মুহাম্মদ মুরসির কী ‘অপরাধ’ ছিল?

ড. আবদুস সালাম আজাদী।।

কিছুক্ষণ আগে ( সোমবার,  ১৭ই জুন ২০১৯)  সারা বিশ্বের পরিচিত এবং গত সাত আট বছরে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত ব্যক্তিত্ব ডঃ মুহাম্মাদ মুহাম্মাদ মুরসি ঈসা আল আইয়াত কারান্তরীন অবস্থায় এবং কোর্টে তার বিরুদ্ধে আনা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার শুনানি অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন বলে খবর এসেছে । ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

শুনানি কালে তিনি বিচারকের কাছে কথা বলার সময় চান। তখন তিনি ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল। ২৫ মিনিট এক নাগাড়ে কথা বলেছেন মিশরের মাটি ও মানুষের জন্য, তার ও তার দলের অবদান নিয়ে। ২৫ মিনিটের মাথায় দেখা গেলো তিনি একটু থেমে গেছেন। অমনি পড়ে গেলেন। এবং এইভাবেই তিনি বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন ও জান্নাত দান করুন।

মুহাম্মদ মুরসি ৮ই আগস্ট ১৯৫১ সালে মিশরের আলশারক্বিয়্যাহর আল আদওয়াহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আব্বা ছিলেন কৃষক। আম্মা ছিলেন সাধারণ গৃহিনী। দুই বোন, তিন ভাই। তিনি প্রাথমিক, সেকেন্ডারী নিজ এলাকায় পড়েছেন। পরে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং- এ প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রী নেন। এর পর ১৯৭৫-৭৬ -এ তিনি মিশর সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। ১৯৭৮ সনে একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স নেন। ছাত্র জীবনে তিনি এতই মেধাবী ও সম্ভাবনাময় ছিলেন যে পি এইচ ডির জন্য তিনি সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেবারের সেরা স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন। এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে তিনি ১৯৮২ সালে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।

তিনি কায়রো ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা দিয়েই তার অধ্যাপনা জীবন শুরু করেন, পরে সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৯৮৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, এমনকি নাসার মত প্রতিষ্ঠানেও তিনি খুব সুনামের সাথে স্পেস শ্যাটল ইঞ্জিন উন্নয়নে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন। এরপর নিজ প্রদেশের যাক্বাযিক্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৮৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন। তিনি পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তার বিভিন্ন আর্টিকেল  দুনিয়ার নামকরা বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি ১৯৭৭ সাল থেকেই ইখওয়ানুল মুসলিমীনের একজন সক্রিয় সদস্য। ১৯৭৯ তে তিনি ব্যাপকভাবে এই আন্দোলনে জড়ান। সদস্য পদ গ্রহন করেন ১৯৯২ সালে। ১৯৯৫ ও ২০০০ এ পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইখওয়ানের পক্ষে লড়েন, এবং এমপি হিসেবে ইখওয়ানের পার্লামেন্টারিয়ান দলের নেতৃত্ব দেন। তিনি ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত এমপি হন অথচ তার পরিবর্তে তার বিরোধীকে জয়ী দেখানো হয়। তিনি ছিলেন মিশরীয় পার্লামেন্টের এই শতকের খুবই নামকরা পার্লামেন্টারিয়ান।

২০১১ সালে আরব বসন্তের ধাক্কায় মিশর যখন ভেঙে পড়ে, তিনি তখন অনেক বড় ভূমিকা পালন করেন। ইখওয়ানের শুরা মেম্বর ছিলেন তিনি। তা সত্বেও এখওয়ানকে বুঝিয়ে সর্বদলীয় একটা মোর্চা “ফ্রীডম এন্ড জাস্টিস” দল গঠন করতে সক্ষম হন, এবং তার দলকে বিজয়ের মুখ দেখান।

২০১২ সালের নির্বাচনের আগে ইখওয়ান তাদের নেতা খায়রাত আশশাতেরকে প্রসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থিতা ঘোষণা করে। পরে তারা মুহাম্মাদ মুর্সিকেও প্রার্থি হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়, যেন খায়রাতকে বাতিল করা হলে তাকে ইখওয়ান সমর্থন দিতে পারে। ইখওয়ানের ভয়টাই ঘটে যায় মিশরে। তারা ইখওয়ানের প্রার্থীকে বাতিল ঘোষণা করে।

কিন্তু ইখওয়ান মুরসীকে সমর্থন দিলে কোন কিছুই আর করতে পারেনি। নির্বাচন হয়, আহমাদ শাফীক ও তার মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়, এতে দুইজনের কেউ ই ৫০% ভোট পায়নি। ফলে দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের ফল প্রকাশ নিয়ে হয় শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র। এক পর্যায়ে দুই জনই মিশরের সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বলে দাবী করেন। অবশেষে সকল ষড়যন্ত্রের অর্গল ভেদ করে নির্বাচন কমিশন ২০১২ সালের ২৪ জুন রবিবার মুরসীকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। তার প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৫১.৭% তার বিপরীতে আহমাদ শফীক পান ৪৮.৩% এই ঘোষণার কয়েক ঘন্টার পরেই তিনি তার দল ইখওয়ান ও ফ্রীডম ও জাস্টিস পার্টি থেকে নিয়ম অনুযায়ী পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালের ৩০শে জুন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।

