আবদুর রহমান তাশরীফ।।
গৌরবময় জীবন শেষে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন কত মনীষী! যাদের কথা আমাদের জানা নেই। এদের অবদানে ধন্য এই বাংলার মাটি। বাংলার আধাঁর ছাওয়া অঞ্চলে আলো জ্বালানোর সংগ্রামে তাদের জীবনে নেমে এসেছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। সবকিছু বরণ করে নিয়েই তারা মগ্ন থেকেছেন আলো জ্বালানোর সংগ্রামে। ঈমানের আলো জ্বালিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। চেতনার পরিমণ্ডলে পরিশুদ্ধির বিপ্লব সাধন করেছেন। পাল্টে দিয়েছেন মানুষের জীবনবোধ। সেই নাম না জানা মহান মনীষীদের একজন হযরত নূরুদ্দীন নুরুল হক রহ.। বিখ্যাত তিনি হযরত নূর কুতুবে আলম নামে।
সুলতানী আমলের কিংবদন্তি ইসলামী মনীষী হযরত নুর কুতুবে আলম রহ. বহুমুখী প্রতিভা ও যোগ্যতার অধিকারী এই আলেমেদ্বীন যেমন ছিলেন আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ের সাধক, তেমনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক, দেশপ্রেমিক, দেশের শীর্ষস্থানীয় মেধাবী দ্বীনের খাদেম। তিনি রাজা গণেষের অত্যাচার থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করেন।
১৩/১৪ শতাব্দীর এই কিংবদন্তির জ্ঞান ও সাধনার বিভা শুধু বিশাল বাংলা নয়, ছড়িয়ে পড়েছিল উপমহাদেশ জুড়ে। ভারতের নানা অঞ্চল থেকে তাঁর সৌরভ গ্রহণ করতে ছুটে আসতো মানুষ। ছুটে আসতেন বহু তালিবে ইলম এবং বহু সালেকিন, বাংলার তৎকালীন রাজধানী পান্ডুয়ায় তাঁর পরিচালিত মাদ্রাসায়। তাঁর কাছ থেকে ইলমের সৌরভ এবং আত্মশুদ্ধির দীক্ষা নিয়েছেন উপমহাদেশের বহু বুযুর্গ ও আলেমেদ্বীন। আজমীরের শায়েখ শামসুদ্দীন রহ, লাহোরের শায়েখ তাকু, মানিকপুরের শায়েখ হুসামুদ্দীন রহ.ছিলেন এই মাদরাসার ছাত্র এবং তার বিশেষ শিষ্য।
বাংলার বিখ্যাত পীর এবং অন্যতম আলেমেদ্বীন হযরত শায়েখ আলাউল হক ছিলেন তাঁর বাবা। তিনি হযরত খাজা নিযামুদ্দীন আওলিয়ার বিশিষ্ট খলীফা হযরত সিরাজুদ্দীন আলী উসমানের ছিলেন শীর্ষ শিষ্য। হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ রা:-এর বংশের এই গৌরব নিজ সন্তানকে গড়ে তুলেন বিচিত্রগুণ ও যোগ্যতার মধ্য দিয়ে। হযরত নূর কুতুবে আলমের ভাই ছিলেন বাংলার কিংবদন্তি মুসলিম শাসক গিয়াস উদ্দীন আযম শাহ রহ.-এর উযিরে আযম।
সুলতান নিজেও ছিলেন হযরতের গুনমুগ্ধ সহপাঠি। ভক্তি-শ্রদ্ধার আচরণ করতেন শায়েখের সাথে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলিতে শায়খের পরামর্শ গ্রহণ করতেন বলেও জানা যায়।
সাহাবী বংশে জন্ম নেওয়া এই বুযুর্গ ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই ছিলেন দেশের অভিজাত পরিবারের। সুলতান ইলিয়াছ শাহ রহ:-এর উত্থান-পতনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল তাঁর পরিবার্। যেজন্য দ্বীনদারীর এবং প্রাচুর্য রাজকীয় ছোঁয়া উভয়টাই তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল সমানভাবে।
