ডা. মুহাম্মদ আব্দুল বারী ।।
‘সাওম’ এক বচন। এটি আরবি শব্দ। এর বহুবচন ‘সিয়াম’৷ এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা৷ ‘রোযা’ ফারসি শব্দ৷ যা ‘রোয’ বা দিন থেকে এসেছে, অর্থাৎ দিনে বিরত থাকা৷
রোযা রাখার নিয়ম সবযুগেই প্রচলিত ছিল৷ ইয়াহুদী, খৃষ্টান, হিন্দু, মুসলমান সব ধর্মেই fasting বা রোযার প্রচলন আছে এবং ছিল। যদিও ধরন ও প্রক্রিয়াগত ভাবে মুসলমানদের রোযা অন্যদের থেকে ভিন্নতর৷
শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার ও জৈবিক প্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোযা বলে৷
রোযা রাখার বহুমাত্রিক উপকারিতার মধ্যে শারীরিক সুস্থতা, চারিত্রিক মহত্ত্বতা, নৈতিক পরিচ্ছন্নতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, আত্মিক পবিত্রতা ও সামাজিক বন্ধন অক্ষুন্নতা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য৷
এখানে আমরা শারীরিক সুস্থতা বিষয়ে অল্প কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করবো৷
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী শারীরিক সুস্থতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য দৈনিক নূন্যতম তিনবার পানাহার অত্যাবশ্যকীয়৷ এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে অনেকেই সাধারণ চাপ বা সাধারণ অসুস্থতায় রোজা রাখা পরিত্যাগ করে থাকেন৷ অথচ বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন রোগের ওপর রোযার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে লব্ধ ফলাফল যা পেয়েছেন তা প্রচলিত ধারণার বিপরীত৷
রোযা নিয়ে গবেষণা করে গবেষণা লব্ধ ফলাফল নিম্নরূপ:
এক. রোজা ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) শক্তিশালী করার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে৷
পরামর্শ: অটোইমিউন ডিজিজ ও ইমিউন ডেফিশিয়েন্সি স্টেটে রোজা রাখা৷
দুই. Obesity বা স্থূলতাজনিত ভয়াবহ রোগসমূহ থেকে সুরক্ষার ক্ষেত্রে রোজার ভূমিকা অপরিসীম৷
স্থূলতা সংক্রান্ত রোগ সমূহ:
(ক) মেটাবোলিক সিন্ড্রোম, ডায়াবেটিস মেলাইটাস, হৃদযন্ত্রের রক্তনালির রোগ, উচ্চ রক্ত চাপ, স্ট্রোক প্রভৃতি৷
(খ) ফ্যাটি লিভার, স্টেয়াটোহেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস৷
(গ) হাইপারভেন্টিলেশন সিন্ড্রোম, স্লিপ অ্যাপ্নিয়া।
(ঘ) অস্টেওআর্থ্রাইটিস, ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স, ভ্যারিকোজ ভেইন।
(ঙ) ব্রেস্ট ক্যান্সার, জরায়ূ ক্যান্সার, পলিসিস্টিক ওভরি সিন্ড্রোম।
(চ) গলস্টোন ডিজিজ, পায়ূপথের ক্যান্সার, স্কিন ইনফেকশন প্রভৃতি৷
পরামর্শ: হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার, ঘুমের মাঝে গোঙ্গানো, শ্বাস বন্ধ ভাব, হাটু মাজা ব্যথা, বন্ধ্যাত্ব, ব্রেস্ট ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, পায়ূপথে ক্যান্সার, পিত্তপাথরি, বিষন্নতা ও চর্মরোগ প্রভৃতির চিকিৎসায় রোজাকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে৷
