জনসম্মুখে হত্যা: দর্শকের দায় কী, ঈমানের দাবি কী

তাওহীদুল ইসলাম তাইয়িব  ।।

হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় বা খারাপ কাজ দেখে সে যেন নিজ হাতে, শক্তি প্রয়োগ করে তা রোধ করে। সম্ভব না হলে মুখে বাধা দেয়। তাও সম্ভব না হলে মন থেকে সেই কাজকে ঘৃণা করে। এটি (অর্থাৎ শেষোক্ত পন্থাটি) দুর্বলতম ঈমানের বিষয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ৭৮

আমাদের সমাজে নিত্যদিন বহু অন্যায় ও খারাপ কাজ সংঘটিত হয়। এবং না চাইলেও আমাদেরকে এসবের মুখোমুখি হতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের জন্য পরিস্থিতি সত্যিই অনেক কঠিন হয়ে যায়। বিগত দিনের কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, এই পরিস্থিতিতে অধিকাংশ মানুষই শুধু নীরব দর্শক হয়ে থাকে। কেউ কেউ দূরে সরে যায়। আবার কেউ ঘটনাটিকে ভিডিও করায় উদ্যোগী হয়।

কয়েক বছর আগে ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবরে সিলেটের এমসি কলেজ প্রাঙ্গণে খাদিজা নামের এক শিক্ষার্থীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে এক ছাত্র। সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, দূর থেকে অনেকেই ঘটনাটি দেখছিলেন। দূরে দাঁড়িয়ে কেউ কোপানোর দৃশ্যটি মোবাইলে ভিডিও করলেও আক্রান্ত খাদিজাকে রক্ষায় কেউই এগিয়ে আসেনি। প্রায় তিন বছর পর একই ঘটনা দেখা গেলো বরগুনাতেও।

গত বুধবার (২৬ জুন) স্ত্রীর সামনেই রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে রামদা দিয়ে কোপাচ্ছিল দুর্বৃত্তরা। সেখানেও দেখা যায় চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক মানুষ নৃশংস ঘটনাটি দেখছিল। দূর থেকে কেউ দৃশ্যটি ভিডিও করেছে। আসলে এই জাতীয় পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? চোখের সামনে এমন নৃশংস ঘটনা কোনো পাষাণ হৃদয় মানুষের পক্ষেও তো সহ্য করা সম্ভব নয়। সামাজিক দায়বোধ থেকেও তো চারপাশের মানুষের এগিয়ে আসা উচিত।

একজন নাগরিকের কাছে অন্য নাগরিকের এতটুকু পাওনাও কি থাকে না? কিন্ত মনে হয়, এই জাতীয় পরিস্থিতিতে মানুষ নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি আগে ভাবে। এগিয়ে গেলে পরবর্তী পরিস্থিতি কি হতে পারে তা নিয়ে সে নানামুখী সঙ্কায় পড়ে যায়। একদিকে আহত হবার শঙ্কা, দুর্বৃত্তের চোখে পড়ে পরবর্তী সময়ে তার রোষানলে পড়ার শঙ্কা। অন্যদিকে ঘটনার অনিশ্চিত প্যাঁচে পড়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে দোষী হবার শঙ্কা। অন্তত হেনস্থা হবার ভয়। এসব কারণে হয়ত মানুষ এগিয়ে যেতে চায় না। কিন্তু তাতে কি দর্শক নিজের দায় ও কর্তব্য এড়িয়ে যেতে পারে?

বিষয়টিকে যদি আমরা একটু ভিন্নভাবে দেখি, নির্যাতিত ব্যক্তি যদি আমার আপন ভাই বা বাবা হন কিংবা এমনই নিকটতম কেউ, তাহলে কি পারবো শুধু নীরব দর্শক হয়ে থাকতে? পারবো শুধু ভিডিও ধারণ করেই ক্ষাণ্ত হতে? ইসলাম তো আমাদেরকে বলে, এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য তেমনি যেমন এক দেহ দুই প্রাণ। আরো বলে, মুমিন মুমিনের জন্য একই দালানের দুই অংশের ন্যায়। এক অংশ অপর অংশকে মজবুত করে। এসব বক্তব্য থেকে তো তাই বুঝা যায় যে, এক মুমিন অপর মুমিনের যে কোনো বিপদে ছুটে আসবে। অন্যের বিপদকে নিজের বিপদ মনে করে উত্তরোনের চেষ্টা করবে। প্রাণপণ সাহায্য করবে।

আলোচ্য প্রেক্ষাপটে এই হাদীসের বাস্তবায়ন যাদের কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, একটু ভাবুন তো যদি উপরোক্ত দুই ঘটনায় চারপাশের সবাই এগিয়ে আসত –কেবল এক দুইজন নয়- তাহলে অবস্থা সামাল দেওয়া সম্ভব হতো কি না! এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে যেসব শঙ্কা ভয় রয়েছে সবাই ছুটে এলে সেই শঙ্কা ভয় থাকতো কি না! এমনকি এ জাতীয় ঘটনায় সবাই ছুটে আসার সম্ভাবনা থাকলে দুর্বৃত্তরা এমন দুঃসাহস আদৌ করত কি না! সর্বোপরি ঘটনার শিকার যদি নিজে হতাম বা আমার ঘনিষ্ঠ কেউ হত তাহলে আমার মনোভাব কি হতো? বিষয়গুলো সত্যিই ভাববার মতো।

যারা প্রতিবাদের দুর্বলতম পন্থা ভিডিও ধারণের কাজ করে, যদি তা উপভোগের জন্য না হয় বা শুধুই ভিডিও করার জন্য করা না হয় তাহলে তাদের কাজটিও প্রতিবাদ হিসাবে গণ্য হতে পারে। কারণ এই ভিডিও নিঃসন্দেহে পরবর্তী প্রতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপরন্তু এমন পরিস্থিতিতে ভিডিও করাও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়।

সেইসঙ্গে রাষ্ট্রকে অবশ্যই এগিয়ে যাওয়া ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এবং মানুষের মাঝে নৈতিক, মানবিক ও ঈমানী চেতনা তৈরির জন্য চেষ্টা করতে হবে। নয়তো দিনদিন সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যেতে পারে। বিজ্ঞ মহল আশা করি এ বিষয়ে ভাববেন।

পূর্ববর্তি সংবাদরাশিয়ার সাবমেরিনে অগ্নিকাণ্ড: নিহত ১৪ নাবিক
পরবর্তি সংবাদচট্টগ্রামে `শ্যামলী’ বাসের ধাক্কায় সিএনজির চালকসহ নিহত ২