দুটো আম বৃদ্ধা মহিলার কাছে কেউ বেচতে চাইলো না!

আরিফ জাব্বার ।।

জরুরি কাজে টাংগাইল শহরে এক বড় ভাইয়ের বাসায় আসলাম৷ সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে গন্তব্যের দিকে হাঁটছি৷

খানিকটা পথ এগিয়ে রাস্তার বামপাশ থেকে টাংগাইলের বিখ্যাত পোড়া বাড়ীর চমচম কিনলাম এবং রাস্তার ডান পাশে ফলের দোকান থেকে একশত লিচু নিলাম৷

হঠাৎ দেখি একবৃদ্ধা মহিলা ছোট একটা ছেলেকে কোলে নিয়ে দোকানদারকে বলছে, ভাই, আমাকে দুইটা আম দেও৷ এই যে ভাই, এদিকে দুইটা আম দিয়ো৷’ কয়েকবার বলার পর অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আমি তো টেকা দিয়াই নিমু৷ টেকা ছাড়া নিমু না, দেও না৷’

দোকানদার সহজ ভাষায় বলে দিলেন, এখানে খুচরো আম বিক্রি করি না, অন্য দোকানে যান৷

আমি একটু দাঁড়ালাম৷ বৃদ্ধা মহিলা চার-পাঁচটা দোকান ঘুরলেন, কোনো দোকানদার তাকে দুইটা আম টাকার বিনিময়েও দিলো না৷

বুঝতে পারলাম, মহিলাটি ভিক্ষুক৷ কোলের ছেলেটা বার বার আম চাচ্ছে৷ কিন্তু দোকানদাররা খুচরো না বেচার ছূতোয় তার কাছে দুইটা আম বিক্রি করছে না৷

বৃদ্ধা মহিলা একটা দোকানের কোণায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন৷ চুপচাপ কী যেন ভাবছেন৷ বুকে পাথর চাপা কষ্ট থেকে বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়লেন৷ দু’চোখের কোণায় পানি টলমল করছে৷ অশ্রুসিক্ত চোখ।

দোকানগুলোর সামনে থেকে মহিলা দূরে চলে যেতে চাইলে কোলে থাকা বাচ্চাটা জোরে কেঁদে দেয়৷ মহিলাটি বাচ্চার মুখে হাত দিয়ে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করছিলেন৷

আমি দ্রুত দোকানদারকে বললাম ভাই, ভালো দেখে দুই কেজি আম দেন৷

দোকানদার আম ওজন করছেন৷ ততক্ষণে মহিলা রাস্তা ওপাড়ে চলে যাচ্ছেন৷ আমি তাড়াহুড়া করে মহিলার কাছে গিয়ে বললাম, খালাম্মা, একটু এদিকে আসেন৷

দোকানে তাকে নিয়ে আসলাম৷ দুই কেজি আম হাতে দিলাম৷ আমের সাথে আমার হাতের ব্যাগ থেকে কিছু লিচুও বের করে দিলাম৷

মহিলা এক হাতে ছেলেকে আগলে রেখে আরেক হাতে পলিথিনটা হাতে নিলেন৷

আমাকে কিছু বলতে চেয়ে বারবার ঠোঁট নাড়াচ্ছিলেন৷ বিরবির করে কিছু বলতে চাচ্ছেন, কিন্তু মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না৷ দু’চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছিলো৷

বৃদ্ধা মহিলা আমার মাথার টুপি খুলে অনেক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন৷দোয়া দিলেন।

বাচ্চাটার দু’হাতে দুইটা আম তুলে দিলাম৷ সে মহা খুশি৷ মুহূর্তে কান্না থেমে গেলো৷

দোকানদার সব কিছুই দেখলেন৷ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ লিচুর দাম পুরাপুরি রাখলেন, কিন্তু দুই কেজি আমের দাম না রেখে এক কেজির দাম রাখলেন৷ আমি বললাম, ‘না, আপনি পুরো দুই কেজির দাম রাখেন৷’

জিজ্ঞেস করলাম, একটু আগে আপনি মহিলাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কেন? তিনি কি আপনার কাছে ফ্রী নিতে আসছিলেন? এসকল অসহায় মানুষদের কাছে টাকার বিনিময়ে দুইটা আম বিক্রি করতে আপনার মন কিভাবে বাঁধা দিলো?

‘আজ আমার কিংবা আপনার ছোট্ট ছেলে যদি এমনভাবে কাঁদতো, তাহলে কি সহ্য করতে পারতাম?’

দোকানদার লজ্জিত হলেন৷ মাথা নিচু করে বললেন, হুজুর, আসলে আমরা প্রকৃত মানুষ না৷ আমাদের মনে দয়া-মায়ার স্থান অনেক সংকীর্ণ৷ আমার ভুল হয়েছে, হুজুর৷

আপনার হাত ধরে ওয়াদা করছি, জীবনে এসকল মানুষদের সাথে রুক্ষ আচরণ করবো না,ইনশাঅল্লাহ।

মহিলাকে সালাম দিয়ে বিদায় করে দিলাম৷

দোকানদার আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন৷ কোথায় থাকি সেটাও জিজ্ঞাসা করলেন৷ ফোন নম্বর রেখে দিলেন৷

শেষে আসার সময় বললেন, হুজুর, আজকে আপনি আমাকে অনেক বড় একটা শিক্ষা দিয়ে গেলেন৷ জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা শিক্ষা পেলাম৷ আমার জীবনে এমন দৃশ্য আর দেখিনি।

দোকানদারকে বললাম, ভাইজান, একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন, সমাজের সকল অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি বিত্তবান মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব৷ এটা প্রশংসা করার বিষয় না৷ বরং দুআ করা দরকার যেনো আল্লাহ তাআলা এমন কাজ বেশি বেশি করার তাওফিক দেন৷

তাই আসুন, আমরা যারা উলামায়ে কেরাম- খুতবা-বয়ানের দায়িত্বে আছি, আগামীকাল জুমার প্রতিটি মেম্বার থেকে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করার আওয়াজ তুলি। মুসল্লিদেরকে এদিকে উদ্বুদ্ধ করি৷ তাহলে অবহেলিত মানুষের মুখে হাসি ফুটবে ইনশাআল্লাহ৷

[লেখকের ফেইসবুক ওয়াল থেকে নেয়া।]

পূর্ববর্তি সংবাদজনগণকে বাইরে রেখে তো দেশ চলতে পারে না: আমীর খসরু
পরবর্তি সংবাদঈদ উপলক্ষে বাদশা সালমান ও এরদোগান ফোনে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন