মানবতার জীবন্ত ছবি

মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নোমানী রহ. ।।

৪২-৪৩ বছর আগের কথা। সম্ভবত ১৯২৮ সাল। আমি তখন আমরুহাতে অধ্যাপনা করি। একটি জরুরি কাজে দেওবন্দ যেতে হয়েছিল। তখন ছিল শীতকাল। খুব ঠান্ডা পড়েছিল। সেদিন বিকালের ট্রেনেই ফিরে আসার কথা ছিল আমার। তাই রাতে থাকার মতো গরম কাপড়-বিছানা বা কম্বল কিছুই সঙ্গে নেইনি। কাজ সেরে আমি গাজীয়াবাদের ট্রেনে উঠি। গাজীয়াবাদ থেকে আমরুহাগামী ট্রেন ছাড়ে। কিন্তু একটি সমস্যা হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে সেদিন গাজীয়াবাদের ট্রেনটি এসেছিল একটু দেরিতে। সন্ধ্যায় আমি গাজীয়াবাদ পৌঁছে জানতে পারলাম আমরুহাগামী ট্রেন চলে গেছে! পরের ট্রেন রাত এগারোটায়।

এগারোটা বাজতে অনেক দেরি, কী করি? প্লাটফর্মের একটি বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর এশার নামায পড়ে ঐ বেঞ্চে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। ঘুমানোর ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কখন যে চোখ লেগে এল। …হঠাৎ কারো আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল, দেখি স্টেশনের এক কর্মচারি আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, কোথায় যাবেন মিয়াসাব? বললাম, আমরুহা যাব। ওহ্হো! এই মাত্রই তো আমরুহার ট্রেন চলে গেল, পরবর্তী ট্রেন সকালে। আপনি এক কাজ করুন, স্টেশনের মুসাফিরখানায় চলে যান।

আমি মুসাফিরখানায় চলে এলাম। রাত বাজে তখন এগারোটা। ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই খুব ঠান্ডা লাগছিল। এদিকে এখনো অনেক রাত বাকি। সেখানে একটি বেঞ্চ দেখতে পেলাম। সেটাতে গিয়ে কখনো বসছিলাম। আবার বেশি ঠান্ডা লাগলে উঠে পায়চারি করছিলাম। সে-সময় গাজীয়াবাদ স্টেশনে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দোকানদারও দোকান বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিল। আমি কিছুক্ষণ পরপর গিয়ে তাকে খোশামোদ করে জাগিয়ে চা খাচ্ছিলাম।

ঠান্ডার এই কষ্ট ছাড়াও একটি মানসিক কষ্ট হচ্ছিল। আমার সাথে সফরের কোনো সামান না থাকায় মুসাফিরখানার অন্যান্য যাত্রীরা আমাকে সন্দেহের চোখে দেখছিল। নিজেদের মালসামানের চিন্তায় তারা ঘুমাতে পারছিল না। কিছু বলে যে তাদের আশ্বস্ত করব-তাও পারছিলাম না। মনে পড়ে, খুব বিব্রত হয়েছিলাম ব্যাপারটাতে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। একদিকে ঠান্ডা অন্যদিকে এই মানসিক চাপ-কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ অবস্থায়ই রাত কাটছিল। কখনো বেঞ্চিতে গিয়ে বসছিলাম। কখনো পায়চারি করছিলাম। কখনো দোকানে গিয়ে চা খাচ্ছিলাম। এমনি করেই রাত আড়াইটা বাজল।

