ১২টায় জেনারেল ডায়ার সমাবেশের সংবাদ পান এবং ১টা ৩০ মিনিটে তিনি গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। টানা ১০-১৫ মিনিট গুলিবর্ষণ অত্যাহত থাকে।

১০ ফিট উঁচু দেয়াল ঘেরা ৭ একর আয়তনের জালিয়ানওয়ালা বাগে সেদিন ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলো। জালিয়ানওয়ালা বাগের ৫টি প্রবেশপথের প্রত্যেকটিতে ৫০জন সৈনিক দাঁড় করানো হয়। গুলিবর্ষণের ঘটনায় ১৫০০ ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যু হয়। আহত অনেককে কূপে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। শুধু বাগের কূপ থেকে ১২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর লাশও ছিলো। এই ঘটনায় আরও ১১০০ জন আহত এবং ১৯২ জন পঙ্গুত্ব বরণ করেন।

কূপে ফেলে হত্যা করা হয় আহতদের

জেনারেল ডায়ারের ভাষ্য মতে, বিদ্রোহ দমন ও পাঞ্জাবিদের মনে ভয় সৃষ্টির জন্য হত্যাকাণ্ড নির্দেশ দেন তিনি।

১৪ এপ্রিল ডায়ার তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ১৩ এপ্রিল ১০০ জন গুর্খা সৈন্য আর ২টি সাজোয়া গাড়ি নিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগে ২০০০-এর মত ‘বিদ্রোহীকে’ হতাহত করা হয়েছে। আর এতে খরচ হয়েছিল ১৬৫০ রাউণ্ড গুলি। নিহতরা প্রধানত শিখ, মুসলিম ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

অবশ্য জেনারেল ডায়ারকে এই হত্যাকাণ্ডের পরিণতিও ভোগ করতে হয়েছিলো। ১৩ মার্চ ১৯৪০ সালে ডায়ারকে নিজ বাড়িতে হত্যা করেন ভারতীয় নাগরিক উত্তম সিংহ। যদিও পরবর্তীতে তাকে এই অপরাধে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে জেনারেল ডায়ারকে জাতীয় বীর ঘোষণা করে এবং তার পদোন্নতি দিয়ে পাঞ্জাবের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। যদিও ভারতীয়দের আন্দোলন ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রতিবাদে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বরং তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়।

জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের একশো বছর পূর্ণ হলেও এই নৃশংস গণহত্যার জন্য এখনও ক্ষমা চায়নি ব্রিটেন। রাণী এলিজাবেথ ১৯৯৭ ভারত সফরে এই ঘটনাকে ‘দুশ্চিন্তার নিদর্শন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। সচেতনভাবে দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান। তার মন্তব্যের কারণে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।

ইতিহাসের খলনায়ক ডায়ার

গত ১৩ এপ্রিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ১৯১৯ সালে সংঘটিত জালিয়ানওয়ালা বাগ ট্রাজেডি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ইতিহাসে একটি লজ্জাজনক ক্ষত। আমরা যা হয়েছিলো তার জন্য গভীরভাবে ব্যথিত।

হত্যাকাণ্ডের পর ১৯২০ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগের স্মৃতি সংরক্ষণে ট্রাস্ট গঠিত হয়। ট্রাস্টের উদ্যোগে ১৯৬৩ সালে সেখানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মিত হয়।

নিকৃষ্টতম বৃটিশ গণহত্যার একটি জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড। ব্রিটিশ অপশাসনের ও নৃশংসতার প্রমাণ এই হত্যাকাণ্ড। পাঞ্জাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দমন করতে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হলেও তার ফল হয় উল্টো। ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনকে চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে দেয় এই হত্যাকাণ্ড। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দ্বিগুণ মাত্রা লাভ করে জালিয়ানওয়ালা বাগ ট্রাজেডির পর। এর ২৭ বছরের মাথায় ভারত ছাড়তে বাধ্য হয় উপনিবেশিক ব্রিটেন।

সূত্র : উইকিপিডিয়া, রোর বাংলা, টিআরটি ওয়ার্ল্ড, হিস্টোরি টুডে ও দ্য গার্ডিয়ান

নিহতদের স্মরণে নির্মিত সৌধ
পূর্ববর্তি সংবাদরাজশাহীতে ধর্ষণ চেষ্টায় বরখাস্ত অধ্যক্ষ শোডাউন করে ক্যাম্পাসে ফিরে
পরবর্তি সংবাদট্রাম্প আল কায়দার বড় ভাই: তুলসি গাবার্ড