শৈশব থেকেই দ্বীনের প্রতি গভীর অনুরাগ, সুন্নাতের পাবন্দি, সাধক জীবনের অনুশীলন ছিল তাঁর। উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইলমি মনীষী এবং এবং আধ্যাত্মিক মহীরুহ ব্যাক্তিদের সান্নিধ্য তাঁকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। তাঁদের সান্নিধ্যের পরশ গভীর ছাপ ফেলে তাঁর মননে-চেতনায় এবং জীবন-যাপনে। যুবরাজের সহপাঠি হওয়াসহ বিলাসিতার নানা রাজকীয় ছোঁয়া আঁচড় কাটাতে পারেনি তাঁর সাধক জীবনে।
তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন তৎকালীন শিক্ষাবিদ, বরেণ্য পন্ডিত আলেম আল্লামা কাজী হামীদু্দ্দীন নাগোরী রহ.। বাবার কাছে আধ্যাত্মিক সাধনায় পূর্ণতা লাভ করে উপাধি পান কুতুবুল আলম বা বিশ্বের বরেণ মণীষী হিসেবে। তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে।
ইলম ও আধ্যাত্মিক জগতের মণীষীদের সান্নিধ্য ও তত্ত্বাবধানে এক সময় পরিচিত হন বাংলার অপ্রতিদ্বন্দ্বি আলেমেদ্বীনে। বিভিন্ন সময় সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে তাঁর বুদ্ধিদ্বীপ্ত পথনির্দেশ, অনন্য সাধারণ ইসলামী পান্ডি্ত্য এবং দুনিয়াবিমুখ জীবন-যাপন বাংলার জনতার মনে সৃষ্টি করে তার জন্য শ্রদ্ধার আসন।
ইলিয়াস শাহী সুলতানদের শেষ ভাগে সৃষ্টি হওয়া ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংকট নিরসনে তিনি স্বীকার করেন অসামান্য আত্মত্যাগ। তাঁর যথাযথ পথনির্দেশে এই বিশাল সংকট থেকে মুক্তি পায় বাংলার মানুষ। জাতীয় জীবনে মানবতা ও শান্তির সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে।
শেখ নূর কুতুব আলমের মৃত্যুর তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে সে তারিখটি ৮১৮ হিজরি বা ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ বলে সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে। এ তারিখের অভিব্যক্তি হলো ‘নূর বানূর-শুদ’ (আলো আলোতে বিলীন)। মৃত্যুর পর তাকে পান্ডুয়ার শাশ হাজারি দরগায় দাফন করা হয়। তার পিতাকেও এখানে দাফন করা হয়েছিল।
তাঁর জীবনের আলোচনা স্থান পেয়ছে অনেক ঐতিহাসিক গ্রন্থে। সুফি জীবনী লেখক এবং উপমহাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষকরা তাঁকে স্বরণ করেন শ্রদ্ধাভরে। তারীখে ফারিশতা ও আইনে আকবরিসহ অনেক গ্রন্থে আলোচিত তিনি। তাঁর জীবনের উপর কলম ধরেছেন শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী ভাষাবিদ ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ রহ.। তাঁর সুরভিত কথামালার সৌরভ দিয়েই ইতি টানছি লেখাটির। তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য হযরত শায়খ হুসামুদ্দীন রহ.-কে একদিন তিনি বললেন ‘সূর্যের মতো দাতা হও, পানির মতো নম্র হও, আর মাটির মতো ধৈর্যশীল হও।’
উপমহাদেশের এই বিখ্যাত বুযুর্গের জীবনের আলো আল্লাহ পাক আমাদের দান করুন। সুখে ভরে দিন তাঁর আখেরাতের যিন্দেগী।
তথ্যসুত্র:
*হযরত নূর কুতুবে আলম, ড: মুহাম্মদ শহীদু্ল্লাহ।
*নূর কুতুবে আলম, সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ১ম খন্ড পৃষ্ঠা:৫২০
*হিস্টোরি অফ সুফিজম ইন ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা:৪৬৭ সৈয়দ আতহার আব্বাস রিজভী