একটু পর সম্ভবত দেরাদুন থেকে একটি ট্রেন এল। ট্রেন থেকে দু’তিনজন যাত্রী মুসাফিরখানায় এসেছিল। তারা বিছানা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে একটি শিখ কিশোর ছিল। বয়স পনেরো-ষোলো হবে। মনে হচ্ছিল বিত্তবান ঘরের ছেলে। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আসার কারণে ওর বিছানাটা ছিল বেশ বড়। বিছানা খুলে ছেলেটি তাতে বসল। আমি তখন বেঞ্চে বসে ছিলাম। ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে দুধ পাওয়া যাবে কোথাও? বললাম, এই সামনে একটি চায়ের দোকান আছে, তাতে পাবে। ‘আপনি একটু আমার বিছানাটা দেখুন, আমি দুধ নিয়ে আসি, আমি রাতের খাবার খাইনি।’ ছেলেটি দুধ নিয়ে এল। ভদ্রতার খাতিরে আমাকেও সাধল। আমি না করে দিলাম। দুধ খেয়ে ও শুয়ে পড়ল। আমি খেয়াল করলাম, এ বেচারাও আড়চোখে বারবার আমাকে দেখছে। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল; এ-ও আমার কারণে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে না।

কয়েক মিনিট পর ও উঠে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, এই ঠান্ডার মাঝে আপনি এখানে এভাবে কেন বসে আছেন, কম্বল বা চাদর-টাদর কিছু নেই আপনার কাছে? ‘বাবা, তুমি আরাম করো। আসলে রাত নয়টার আগেই আমার আমরুহা পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল, তাই সঙ্গে কিছু আনিনি। ঘটনাক্রমে ট্রেন ছুটে গেছে, সকাল ছাড়া আর কোনো ট্রেন নেই।’ এ কথা শুনে ও তাড়াতাড়ি গিয়ে ওর বিছানা থেকে দুটো কম্বল বের করল। একটি কম্বল বিছাল, আরেকটি গায়ে দেওয়ার জন্য রেখে আমাকে বলল, আমি এখানে শুয়ে পড়ছি, আপনি আমার বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি সঙ্কোচে না করলাম। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, শুতেই হবে। আমি বললাম, আচ্ছা, তাহলে অন্তত তুমি তোমার বিছানায় শোও, আমি এখানে শুচ্ছি। ‘না, না, আপনাকে আমার বিছানায়ই শুতে হবে।’ কিন্তু আমার লজ্জা লাগছিল। আমার সঙ্কোচ দেখে ও বলল, আপনি যদি আমার বিছানায় না শোন তাহলে আমি সকাল পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। অগত্যা আমি ওর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বিছানাটি ছিল বেশ আরামদায়ক, দামি আর উন্নত। ছেলেটির এই সৌজন্যবোধে এতটা অভিভূত হলাম যে, চোখে পানি এসে গেল। ও একটু পর ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আমি ঘুমুতে পারলাম না। ওর আচরণ মনে এমন রেখাপাত করেছিল যে, সারা রাত আর আমার চোখে ঘুম এল না।

সকালে আমাদের দুজনের ট্রেন একসাথেই এল। আমরা একে অপর থেকে বিদায় নিয়ে নিজ নিজ ট্রেনে উঠলাম। ওর ব্যবহারে আমি তখন এমনই আচ্ছন্ন ছিলাম যে, ঠিকানা রাখার কথাও মনে আসেনি। ঠিকানা না থাকায় পরবর্তীতে আর ওর সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। এখন মনে হলে খুব খারাপ লাগে। জানি না এখন ও কোথায় আছে, কেমন আছে। এ ঘটনা মনে পড়লে ৪৩ বছর আগের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠে। অজান্তে চোখের কোণে অশ্রু জমে। মন থেকে ওর জন্য দুআ আসে। জীবনে যদি আর একবার ওর সাথে দেখা হত, আর আমি ওর জন্য কিছু করতে পারতাম! কিন্তু কত আশা বুকে নিয়ে মানুষকে কবরে চলে যেতে হয়…!

অনুবাদ: আবু মুহাম্মাদ

পূর্ববর্তি সংবাদশ্রীলঙ্কায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩০০ ছুঁই ছুঁই
পরবর্তি সংবাদনারায়ণগঞ্জে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত ২, আহত ৪