ইসলাম টাইমস ডেস্ক: পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ‘হিন্দুত্ববাদকে’ ‘বাঙালি সংস্কৃতিতে অপরিচিত’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রেক্ষাপটে রাজ্যের গেরুয়াবিরোধী বুদ্ধিজীবীরা ‘বিভক্তিসূচক ধর্মীয় রাজনীতির বিষ’ প্রশমিত করার জন্য নাগরিক আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা করছেন। এ বিষয়ে ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সাউথ এশিয়ান মনিটর।
সুবীর লিখেছেন, বিশ্লেষকেরা বলছেন, লোকসভা নির্বাচনে চমকপ্রদ সাফল্য লাভের পর আসন্ন রাজ্য বিধান সভা নির্বাচনে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ দখল করার হুমকি বাংলার সেক্যুলার মানসিকতার কাছে অপরিচিত সর্বব্যাপী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আগ্রাসী ধরণটি বিকশিত হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দীপঙ্কর দে বলেন, দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কাশ্মিরের চেয়েও খারাপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মমতা এখন বাঙালিয়ানা নিয়ে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন।
হার্ভার্ড অধ্যাপক সুগত বসু (তিনি আগের লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেস থেকে এমপি ছিলেন) ইতোমধ্যেই একটি অরাজনৈতিক ও উদার নাগরিক ফোরাম গঠনের প্রস্তাব করেছেন।
সুগত বসু মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের বলেছেন, বাংলার মহান উদার ও সেক্যুলার বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের শিকড় থাকা এই ধরনের ফোরামের উচিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মচালিত রাজনীতির ধ্বংসকর প্রভাব হ্রাস করার কাজে নেতৃত্ব দেয়া।
বসু বলেন, হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত হওয়া উচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের সাংস্কৃতিক উদ্দীপনায় এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক ধারায়।
চিত্তরঞ্জন ও সুভাস চন্দ্র উভয়েই কংগ্রেস থেকে বের হয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন।
সুগত বসু বলেন, নাগরিক আন্দোলনের উচিত হবে না দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতায় থাকা, তাদের উচিত হবে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের রাজনীতির বিরোধিতাকারী সব নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ করা।
বসু বলেন, জনগণের শ্রদ্ধাভাজন সেক্যুলার, উদার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের উচিত হবে এর নেতৃত্ব দেয়া।
ইতিহাসের এই অধ্যাপক বলেন, তিনি ইতোমধ্যেই বাংলায় গেরুয়া রাজনীতির অনুপ্রবেশের বিপদ নিয়ে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের সাথে আলোচনা করেছেন।
বসু বলেন, অমর্ত্য সেন খুবই উদ্বিগ্ন।
হার্ভার্ডের এই অধ্যাপক নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুর নাতির ছেলে। তার আরেক কাজিন চন্দ্র বসু বিজেপিতে যোগ দিয়ে লোকসভার নির্বাচনে অংশ নেন।
সুগত বসু তার কাজিনের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করেই বলেন, নেতাজির রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণ সেক্যুলার। তিনি যেভাবে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন, তাতেই তা দৃশ্যমান।
সুগত বসু বলেন, হিন্দুত্ববাদের সাথে নেতাজিকে বিভ্রান্ত করার কোনো অবকাশ নেই। তিনি কী জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তা আমরা সবাই জানি।
তিনি পশ্চিমবঙ্গের সেক্যুলার রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে তৃণমূল কংগ্রেসকে সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, সুযোগসন্ধানী ও খারাপ উপাদানগুলো থেকে দলকে মুক্ত করতে হবে।
আরএসএস-এর প্রভাব মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পক্ষ থেকে দুটি সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ সম্পর্কে সাউথ এশিয়ান মনিটর আরও জানায়-
আরএসএস মোকাবিলার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দুটি ক্যাডার সংগঠন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করছেন, চলতি গ্রীষ্মে প্রত্যাশার চেয়ে ভালো ফলাফলের জন্য বিজেপির চেয়ে আরএসএস অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে।
তিনি মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের বলেন, পুরুষদের সংগঠনটি ‘জয় হিন্দ বাহিনী’ ও নারীদের গ্রুপটি ‘বঙ্গ ললনা বাহিনী’ নামে পরিচিত হবে।
মমতা বলেন, আমরা আমাদের সংস্কৃতি দিয়ে আরএসএস ও বিজেপিকে মোকাবিলা করব। আমরা বিভক্তিসূচক ধর্মীয় রাজনীতির বিপদ সম্পর্কে আমাদের জনগণকে শিক্ষিত করে তুলব।
