জামিয়া ইসলামিয়া সেহড়া : ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীনতম দ্বীনী প্রতিষ্ঠান

তারিক মুজিব ।।

জামিয়া ইসলামিয়া সেহড়া মোমেনশাহী। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীনতম দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ময়মনসিংহ অঞ্চলে দ্বীনের প্রচার ও ইসলামি আদর্শ বিস্তারে এ প্রতিষ্ঠানের অবদান ব্যাপক। মাদরাসাটি ময়মনসিংহ জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র চরপাড়ায় অবস্থিত।

বৃটিশ ভারতের আমল থেকেই ময়মনসিংহ অঞ্চল ছিল সমৃদ্ধ। ঐতিহ্যগতভাবে দেশের যেসকল এলাকায় ইসলামের চর্চা ও দ্বীনের শিক্ষা বেশি ছিল, ময়মনসিংহ জেলা তার অন্যতম। ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থ রক্ষায় এ অঞ্চলের মানুষের ত্যাগ ও কুরবানী অনেক।

গত শতকের ৪০- এর দশকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ.- এর অন্যতম শিষ্য বড় মসজিদের ইমাম সাহেব হুজুর খ্যাত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ. এবং মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ.। ময়মনসিংহের মানুষের মাঝে এ দুই বুযুর্গের প্রভাব অনেক বেশি। শহরের প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত যেসকল মাদরাসা, তার অধিকাংশ তাদেরই প্রতিষ্ঠিত।

জামিআ ইসলামিয়া মাদরাসাটি যেখানে অবস্থিত সে জায়গাটি ছিল একজন দ্বীনদার মহিলার। তিনি সেখানে একটি মাদরাসা করার বাসনায় তার স্বামীকে শহরের বড় মসজিদের ইমাম মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ.-এর কাছে পাঠালেন। হুজুরের কাছে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কথা জানানো হলে তিনি মাওলানা মঞ্জুরুল হক সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে বললেন।

বৃটিশরা আলেম নিধনকে উপমহাদেশে তাদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সেজন্য অপকৌশলে রাষ্ট্রীয় অনুদানে চলা উপমহাদেশের বিশেষত বাংলা অঞ্চলের মাদরাসাগুলোকে বন্ধ করে দেয়। ১৯ শতকের মাঝামাঝি অংশে দেওবন্দে দারুল উলূম প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশে দ্বীন রক্ষা ও সম্প্রসারণের নতুন উদ্দীপনা যোগায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভারতবর্ষের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বে দেওবন্দী ধারার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় গত শতকের চল্লিশের দশকে জামিআ ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠা।

১৯৪২ সাল। দুয়েকজন উস্তায এবং অল্প কয়েকজন ছাত্র নিয়ে মাওলানা মঞ্জুরুল হক সাহেব দারুল উলুম নামে এ মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় তার সহযোগী ছিলেন মাওলানা আশরাফ আলী রহ.। যিনি পরবর্তীতে মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ. মাদরাসার পরিচালনার জন্য অনেক মেহনত করেন। উস্তাযদের বেতন প্রদান এবং ছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য তাকে অনেক খাটতে হয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলে কওমি ধারার প্রথমদিকের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা হওয়ায় অল্পকিছু দিনের মধ্যেই বিভিন্ন এলাকা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তালেবে ইলম দ্বীন শিক্ষার জন্য এখানে আসতে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে ১৯৬৪ সালের দিকে হাদীসের পাঠদান শুরু হয়। এসময় মাদরাসার মোহতামিম ছিলেন মাওলানা নূর উদ্দীন সাহেব। দীর্ঘ পঁচিশ বছর তিনি মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৪ সালে দিকে মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিস চালু করা হলে বড় হুজুর বা ইমাম সাহেব হুজুর নামে পরিচিত মাওলানা ফয়জুর রহমান সাহেব এবং মাওলানা জালালুদ্দীন কোরায়শী সাহেব কিছুদিন নিয়মিত হাদিসের দরস প্রদান করেন।

১৯৭৬ সালে মাদরাসার আমূল পরিবর্তন হয়। দারুল উলূম থেকে মাদরাসার নামকরণ করা হয় জামিআ ইসলামিয়া নামে। মাদরাসার দৃষ্টিনন্দন সাততলা ভবনের ভিত্তি তখনই স্থাপিত হয়। এসময় শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা এবং পাঠদান পদ্ধতিতেও ব্যপক পরিবর্তন আসে। এর নেপথ্যে ছিলেন মাওলানা আতহার আলী রহ.। বৃটিশ ভারত ও পরবর্তী পাক শাসনামলে দেশের রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে যারা ছিলেন কিশোরগঞ্জের আতহার আলী রহ. ছিলেন তাদের অন্যতম। সিলেটে জন্ম নেওয়া এই মহীরুহ ছিলেন হাকীমুল উম্মতের খলিফা।

মাওলানা আতহার আলী রহ-এর কবর।

স্বাধীনতা-উত্তর স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুরোধে মাওলানা আতহার আলী রহ. ময়মনসিংহে থেকে যান। তিনি শহরের দ্বীনদার মানুষদের সাথে পরামর্শ করে এবং তাদের সহযোগিতা নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই মাদরাসার কাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনেন। ছয় মাস সময় তিনি ছিলেন মাদরাসার প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং ৬ অক্টোবরে ইনতিকালের পর এ মাদরাসায়ই তাকে দাফন করা হয়। তখন মাদরাসার মোহতামিম ছিলেন মাওলানা মিঞা হোসাইন রহ.।

সত্তর বছরের ইতিহাসে ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রায় দশজন বিশিষ্ট আলেম মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। হবিগঞ্জের মাওলানা তাফাজ্জুল হক, ময়মনসিংহ বড় মসজিদের বর্তমান ইমাম ও খতিব মাওলানা আবদুল হক, কিশোরগঞ্জ জামিআ ইমদাদিয়ার মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ সাহেবসহ দেশ বরেণ্য অনেক আলেম এ প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করেছেন। মাদরাসার বর্তমান মোহতামিম মাওলানা আনোয়ার সাহেব।

ইফতা বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগে বর্তমানে মাদরাসায় প্রায় আটশত ছাত্র দ্বীনী ইলম অর্জন করছে। মাদরাসার নাজেমে তালিমাত মাওলানা সাইদুল ইসলামের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

পূর্ববর্তি সংবাদএবার কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহকে গ্রেফতার করল ভারত
পরবর্তি সংবাদবিশেষ কতগুলো লক্ষ্য স্থির করেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি: প্রধানমন্ত্রী