বাঁশের সাঁকোর সুখ-স্মৃতি!

আবু দারদা ।।

সাঁকো। পানির উপর কয়েকটি ক্যাঁচকি বাঁশে বান দিয়ে খুঁটি দাঁড়ানো পথ। সোজাসাপটা বলা যায়, ছোট খালের মাঝামাঝিতে এপার-ওপার পারাপারের পুল। একযুগ আগেও গ্রামের ছোটখাটো খাল-বিলে বহু সাঁকো দেখা যেতো। এখনও আছে কিছু সাঁকো গ্রামে। আর শহুরে লোকদের নিকট সাঁকো তো অদেখা এক ভয়ে কাঁপা পুল।

অবশ্য হাতেগাোনা কিছু জায়গায় হলেও শহরেও সাঁকোর ব্যবহার চোখে পড়ে৷ রাজধানীর খিলগাঁও থানার বনশ্রী-আফতাবনগরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা নড়াই নদী। এটাকে নদী না বলে খাল বলাটাই অধিক সঙ্গত। এই নড়াই নদীর আশপাশের বাসিন্দাদের দেখলে মনে হয় রাজধানীর বুকে ছোট্ট একটি দ্বীপে বসবাস করছে তারা৷ খাল পারাপারে তাদের একমাত্র ভরসা বাঁশের সাকো এবং নৌকা। নড়াই নদীতেই বেশ চওড়া করে কয়েকটি সাঁকো নির্মিত।

নড়াই নদীর উপড় বানানো সাঁকো

নড়াই নদীর সাঁকোগুলো বেশ উঁচু। দূর থেকে দেখলেই বুকটা কেঁপে উঠে৷ প্রথমত, অনেক লম্বা। নদীর এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত, নগরীর ময়লা ফেলার বিশাল প্রজেক্ট যে এই নদী তা কালো পানির স্রোত দেখলে নির্দ্বিধায় বলা যায়৷ কোনো কারণে সাঁকো থেকে পড়ে গেলে সোজা ময়লায় গিয়ে ডুবতে হবে যে!

সাধারণভাবে শহরের ছোটছোট কালভার্টে সাঁকোর ব্যবহার একদম দেখা যায় না বললেই চলে। সাঁকোর তুলনায় লোহার তৈরী ব্রিজ সবদিকে। লোহার ব্রিজে দিয়ে নিশ্চিত মনে পারাপারা করা যায়৷ না থাকে ভয়, না থাকে শঙ্কা। ঠিক তার উল্টো অবস্থা বাঁশের সাকোর। নড়বড়ে বাঁশের গিঁটে কড়মড় শব্দ। দোদুল্যমান হাতলের বাঁশ। ভয়, শঙ্কা ও রোমাঞ্চ। সে এক অন্যরকম ভয়! অন্যরকম সুখ! অন্যরকম এডভেঞ্চার!

 

গ্রামাঞ্চলে বর্ষার সময় অনেক খালবিল পানিতে ডুবে যায়। তখন রাস্তা পারাপারের একমাত্র প্রধান মাধ্যম হয় সাঁকো এবং নৌকা। সাঁকো দিয়েই বড়ছোট সবাই খুব সতর্কতার সাথে কদম গুনে গুনে হাঁটে। ছোট বাচ্চাদের সাথে নিয়ে ধীরে ধীরে পার হয় বড়রা। নড়বড়ের সাঁকোর ভয় তো থাকেই! তারপরও সাঁকোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক আবেগ ও স্মৃতি!

সাঁকোতে চড়তে হয় সাবধানতার সাথে। ধীরেসুস্থে। কাপড় চোপড় গোছগাছ করে। এক পা দু’পা করে৷ বাঁশের হাতলে নিয়ন্ত্রণ রেখে। নতুবা সামান্য অসতর্কতায় পানিতে গড়িয়ে পড়াটা যেন অবধারিত।

গ্রামের ছোট খালের উপড় বানানো সাঁকো

ছোটদের সাঁকো পারাপারের দৃশ্যটি আরও উত্তেজনাপূর্ণ। সাঁকোর মাঝপথে এসে হাতলের বাঁশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নির্বাক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে ছোটরা-শিশুরা। বড় কেউ দেখলে উদ্ধার করে নিয়ে যায়৷ উদ্ধারের পদ্ধতিটাও বড় রোমাঞ্চকর। উদ্ধারকারী চলেন ধীর গতিতে। পিছনদিকে তার কোমর বা কাপড়ের পিছনের অংশ চেপে ধরে ছোটরা। হাতল ছাড়া দুরুদুরু মনে সামনের দিকে চলে৷ এসব দৃশ্য এখন কমে গেছে। গ্রামে গ্রামে সাঁকোর জায়গা দখল করেছে পাকা পুল। স্মৃতি ধরে বসে থাকলে তো হবে না। উন্নয়ন ও গতির গল্পের কাছে হার মানছে সাদামাটা গ্রামীণ সাঁকোর সুখস্মৃতি।

অবশ্য প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায়, বাঁশের সাঁকোর বদলে তৈরি হওয়া অনেক পুল-ব্রীজের পেছন ছাড়ছে না বাঁশ। ইট-সুড়কির ঢালাইয়ের ভেতর লোহা থাকার কথা থাকলেও প্রায়ই বাঁশের পাত। এও যেন উন্নয়নের অন্যরকম বাঁশপ্রীতি!

সবরকম উন্নয়নের গল্পের মধ্যেও সাঁকোতে পা টিপে চলার সুখটা ছিল অবর্ণনীয়। অন্যরকম এক ঘোরলাগা রোমাঞ্চ! ভয় ও শঙ্কায় এগিয়ে চলা৷ কোনোমতে পার হতে পারলেই মুখে বিজয়ের হাসি। এই সময়ে এসে অদ্ভুতভাবে মিস করছি শৈশবে সাঁকো পারাপারের হারানো সেইসব সুখ!

পূর্ববর্তি সংবাদফণীর আঘাত থেকে রক্ষায় শুক্রবারে মসজিদে বিশেষ মোনাজাতের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
পরবর্তি সংবাদভারতে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় ফণী