তিনি বলেন, নেতাজি আমাদেরকে ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান দিয়েছেন, আমরা এতে অটল থাকব।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে হিন্দুত্ববাদকে মোকাবিলা করতে সক্ষম আত্মনিবেদিত ও আপত দৃষ্টিতে অরাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনী প্রতিষ্ঠার এটি একটি বিলম্বিত প্রয়াস।
রবীন্দ্র সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ সচেতনা মজুমদার বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির ধারা খুবই গভীরে প্রবাহিত। আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা রবীন্দ্রনাথের জন্য পাকিস্তানে লড়াই করেছিল, ১৯৭১ সালে নজরুল ছিল তাদের ঠোঁটে। এবার এখানে আমরাও একই কাজ করব।
তিনি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ কেবল গান আর নাচের ব্যাপার নয়। তিনি আমাদেরকে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন। এ কারণেই আরএসএস চায় স্কুলের সিলেবাস থেকে তাকে অপসারণ করতে।
বাংলার উদার ও সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা মোটামুটিভাবে বামদের সমর্থক। তবে পরে তারা বাঙালি মূল্যবোধের ধারক মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি তাদের আনুগত্য সরিয়ে নেয়।
পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় লেখক সুনীল গাঙ্গুলি ছিলেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ। তিনি এমনকি ২০০২ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির চায়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তার রাজনৈতিক দর্শনের কারণে।
সুনীল এখন আর বেঁচে নেই, তবে তিনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় স্থানেই এখনো জনপ্রিয় লেখক।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যজনক ফলাফলের পর থেকে মমতা ব্যানার্জি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে বাংলায় অপরিচিত বলে অভিহিত করে আসছেন।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত বলেন, বাঙালিরা বিভক্ত জনগোষ্ঠী, তাদের অনেকে মনে হয় বিভক্তি-যুগের সহিংসতার স্মৃতিতে আক্রান্ত। আমরা আর বিভক্তিসূচক ধর্মীয় রাজনীতি চাই না।
ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার বলেন, আমাদের সংস্কৃতি সমন্বয়বাদী, বাংলায় বিভক্তি কখনো চূড়ান্ত বিষয় নয়, অন্তত আমাদের চেতনায়।
দাসগুপ্ত বলেন, এমনকি হিন্দুত্ববাদী আইকন ড. শ্যামা প্রাসাদ মুখার্জি চল্লিশের দশকে ফজলুল হকের মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মন্ত্রিসভায় যোগ দিযেছিলেন।
বিজেপি যেদিন পশ্চিমবঙ্গে একটির পর একটি আসন পাচ্ছিল, সেদিন কবি শঙ্খ ঘোষ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেল এটিএনকে বলেন, বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে, এখানেই আমার শিকড়।
বিজেপির বাংলাদেশবিরোধী উচ্চকণ্ঠের বাগাড়ম্বড়তা ও পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) বাস্তবায়নের হুমকিকে অনেকে ভালোভাবে নিচ্ছে না।
আসামে এনআরসির ফলে প্রায় ৪০ লাখ বাঙালি বাদ পড়েছে। মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিজেপি দলত্যাগের মাধ্যমে মমতার সমর্থক ঘাঁটি ভাঙার পরিকল্পনা করার প্রেক্ষাপটে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই তৃণমূল নেতা হিন্দুত্ববাদী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দীর্ঘ ও তিক্ত সংগ্রাম করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন।
তিনি ঘোষণা করেছেন, আমরা রাস্তায় রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব।
বিজেপির সমর্থক ও শীর্ষ মডেল পায়েল রোহতগি সম্প্রতি বাঙালি রেনেসাঁর প্রতিষ্ঠাতা রাম মোহন রায়কে ব্রিটিশদের চামচা হিসেবে গালি দিয়েছেন।
এটা বাংলায় ক্রোধের সৃষ্টি করেছে, আশঙ্কা করা হচ্ছে যে হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেড পরিকল্পিতভাবে বাঙলার আধুনিকতাকে ধ্বংস করে ফেলবে।
মোদি শপথগ্রহণের সময় উত্তর কলকাতার শিল্প বেল্টে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে গেরুয়া সমর্থকেরা মমতার গাড়িবহরকে বাধা দেয়।
মমতা তখন চিৎকার করে বলেন, আমি যদি বেঁচে থাকি, তবে দেখে নেব, তোমরা কত দূর যাও। বাঙলা হবে আমাদের।
রাজ্য বিধান সভা নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র দুই বছর।
ওয়ালবেঙ্গলের এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘আমরা রাম নই, রাম মোহন। আমাদের ঐতিহ্য হলো যুক্তিকে সমুন্নত রাখা, পুরানকাহিনী ও এর ভিত্তিতে সৃষ্ট ধর্মীয় ঘৃণাকে নয়।’