তিন. রোজা কিডনিতে পাথর তৈরি প্রক্রিয়া প্রতিরোধ করে৷ কারণ, রোজায় পানাহার থেকে বিরত থাকার দ্বারা হাইপোভলিউমিক হাইপার ন্যাট্রেমিয়া হয়৷ আর রক্তে সোডিয়ামের তুলনামূলক আধিক্য ক্যালসিয়ামের কৃস্টালাইজেশনে বাধা দেয়৷ ফলে কিডনিতে পাথর তৈরি প্রক্রিয়া প্রতিহত হয়৷
চার. রোজা Aging process বিলম্বিত করার মাধ্যমে বার্ধক্যের ছাপ প্রতিহত করে৷ মেটাবলিক টক্সিন বা বিপাকীয় বিষক্রিয়া থেকে দেহকে রক্ষা করার মাধ্যমে ত্বকের লাবণ্য ও দেহের তারুণ্য বজায় রাখে৷
পাঁচ. রোজা সেক্সুয়াল ডিজায়ার বা জৈবিক ইচ্ছার তীব্রতাকে প্রশমিত করে৷ ফলে নৈতিক অবক্ষয় থেকে সমাজকে পবিত্র রাখে৷
ছয়. রোজা Infertility বা বন্ধ্যাত্ব প্রতিহত করে নারী পুরুষ উভয়েরই প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে৷
পরামর্শ: যারা কনসীভ করেন না, বা করলেও বারবার এ্যবর্শন হয়ে যায় তারা সন্তানের জন্য দিনে রোজা রেখে রাতে আল্লাহর কাছে চাইলে সুনিশ্চিত ফলাফল আশা করা যায়৷
সাত. রোজা কিছু কিছু Peripheral vascular disease ও Vasculitis যেমন ‘রেইনডস ডিজিজ’ এর প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে৷ (JIMA, vol.23: 163-164)
(‘রেইনডস ডিজিজ’ রক্ত নালিকার প্রদাহজনিত এক ধরনের রোগ, যেখানে ঠান্ডার স্পর্শে হাতের আঙ্গুলের রঙ বিবর্ণ হয়ে যায় এবং কখনো নখ শুকিয়ে আঙ্গুলে পচন ধরে৷)
আট. Continual (Medical) fasting বা অনবরত পানাহার থেকে বিরত থাকা Chronic rheumatoid arthritis (এক ধরনের বাত জাতীয় রোগ, যাতে হাত পায়ের আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়) এর প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে৷
(Annals of Rheumatic Disease,42)
নয়. উপযুক্ত ঔষধ সেবন সহ Islamic fasting বা রোজা Chronic Peptic Ulcer Disease বা গ্যাস্ট্রিক আলসার এর প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে৷
(The Medicus, 1963)
দশ. এছাড়াও রোজার অন্যন্য উপকারিতার মধ্যে মেধাশক্তি ও স্মরনশক্তি বৃদ্ধি, Digestive ও Absorptive বা হজম শক্তি বৃদ্ধি, Exocine ও Endocrine Glands এর শক্তি বৃদ্ধিৃসহ নিয়ন্ত্রিত মেটাবলিজম এর মাধ্যমে রক্তে শর্করা ও কোলেস্টেরল এর সুসম মাত্রা বজায় রাখে৷
সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রোযা বা ফাস্টিং এর মাধ্যমে দেহে ‘অটোফ্যাজি’ নামক একটি প্রসেস সচল হয়, যাতে দেহের দুর্বল ও অসুস্থ কোষগুলো এবং কোষের বিপাকীয় বর্জ পদার্থগুলো সুস্থ ও সবল কোষ দ্বারা ফ্যাগোসাইটোসিস এর মাধ্যমে দেহ থেকে অপসারিত হয়৷ ফলে দূরারোগ্য অটোইমিউন ডিজিজ, ক্যান্সার, স্থূলতাজনিত রোগ, কার্ডিও প্রটেক্শন, নিউরো প্রটেকশন ও অ্যান্টি এইজিং সহ নানা দিক থেকে দেহকে সুরক্ষা দেয়৷
উল্লেখ্য, ‘অটোফ্যাজি’ নামক প্রক্রিয়াটি জাপানের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইউশিমিও ওশিনি আবিস্কার করে 2016 সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত হোন৷ এর পর থেকে জাপানসহ পশ্চিমা বিশ্বে সপ্তাহে দুই দিন ফাস্টিং বা রোজার প্রাক্টিস আরও বহু গুণ বেড়ে গেছে৷
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক
মেডিসিন বিভাগ, সিবিএমসিবি, ময়মনসিংহ৷
