উরওয়া ইবনে যুবাইর রহ.: ইলম ও আমলের মোহনা-মনীষী

উরওয়া ইবনে যুবায়ের রহ.-এর বাড়ির পুরনো কাঠামো

আবদুর রহমান তাশরীফ ।।

হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর রহ.। শীর্ষস্থানীয় ইসলামি মনীষী। বিখ্যাত তাবেয়ী-ফকীহ ও মুহাদ্দিস। সপ্তরত্ন খ্যাত মদীনার সাত ফকীহের অন্যতম। বরেণ্য পণ্ডিত। ইসলামের সোনালী যুগে উমর ও উসমান রাযি.- এর খেলাফাতের মাঝামাঝি সময়ে ইলম, আমল, আখলাক এবং দ্বীনী বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার অধিকারী আদর্শস্থানীয় এক সাহাবি পরিবারে তাঁর জন্ম।

ঈমানের রঙে রঙিন পরিবেশে চোখ খোলেন। ইলম ও আমলের কোলে বেড়ে ওঠেন। তার ধমনীতে বহমান ছিল রাসূলের হাওয়ারী যুবাইর ইবনুল আওয়াম এবং পরম বন্ধু আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর কন্যা আসমা রাযি.-এর রক্তের ধারা। তাঁর খালা হওয়ার সুবাদে উম্মুল মু’মিনিন আয়েশা রাযিঃ থেকে বর্ণিত প্রায় সকল হাদীস তিনি শোনার সৌভাগ্য লাভ করেন। বিশেষত খালা আয়েশার ফিকহ্ তিনি হাছিল করেন হাসি-খেলার শৈশবেই। এছাড়াও উম্মুল মু’মিনিন উম্মে হাবীবাহ ও উম্মে সালামাহ থেকেও শৈশবেই অনেক ইলম অর্জন করেন তিনি।

পরিবার ও আত্মীয়দের ইলমের সুবাস এবং আমলের সোনালী পরশে সফলতার সোপানগুলো পার হন খুব সহজেই। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর ছিলেন তাঁর বড় ভাই। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছাড়াও বহু সাহাবির সান্যিধ্য লাভে ধন্য হন তিনি। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস, ইবনে উমর, ইবনে আব্বাস, হাসান ইবনে আলীসহ অনেক তরুন সাহাবীর সান্নিধ্য তাঁর সামনে খুলে দেয় হাদীসের বিশাল দিগন্ত। তাদের সবার কাছ থেকেই তিনি হাদীস শ্রবণের সৌভাগ্য লাভ করেন।

সাহাবিদের মধ্যে ফকীহ হিসেবে খ্যাত আলী ইবনে আবি তালিব, যায়েদ ইবনে সাবিত, নুমান ইবনে বশীর, উসামা ইবনে যায়েদের শিষ্যত্ব তাঁর সামনে খুলে দেয় ফিকহের বিশাল জগত। এ মহান ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যেরর সৌরভ তাঁর জ্ঞানের সাগরে নিয়ে আসে অফুরন্ত জোয়ার।

হাদীস শাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম ইবনে শিহাব যুহরি তাঁর সম্পর্কে বলেন, তিনি ইলমের এমন সাগর যার তলা নেই। ইমাম নববী লেখেন, তাঁর ( উরওয়ার) গুণ ও বৈশিষ্ট্য অগণিত। তাঁর মহত্ত্ব, উঁচু মর্যাদা এবং ইলমের ব্যাপারে সবাই একমত। হাদীস ও ফিকহ্ শাস্ত্রে ছিল তাঁর সমান পারদর্শিতা। ইমাম যাহাবি তাঁকে মদীনার ইমাম ও আলেম বলে উল্লেখ করেছেন। তাবকাতে ইবনে সা’দে তাকে উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ফকীহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যিরিকলী তাঁর ‘আলামে’ বলেছেন, তিনি ( উরওয়া) ছিলেন মহান আলিম। শারাফাত ও নেক আমলের অধিকারী ব্যক্তিত্ব।

সীরাতের বিশাল জগতও ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়।

উরওয়া ইলমের সাগর যেমন ধারণ করেছেন নিজ অন্তরে তেমনি অকাতরে বিলিয়েছেনও হৃদয় থেকে হৃদয়ে। তাঁর ইলমের সৌরভে সুবাসিত হয়েছেন অসংখ্য মনীষী, বিখ্যাত অনেক তাবেয়ী। আতা, ইবনে আবি মুলাইকা, যুহরী ও খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয তাঁর সোহবতে থেকে ধন্য হয়েছেন। ছেলে হিশাম ইবনে উরওয়া, ইয়াহইয়া, আব্দুল্লাহসহ বিখ্যাত আরো অনেকেই তাঁর থেকে ইলম হাসিল করেছেন।

যুহদ ও তাকওয়া, দ্বীনের জন্য কোরবানী, ইলমের সাথে আমলের মিতালী, দ্বীনের বিভিন্নমুখী খেদমত ছিল তাঁর প্রাত্যহিক জীবনেরই অংশ।

কুরআনের তিলাওয়াত ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় আমল। প্রতিদিন দেখে পড়তেন এক চতুর্থাংশ। বাকীটুকু শেষ করতেন রাতে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে। ইমাম ইবনুল ইমাদ হাম্বলী রহ. বলেন, তাঁর সত্তার মধ্যে ইলম, সিয়াসাত, ইবাদাত সবকিছুর সমাবেশ ঘটে।

আবেদ ও দুনিয়া-বিরাগী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্বাভাবিক রুচিবোধ ছিল উন্নত। পোশাক-পরিচ্ছদ ও চালচলনে সাদাসিধা আভিজাত্য লালন করতেন। তিনি ছিলেন সবর ও ইস্তিকামাতের বাস্তব প্রতীক। কঠিন বিপদের মুহূর্তেও তাঁর মুখে উহ্ ধ্বনি উচ্চারিত হতো না।

জনকল্যাণমূলক কাজে শরীক হতেন সামনে থেকে। বীরে উরওয়া নামে মদীনায় একটি কূপ খনন করেছিলেন মানুষের পানির কষ্ট দূর করার জন্য। বলা হয়ে থাকে এ কূপের পানি ছিল মদীনার সবচেয়ে সুমিষ্ট।

বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন সময়ে নানা অঞ্চলে অবস্থান করলেও শেষ জীবনে তিনি ফিরে আসেন মদীনায়। মদীনার নিকটবর্তী মাজাহ পল্লীতে ৯৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন এ মহান মনীষী। তার রেখে যাওয়া ইলমের আমানত এবং আমলে ভরপুর স্বর্ণালী জীবনের জন্য তিনি ভাস্বর হয়ে আছেন পৃথিবীর বুকে।

তথ্যসূত্র: তাযকিরাতুল হুফফায, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ওফায়াতুল আ’ইয়ান

পূর্ববর্তি সংবাদরমযানে নামাজ, সেহরি-ইফতারের সময়সূচি জানা যাবে ‘৩৩৩’ নম্বরে
পরবর্তি সংবাদভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে ‘ফণী’র আঘাত, উপড়ে পড়েছে বৈদ্যুতিক পোল ও গাছপালা