ইসলাম টাইমস ডেস্ক: অনেকে মনে করেন, ভারতের চলমান সাধারণ নির্বাচন দেশটির সেক্যুলার, বহুত্ববাদী ভবিষ্যত প্রশ্নে একটি গণভোটও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী বিজেপির কৌশল অনেকটাই হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রচার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো, বিশেষ করে মুসলিমদের কথিত হুমকিভিত্তিক।
দলটির ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি দেখা গেছে। এতে সারা ভারতে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। দলের টুইটার অ্যাকাউন্টে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে: আমরা সারা দেশে এনআরসি বাস্তবান নিশ্চিত করব। আমরা বৌদ্ধ, হিন্দু ও শিখ ছাড়া প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেব।
বিজেপি যে ভারতীয় সভ্যতা চায়, তাতে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের কোনো স্থান নেই। দলটি খ্রিস্টান ধর্মকে বিবেচনা করে ধর্মান্তরবাদী এবং মুসলিমদের মনে করে হানাদার, গরুখেকো, নির্যাতনকারী বোরকা-ঢাকা নারী ও সন্ত্রাসীদের ধর্ম।
এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের ঘৃণাপূর্ণ ও বিভাজনকসুলভ ভাষা প্রায় ৫০০ ভাগ বেড়েছে। আর ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু গ্রুপ, যারা দেশের জনসংখ্যার ১৫ ভাগ, মুসলিমেরা ঘৃণা, সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতার সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও প্রার্থীরা প্রায়ই রক্ষণশীল পরিচয় তুলে ধরতে, ভোটারদের সমর্থন পেতে ইসলামফোবিয়া বা ইসলামভীতি ব্যবহার করে। ইসলামকে সহিংস, বিদেশী ও অভারতীয় ধর্ম হিসেবে প্রচার করে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করে।
সব সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কাজ ইসলামের ওপর চাপানো হয়। ইসলামি সন্ত্রাসবাদের উদাহরণগুলো রাজনৈতিক পরিচিতি ও জাতীয় নিরাপত্তায় ইন্ধন দিতে প্রয়োগ করা হচ্ছে। অতি সম্প্রতি ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় যে হামলা হয়েছে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সেটাকেও তাদের ইসলামবিরোধী কার্যক্রমে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। বিজেপির অনেক প্রার্থীই জোরালোভাবে তা প্রকাশ করছে। তাদের টুইটারে লেখা হচ্ছে: ‘সব মুসলিম সন্ত্রাসী নয়, তবে সব সন্ত্রাসীই মুসলিম।’
ওই বিস্ফোরণের পর রাজস্থানের ছিত্তোরগড়ে এক নির্বাচনী সভায় বক্তৃতাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসব হামলার কারণেও তার দলকে ভোট দিতে বলেন। তিনি দাবি করেন, ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে ভারতের অবস্থাও ছিল শ্রীলঙ্কার মতো। তিনি বলেন, সাবেক সরকার মুসলিমদের ভোটের জন্য সন্ত্রাসবাদের সাথে লড়াই করেনি। ফলে সন্ত্রাসবাদের সাথে মুসলিমরা একাকার হয়ে গেছে।
হরিয়ানার পানিপথে আরেক নির্বাচনী সভায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেন, মোদি যখন পাকিস্তানি সন্ত্রাসীদের হত্যা করেন, তখন বিরোধীদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় কেন? সন্ত্রাসীরা কি তাদের আত্মীয়? মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান ও সন্ত্রাসবাদের সাথে ভারতীয় মুসলিমদের জুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, তারা তাদের ভোট ব্যাংক নিয়ে উদ্বিগ্ন।
পুলাওয়ামা ও বালাকোটে পাকিস্তানের সাথে সাম্প্রতিক সঙ্ঘাতকে ব্যবহার করে বিজেপি পাকিস্তান ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে নির্বাচনী গলাবাজির প্রধান বিষয়ে পরিণত করেছে।
ইসলামি সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করলেও বিজেপি কিন্তু অমুসলিমদের সন্ত্রাস নিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণ হিসেবে নক্সালদের কথা বলা যায়। এই গ্রুপই ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। কিন্তু নির্বাচনী কার্যক্রমে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনা হচ্ছে না। আবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের ফলে শাস্তি বলতে গেলে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তা প্রশংসিতও হয়। গরুর গোশত খাওয়ার কথিত অপরাধে মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করা, হিন্দু নারীদের প্রলুব্ধ করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার লাভ জিহাদ, মুসলিমদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার ঘর ওয়াপসি ইত্যাদি তৎপরতা এড়িয়ে যাওয়া হয়।
আরো ভীতিকর বিষয় হলো, বিজেপি চরমপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রজ্ঞা ঠাকুরকে পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী করেছে। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তিনি জামিনে ছিলেন। তিনি হলেন মহারাষ্ট্রের মালেগাঁও বোমা হামলার প্রধান সন্দেহভাজন আসামি। ওই হামলায় ছয়জন নিহত হয়েছিল, আহত হয়েছে শতাধিক। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী খুন, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করা, সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বৈরিতা বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চাকরি সৃষ্টি, দুর্নীতির উচ্ছেদ করে নয়া ভারত গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে কৃষকসমাজ ক্ষুব্ধ হয়েছে, প্রায়ই তারা বিক্ষোভ করছে। জানুয়ারিতে লাখ লাখ শ্রমিক বিজেপির অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে সমাবেশ করে।
ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বেকারত্বও বেড়েছে। ২০১৮ সালে বেকারত্ব বেড়েছে ৬.১ ভাগ, যা ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কথিত কালোটাকা উদ্ধার, স্বচ্ছ, নগদবিহীন অর্থনীতি গড়ার উদ্যোগটিও ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
বিজেপির ক্রমবর্ধমান মুসলিমবিরোধী বাগাড়ম্বড়তার প্রভাব ভয়াবহ। একে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে ধর্মীয় বৈষম্যে ইন্ধন দেবে, মুসলিমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এছাড়া এটা ভারতের প্রাণবন্ত বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে, অবিশ্বাসের জন্ম দেবে, পারস্পরিক সন্দেহ বাড়বে। এটা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাকে সমস্যাসঙ্কুল করবে।
লেখক: রিসার্চ অ্যানালিস্ট, ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
