তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব।।
কোরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা যেমন ইবাদত, তেমনি কোরআন বুঝা এবং আয়াতের মর্মার্থ ও শিক্ষা-নির্দেশনা সম্পর্কে চিন্তা ফিকির করাও স্বতন্ত্র ইবাদত। প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ হলো প্রথমে বিশুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াত শেখা। এরপর উচিত ধীরে ধীরে কোরআন বুঝার চেষ্টা করা। আমার সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা মালিক যিনি, তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে কী বলেছেন তা বুঝার চেষ্টা না করা নিশ্চিত অবহেলার কথা! তাই প্রত্যেক মুসলমানেরই মনেপ্রাণে কোরআন বুঝার কামনা ও আকুতি থাকা উচিত। কোরআন বুঝার জন্য চেষ্টা মেহনত অব্যাহত রাখা কাম্য।
কোরআন বুঝার প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হলো তাফসিরগ্রন্থ। কোরআন, হাদীস ও ইসলামী শরীয়তের বিদগ্ধ পণ্ডিত আলেমগণ সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত আকারে তাফসিরের বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহ সেইসব গ্রন্থ থেকে ভরপুর উপকার লাভ করছে এবং গ্রন্থগুলোর সূত্র ধরে শত শত বছর পূর্বে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং পূর্বসূরি মনীষীগণ কোরআনের কোন আয়াত সম্পর্কে কী ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন কিংবা তারা নিজেরা কী বুঝেছেন, কী ব্যাখ্যা করেছেন তা জানতে পারছে। আমরা আমাদের মতো করে স্বল্প পরিসরে এবং ধীরে ধীরে সেই তাফসিরগ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করতে পারি। এর মাধ্যমে কোরআন বুঝার মহান ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতে পারি।
খুবই নির্ভরযোগ্য এবং বিখ্যাত একটি তাফসিরগ্রন্থের নাম তাফসীরে ইবনে কাসীর। গ্রন্থটির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এখানে তুলে ধরা হলো।
তাফসীরে ইবনে কাসীর
এর মূল নাম হলো, তাফসীরুল কোরআনিল আযীম।
লেখক : হাফেয ইমাদুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে উমর ইবনে কাসীর আশ-শাফেয়ী (ইনতিকাল ৭৭৪ হিজরী)। তিনি তাঁর শতাব্দির শ্রেষ্ঠতম মনীষীদের একজন। হাদীস, উলূমুল হাদীস ও তাফসীরের বিদগ্ধ পণ্ডিত আলেম। পরবর্তী সর্বযুগে মানিত ও বরিত ইমাম। তাই তাঁর নামের দিকে সম্বন্ধযুক্ত হয়েই কিতাবটি খ্যাতি লাভ করে তাফসীরে ইবনে কাসীর নামে।
এই গ্রন্থে তাফসিরের যে রীতি অবলম্বন করা হয়েছে তাকে ‘তাফসীর বির রিওয়ায়াহ’ বলে। অর্থাৎ হাদীস ও আসারের (সাহবীগণের উক্তি) আলোকে কোরআনের তাফসির। দেখা যায় হাফেয ইমাদুদ্দীন তাঁর কিতাবে প্রথমে কোরআনের আয়াতের সঙ্গে আয়াতের মর্মার্থ উল্লেখ করেছেন। এরপর আয়াতে উল্লেখিত বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য সম্পর্কে যে সকল হাদীস ও আসার পাওয়া যায় সেগুলো উল্লেখ করেছেন। তবে এক্ষেত্রে অন্য অনেক মুফাসসিরের মতো সব ধরণের বর্ণনা উল্লেখ করেননি। বরং যাচাই বাছাই করে নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য বর্ণনাগুলো উল্লেখ করেছেন। খেয়াল করলে বুঝা যায়, তিনি ওইসব মওযু ও যয়ীফ বর্ণনাগুলো সযত্নে পরিহার করেছেন যেগুলো অন্য কোনো কোনো মুফাসসিরের কিতাবে এসে গেছে। এরপরও অপেক্ষাকৃত দুর্বল বর্ণনাগুলো উল্লেখ করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সনদের মান ও দুর্বলতার দিকগুলো স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন।
সাধারণত তাফসিরের কিতাবে আগের যুগের নবীগণের ঘটনা বর্ণনায় প্রচুর ইসরাঈলী বর্ণনা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে হাফেয ইবনে কাসীর রাহ.-এর নীতি অত্যন্ত সংযত ও পরিচ্ছন্ন। এজন্য তাঁর এ কিতাবে ইসরাঈলী বর্ণনা তেমন উল্লেখিত হয়নি। বিভিন্ন প্রসঙ্গে অল্পসংখ্যক বর্ণনা যা উল্লেখিত হয়েছে তা তিনি স্পষ্টভাবে ‘ইসরাঈলী বর্ণনা’ নামেই উল্লেখ করেছেন।
মোটকথা পুরো কিতাবে লেখকের ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞান-পাণ্ডিত্বের যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে। ফলে তাফসীর শাস্ত্রে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ও চমৎকার একটি কাজ সম্পন্ন হয়েছে এর মাধ্যমে। শাস্ত্রবিদগণ একে রিওয়ায়াত ভিত্তিক তাফসীর-এর একটি মৌলিক গ্রন্থ মনে করেন।
তবু একথা বলা যায় না যে এ তাফসিরে উল্লেখিত সকল বর্ণনাই সহীহ। কারণ কোথাও কোথাও হাফেয ইবনে কাসীর নিজেও কিছু দুর্বল বর্ণনা উল্লেখ করেছেন কোনো মন্তব্য ছাড়া। তবে সামগ্রিকভাবে বলা যায়, এটি খুবই নির্ভরযোগ্য ও অগ্রগণ্য একটি তাফসির গ্রন্থ।
গ্রন্থটি সৌদি, মিসর, বৈরুতসহ বেশ কয়েকটি দেশের শ্রেষ্ঠ কুতুবখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কোনো প্রকাশনী থেকে চার খণ্ডে, কোনো প্রকাশনী থেকে কোনো গবেষকের টিকা-উদ্ধৃতিসহ ছয় ও আট খণ্ডেও প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদও হয়েছে এ কিতাব। বাংলা ভাষাতেও এর অনুবাদ পাওয়া যায়। তবে অনুবাদের গুণমান ও যথার্থতা অবশ্যই বিবেচনাধীন।
