শায়খুল হাদীস কুতুবউদ্দীন রহ. : জীবনের প্রথম বেলায় শুনেছি যে নাম

শরীফ মুহাম্মদ ।।

কিংবদন্তিতুল্য একজন উস্তায আলেমেদ্বীন ছিলেন তিনি। ছিলেন প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল সময়ের শায়খুল হাদিস। আমাদের সময়ের বহু বরেণ্য আলেমের উস্তায। হযরতুল আল্লাম ইউসুফ বানুরি রহ.-এর খাস শাগরেদ। মহান এই মণীষীকে নিয়ে স্মৃতির পথে কয়েক কদম হাঁটতে চাইলে আমাকে যেতে হবে একটু পেছনে, একটু পারিবারিক প্রসঙ্গে।

একজন আধুনিক শিক্ষিত সাধারণ যুবক ছিলেন আমার আব্বা। চালচলন, বেশভুষায় পুরোপুরি আধুনিক। ১৯৬৯ সনের দিকে তাঁর বয়স যখন চব্বিশ হবে, তখনই দীনদারীর জীবনে প্রবেশের সৌভাগ্য হয় তাঁর।  এরপর থেকে সমকালীন ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক গড়ে তোলেন।  বিভিন্ন জনের কাছে যাতায়াত করেন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় অনেকের দ্বারাই হন প্রভাবিত।  বড় বড় বুযুর্গদের কাছে গিয়ে বসে থাকেন।  অনেককেই আবার দোকান কিংবা বাসায় দাওয়াত করে আনেন। তাদের কথা শুনেন, তাদের কথা অন্যদের বলেন।  এরকম যে কজন বুযুর্গের গল্পকথা বড় হতে হতে আমরা শুনেছি,  তাঁদের অন্যতম হযরত মাওলানা কুতুবউদ্দিন রহ.।

শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা কুতুবউদ্দিন রহ. জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সনে।  তাঁর বাড়ি সিলেটের কানাইঘাটে।  ১৯৭০/৭১ সনের দিকে তাঁর সঙ্গে আমার আব্বার বয়সের ব্যবধান সম্ভবত ছিল ১০ থেকে ১১  বছর। এর চেয়ে বেশি হবে না। অপরদিকে সিলেটের মানুষ হওয়ায় এবং মাহফিল-মজলিসে ওই বয়সে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ না করায় হযরত মাওলানা কুতুবউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আব্বার পরিচয় গড়ে ওঠার সহজ কোনো উপায় ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু হযরত মাওলানা কুতুব উদ্দিন রহ. একদিকে ছিলেন কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়ার উস্তাদ আবার একইসঙ্গে ময়মনসিংহ বড় মসজিদের সাবেক পেশ ইমাম ও বড় হুজুর হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ. -এর সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। পরবর্তী সময়ে তাঁর খেলাফতও লাভ করেন।  আব্বা যুবক বয়সেই হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ. -এর হাতে বাইয়াত হয়েছিলেন। কিশোরগঞ্জের হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর বিশেষ ভক্ত ও অনুরক্তও ছিলেন।  আমার ধারণা, এই সূত্র ধরেই হযরত মাওলানা কুতুবউদ্দিন রহ.-এর সঙ্গে আধুনিক শিক্ষিত দ্বীনদার যুবক আমার আব্বার একটি শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে।  এ নামটি শৈশবে আমরা বারবার শুনেছি। যেমন শুনেছি, সিলেটের আরেক বরেণ্য বুজুর্গ হযরত মাওলানা নুরুদ্দিন গহরপুরী রহ.-এর নাম।

আমাদের শৈশবে যে কজন বুজুর্গের নাম শুনে আমরা সম্মোহিত হতাম, দেখা না হলেও চুম্বকের মতো আকর্ষণ অনুভব করতাম, হযরত মাওলানা কুতুবউদ্দিন রহ. তেমনি একজন  ছিলেন। শৈশবে শোনা এরকম স্বর্ণোজ্জ্বল নাম আরও ছিল। হজরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ., হজরত মাওলানা আতহার আলী রহ., হজরত মাওলানা আরিফ রব্বানী রহ., হজরত মাওলানা নূরুদ্দীন রহ., হজরত মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ., হজরত মাওলানা আশরাফ আলী রহ., তাবলিগ জামাতের হজরত মাওলানা উসমান গণি রহ., হজরত মাওলানা আবদুল আযীয রহ., ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মুকীত রহ. এবং আমাদের নানা হজরত মাওলানা জালালুদ্দীন কোরায়শি রহ.। এ নামগুলো কায়দা-আমপারা পড়ার যুগেই আমাদের কানের কাছে বারবার উচ্চারিত হতো।

দুই.

মাওলানা কুতুবউদ্দিন রহ. ছিলেন উস্তাযুল আসাতিযা, শায়খুল হাদিস। একজন প্রজ্ঞাবান আলেমে দ্বীন হিসেবে ওলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার মহলে বরেণ্য ছিলেন। ইসলামী অঙ্গনে তার নাম উচ্চারিত হতো শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, সম্মানে। কিন্তু শৈশব কিংবা কৈশোরের শুরুর দিকে তাঁকে দেখার সুযোগ আমাদের হয়নি।  শুধু নামটাই শুনতাম। তাঁকে দেখার সুযোগটি ঘটে আমার শেষ কৈশোরে। ময়মনসিংহে কিংবা সিলেটে নয়, ঢাকায়।

তাঁকে আমি প্রথম দেখেছি ১৯৮৮ সনে।  ঢাকা ফরিদাবাদ মাদরাসায়। শরহে বেকায়া পড়তাম সে বছর।  তখন বেফাকুল মাদারিসের অফিস ছিল ফরিদাবাদ মাদরাসায়। বছরের শুরু থেকে একরুমের সে অফিসে টেবিলে মাথা গুঁজে একজন মানুষকেই কাজ করতে দেখতাম। তিনি মাওলানা আব্দুল জব্বার রহ.। কিন্তু বছরের শেষ দিকে পরীক্ষার আগে আগে দেখলাম, বেফাক অফিস মুখরিত হয়ে উঠেছে।  সেখানে তরুণ বয়সী কিছু আলেম কাজ করছেন। আর তাদের মধ্যে রয়েছেন বয়সে প্রবীণ একজন আলেমেদ্বীন। নামাজের সময় বের হয়ে মসজিদে আসতেন এবং মসজিদ থেকে আবার অফিসে ফিরে যেতেন।  ওই সময়টাতেই দূর থেকেই তাