বিশেষ প্রতিবেদক, ইসলাম টাইমস: দেশের প্রান্তিক এলাকা ও আঞ্চলিক শহর হওয়ায় নেত্রকোণাকে কাদিয়ানি, খ্রিস্টান মিশনারি, হেযবুত তাওহীদসহ অন্য ভ্রান্ত দলগুলোও প্রচারক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। ভুল বুঝিয়ে এবং অর্থ ও বিভিন্ন পদের লোভ দেখিয়ে এখানে তুলনামূলক অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ঈমান হরণের তৎপরতা চলছে নানান দিক থেকে। এর মধ্যে কাদিয়ানিদের তৎপরতা নিয়ে স্থানীয় মুসলমানদের মাঝে তৈরি হয়েছেে গভীর উদ্বেগ। সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নেত্রকোণায় কাদিয়ানিদের তৎপরতার বিভিন্ন হালহকিকত।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অতি সম্প্রতি সদর থানাসহ মোহনগঞ্জ, দুর্গাপুরে কাদিয়ানিরা প্রকাশ্যে বেশ জোরের সাথেই তাদের প্রচারণা চালাচ্ছে। স্থানীয় অনেক সাধারণ লোককে তাদের প্রধান কেন্দ্র বকশিবাজারে নিয়ে যাওয়াসহ এলাকায় বিভিন্ন প্রোগ্রাম তারা প্রকাশ্যে-গোপনে করে যাচ্ছে। এমনকি একটি বাহিনীর এক কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় সদর থানার উত্তর সাতপাই এলাকায় জায়গা কিনে তাদের পৃথক উপাসনাগৃহ বানিয়ে নিয়েছে। অবশ্য স্থানীয় আলেমদের প্রতিরোধ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় কাদিয়ানিদের প্রকাশ্য কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে।
নেত্রকোণায় কাদিয়ানি কার্যক্রমের সূচনা ও ক্রম বিস্তার সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, সাতপাই এলাকার বাসিন্দা সৌদি প্রবাসী নির্মাণ-শ্রমিক আব্দুল মজিদ সৌদি থাকাকালে সে দেশে ঘাপটি মেরে থাকা কোনো কোনো কাদিয়ানির প্রচারণায় প্রলুব্ধ ও প্রতারিত হয়ে ১৯৮২ নেত্রকোণা থেকে সর্বপ্রথম কাদিয়ানি মতে দীক্ষিত হয়। পরবর্তীতে দেশে ফিরে নিজের পরিবারকে কাদিয়ানি করে তোলে। ১৯৯২ সাল নাগাদ ঢাকার বকশিবাজার থেকে একজন কাদিয়ানি মুআল্লিম পাঠানো হয় নবদীক্ষিত কাদিয়ানিদের ‘তালিম’ প্রদান ও এলাকায় প্রচারকাজ চালানোর জন্য।
প্রসঙ্গত, কাদিয়ানিরা হজরত মুহাম্মদ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে শেষ নবী হিসেবে মানে না। কাদিয়ানিদের ধর্মবিশ্বাস হলো, পাঞ্জাবের মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানিকে নবী মানতে হবে। কাদিয়ানিরা মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানিকে নবী হিসেবে মান্য করে। এর সঙ্গে তারা আরও দাবি করে, মির্জা কাদিয়ানি হচ্ছে মাহদি এবং ঈসা।( নাউযুবিল্লাহ)। কাদিয়ানিদের বিশ্বাস ইসলামের মৌলিক ও শাশ্বত বিশ্বাসের বিরোধী হওয়ায় সব দেশের সব মতপথের আলেমদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তারা কাফের- অমুসলিম। তবে তারা নিজেদের ‘আহমদিয়া মুসলিম জামাত’ নামে পরিচয় দিয়ে থাকে।
জানা যায়, নেত্রকোণায় কাদিয়ানিদের প্রচার কাজ গোপনেই চলছিল। অর্থ ও পদের লোভ দেখিয়ে নানাজনকে কাদিয়ানি মতে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছিল। একদিন তোহা হোসেন নামে সাতপাই এলাকার একজনকে দাওয়াত দিতে গেলে গোল বাঁধে। সব খবর ফাঁস হয়ে যায়। এ ঘটনার পর স্থানীয় আলেমরা প্রতিবাদ করেন। নবদীক্ষিত কাদিয়ানিদের দাওয়াত দিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। বাহ্যত সবাই তওবা করে মসজিদে আসতে শুরু করেছিল তখন।
কিন্তু ২০০২ সালে আবার তারা সরব হয়। আবারো কাজ অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যায়। দাওয়াত দিয়ে দিয়ে লোক সংখ্যা বাড়াতে থাকে। আলেমগণ খোঁজ পেয়ে প্রতিবাদ করলে প্রকাশ্যে কাজ করা বন্ধ রাখে আরো কিছুদিন।
বকশিবাজারের কাদিয়ানিদের কেন্দ্রের সহায়তায় ২০১০ সালে আবারো তৎপর হয় কাদিয়ানীরা। নেত্রকোণার কাদিয়ানি প্রসিডেন্ট ( তাদের পরিভাষা) আব্দুল মজিদ নিজ বাড়িতে সেখানকার সকল কাদিয়ানির জন্য পৃথক উপসনাগৃহ তৈরি করে। আবারো আলেমরা দাওয়াতি আন্দোলন শুরু করলে কিছুদিন বন্ধ থাকে তাদের কার্যক্রম।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০১৮ সাল থেকে তারা উঠে পরে লাগে তাদের অনুসৃত ভণ্ড নবীর অনুসারী বানানোর কাজে। একটি বাহিনরি কর্মকর্তার প্রভাব ও মধ্যস্ততায় উপাসনাগৃহের জন্য জায়গা ক্রয় করে। কাদিয়ানি সেই কর্মকর্তা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে থাকে সাতপাই এলাকায়। স্থানীয় আলেমরা যখন খোঁজ পেয়ে প্রতিবাদ করতে যান ততদিনে ওই কর্মকর্তার নামে কেনা জায়গায় ঘর তুলে উপাসনাগৃহ হিসেবে উদ্বোধন করার পরিকল্পনা করা হয়ে গেছে।
তাৎক্ষণিকভাবে আলেমরা উপাসনাগৃহ বন্ধ করার জন্য প্রশাসন বরাবর স্মারকলিপি দেন। শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় প্রশাসন কাদিয়ানিদের উপাসনাগৃহে তালা লাগিয়ে দিয়ে যায়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনসাধরণের প্রবেশ নিষেধ করে দেওয়া হয়।
![](https://islamtime24.com/wp-content/uploads/2019/05/কাদিয়ানী-300x199.jpg)
নেত্রকোণা সদর থানার উত্তর সাতপাই এলাকার বাসিন্দা তরুণ আলেম মাওলানা তাকী প্রতিবেদককে এসব তথ্য জানান। কাদিয়ানিদের সর্বশেষ উপসনাগৃহের কার্যক্রম বন্ধ করার চেষ্টার সময় তিনি কাছ থেকে আলেমদের প্রতিবাদী প্রযাস দেখেছেন।
মাওলানা তাকী বলেন, “৯২ সালে যখন প্রথমবারের মতো কাদিয়ানিদের প্রচারকাজেরর খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল তখন থেকে এদিকে সজাগ সতর্ক দৃষ্টি রাখলে ওদের কার্যক্রম এত অগ্রসর হতো না। এখন থেকে এলাকায় কাদিয়ানিদের বিষয়ে সচেতনতামূলক নিয়মিত দাওয়াতি কাজ হবে বলে আলেমরা সিদ্ধান্ত করেছেন ।
উত্তর সাতপাই এলাকার বাসিন্দা, নেত্রকোণার এক মাদরাসার মুহাদ্দিস প্রবীণ আলেম মাওলানা এমদাদুল হকের সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি বলেন, “এটা দুঃখজনক ঘটনা। ভয়াবহ ফিৎনা। অনেকবার দাওয়াত দেওয়ার পরও ওরা ফিরে আসেনি। আমাদের অগোচরে ওরা অনেক কাজ করে ফেলেছে। আমাদের আরো সতর্ক থাকা দরকার ছিল”।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাদিয়ানিদের কার্যক্রম শুধু নেত্রকোণার সদর থানায়ই সীমাবদ্ধ নয়। বরং মোহনগঞ্জ, মদন ও দুর্গাপুরের মতো অনগ্রসর এলাকাগুলোতে ওরা জোরদার প্রচারণা চালাচ্ছে। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে। ওরা নতুনদের মাঝে তাদের দাওয়াতি কাজ করে কৌশলে ও ভুল বুঝিয়ে। কখনো বলে, মির্জা কাদিয়ানি মাহদি, কখনো বলে, ঈসা। মির্জার নবী দাবির কথাটা প্রথম পর্যায়ে তারা বলতে চায় না।
কাদিয়ানি বিষয়ে দাঈ আলেমরা বলেন, নেত্রকোণার মতো দেশের অন্য প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে সমান হারে চলছে কাদিয়ানিদের প্রচার-তৎপরতা। নানা ছল চাতুরির আশ্রয় নিয়ে, ইসলামের নাম ব্যবহার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে গরীব-দুঃখীদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করে দীক্ষিত করা হচ্ছে কাদিয়ানি ধর্মমতে। পঞ্চগড়ের ঘটনায় দেশব্যাপী যে গণ-সচেতনতা তৈরি হয়েছে তা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র থেকে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা আদায় করে নেওয়া উচিৎ বলে আলেমরা মত দেন।
তবে একই সঙ্গে, শুধু মাঠের আন্দোলনের উপর নির্ভর না করে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দাওয়াতি কার্যক্রমের ব্যপকতা এবং কাদিয়ানিদের ঈমান হরণমূলক প্রতিটি বিশ্বাস ও বক্তব্য স্পষ্ট করে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে কাদিয়ানি সংকটের মোকাবেলা করা কর্তব্য বলে মনে করেন দেশের বিজ্ঞ আলেমগণ।
![](https://www.islamtime24.com/wp-content/uploads/2021/03/20210308_200803-scaled.jpg)