তিনি বহুবার রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ২০০৬ এর ১৮ই মে তে তাকে আটক করে ৭ মাস জেলে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে তিনি ছাড়া পান। ২০১১ এর ২৫ জানুয়ারির আরব বসন্তের আন্দোলনের দায়ে ২৮ জানুয়ারি তাকে আটক করা হয়। এর পর থেকে তার ছেলে মেয়ে ও পরিবারের উপর নেমে আসে নানা ধরণের বিপদ আপদ।

মুহাম্মাদ মুরসী ১৯৭৮ সনে সাইয়েদাহ নাজলা মাহমূদকে বিয়ে করেন। তাদের সুখি পরিবারে আল্লাহ ৫ সন্তান দান করেছেন। আহমাদ, শায়মা, উসামাহ, উমার ও আব্দুল্লাহ। তিনি তিন নাতি নাতিন ও দুনিয়ায় দেখে গেছেন।

তিনি ক্ষমতায় আসার পরে যে সব কাজ করেছেন তার উপর একটা নির্মোহ পর্যালোচনা আমি তার পতনের পরে করেছিলাম। এবং আমার পেইজে তা তুলে ধরেছিলাম। সেটাকে আমি আবার আমার পাঠকদের সামনে আনতে চাচ্ছি।

তিনি মিশরকে উন্নত কারার বেশ কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। যেগুলো শত্রুদের চোখে ছিলো মারাত্মক ভুল। হয়ত তার জন্যই তাকে আজ এইভাবেই মৃত্যুবরণ করতে হলো। সেই পদক্ষেপগুলো ছিলো-

১। ক্ষমতায় এসেই মুরসী অনেক গুলো দেশ ভ্রমন করেছিলেন। একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিল ঐ দেশগুলো মিশরের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। তিনি চীন দিয়ে শুরু করেছিলেন, এরপরে যান রাশিয়ায়। তৃতীয়বারে যান ব্রাজিল। তারপর পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা। গেলেন সৌদি, কাতার, আরব আমিরাত। কিন্তু ভুলেও তিনি আমেরিকার দিকে তাকান নি, আমেরিকায় যাওয়ার নিয়তও করেননি। এমন কি যে আমেরিকার টাকা মিশরের সেনাবাহিনীকে পেট মোটা করতে সাহায্য করলো, সেই আমেরিকার প্রতি খুব কঠিন দৃষ্টিতে কয়েকবার তাকায়েছেন তিনি। যার জন্য তাকে আমেরিকা বিশ্বাস করতে পারেনি।

২। গত নভেম্বর ২০১২ সালে গাযাতে ইসরাইল কর্তৃপক্ষ জোর করে অভিবাসনের চেষ্টা করে। ফিলাস্তিনের আন্দোলনকারী যোদ্ধারা হামাসের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এবং এক অসম যুদ্ধ শুরু হয়। এর নাম ছিলো “হিজারাতুস সিজ্জিল”। যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ইসরাইলের কলজে ঝলসে যাওয়া শুরু হয় মুরসীর জন্য। সিংহের মত হুংকার ছাড়েন মুরসী-“ মনে রেখ ফিলাস্তিনেরা একা নয়”। তিনি দ্রুততার সাথে তেলাবীব থেকে মিশরীয় দূতাবাস প্রত্যাহার করে নেন। তার প্রধানমন্ত্রী কিনদীলকে গাযাতে পাঠালেন সাহায্যের চিহ্ন স্বরূপ। যিনি হামাসের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে পরিপূর্ণ ঐকমত্য ঘোষণা করে আসেন। খুলে দেন রাফাহ সুড়ংগ। এবং দ্রুত যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য করেন ইসরাইলকে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি আরব বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতার মর্যদায় উন্নিত হলেন, আর অন্যান্য নেতাদের মনে ঢেলে দিলেন হিংসার আগুন। আমেরিকার কয়েকটি জার্নালে তখন মুরসীকে আরবের একমাত্র ইসলামি নেতা হিসেবে উল্লেখ করে, টাইমস তাকে পৃথিবীর প্রথম ১০০ নেতার মর্যাদায় ভূষিত করে।

৩। সুয়েজ খালের উন্নয়নের জন্য তিনি বিরাট অংকের বাজেট নির্ধারণ করেন। এতে অর্থনীতিবিদরা মনে করলন, আগামি ২০২২ সালের মধ্যেই এখান থেকে মিশরের আয় ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তাই যদি হয়, মিশর পৃথিবীর উন্নত দেশ সমূহের কাতারে দাঁড়িয়ে যাবে। আর এটা হলে আরব দেশগুলোতে আমেরিকার মাতবরীতে আসবে মারাত্মক বাঁধা। এ ছাড়া ইসরাইলের সিনাই পরিকল্পনাও ভেস্তে যাবে। আমেরিকার খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবি নোয়াম চমস্কি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এক সেমিনারে বলেন, মুরসীর সুয়েজ খালের ডেভলপমেন্ট প্লান বাস্তবায়ন হলে আরব আমিরাতের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে দুবাইয়ে, মারাত্মক ধ্বস নেমে আসবে। কারন দুবাই ও আবু ধাবির সীপোর্টগুলো তখন মূল্য হারিয়ে ফেলবে। ফলে আমেরিকার অর্থনীতিতে দুবাই থেকে আসা সুবিধা লুপ্ত হবে। টানাটানিতে পড়বে সবাই। কী মারাত্মক পরিকল্পনা ছিলো মুরসী সাহেবের!!

৪। তিনি ক্ষমতায় যেতে না যেতেই সিনাই এ উন্নয়ন কাজ শুরু করে দেন। সিনাই এ আছে মিশরের ৩১% ভূমি। এর কোন উন্নয়ন এতদিন হয়নি। এই ভূখন্ড উন্নত হলে মিশরে ইনকাম দ্বিগুণ হয়ে যাবে । চাকুরির সুযোগ পাবে হাজার হাজার বেকার। ফলে তিনি চার দশমিক চার বিলিয়ন ডলার বাজেট করেন ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে। মিশরের সেনা বাহিনীকেও এ এলাকার উন্নয়নে শরিক রাখতে দুই দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার বাজেটের ঘোষণা দেন। ‘ফাইরুয মিলিয়ন সিটী’ নামে এখানে বসবাসের সমস্ত সুযোগ সহ উন্নত ও বিশাল শহর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। সিনাইএর উত্তর ও দক্ষিণে দুইটি ইউনিভার্সিটি তৈরি করার জন্য অফিসিয়াল কাজও শুরু করেন তিনি। ঘোষণা দেন ছাত্র রিক্রুটিং এর জন্য দারুন স্কলারশিপের।

৫। মুরসীর চিন্তা ছিল মিশরকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ করা। কাজেই ক্ষমতায় গিয়ে দেরী না করেই নতুন খাদ্য গুদাম বানানো শুরু করেন তিনি। তিনি কৃষকদেরকে চাষের কাজে উৎসাহিত করার জন্য বহু রকম সহযোগিতা ও ঋণ দান কর্মসূচি গ্রহন করেন। মনে রাখা দরকার মিশর আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশী খাদ্য আমদানি করা রাষ্ট্র। ২০০৯ সাল থেকে মিশর শিকাগো থেকে দশ মিলিয়ন মেট্রিক টন গম আমদানি করে। খাদ্য আমদানির সাড়ে চুয়াল্লিশ ভাগ আমেরিকা থেকে, বাইশ দশমিক সাত ভাগ অস্ট্রেলিয়া থেকে, বার দশমিক সাত ভাগ ইউরোপ থেকে, তিন দশমিক ছয় ভাগ কানাডা থেকে এসে থাকে। এই দেশগুলো এক সাথেই আই এম এফ কে মিশরে কোন ধরণের অর্থ দিতে নিষেধ করে। সমস্ত আরব রাষ্ট্রগুলোকেও নির্দেশ দেয়া হয় মিশরকে যেন এক পয়সাও ঋণ সাহায্য না দেয়া হয়। মুরসীর এতবড় পদক্ষেপ তারা সহ্য করতে পারেনি।

৬। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার জন্য তিনি প্রাথমিক, সেকেন্ডারি এবং হাইয়ার সেকেন্ডারি লেভেল গুলোতে পাশ্চত্য সিলেবাস বাতিল করার পদক্ষেপ নেন। শুধু তাই না পাশ্চত্যের মানের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার নির্দেশ দেন তিনি। যাতে মিশরের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রাধান্য থাকতো বেশি।

৮। তিনি এরদোগানের হাতে হাত রেখে মুসলিম বিশ্বের ‘জি-এইট’ কে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালান। এরই ফলশ্রুতিতে তুরস্কের সাথে এক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এতে করে মিশরের বাজার তুর্কির জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। এবং তুর্কির সাথে মালায়েশিয়ার বড় বড় উনভেস্টমেন্টের দরোযা খুলে যেতে থাকে। মিশর কে উন্নত পর্যায়ে নিতে তার এই পদক্ষেপ ওরা কেউ মানতে পারেনি।

[লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে।]

 

পূর্ববর্তি সংবাদমুরসির জানাযা ও দাফন সম্পন্ন
পরবর্তি সংবাদচীনের সিচুয়ান প্রদেশে ভূমিকম্পে নিহত ১২, আহত ১২৫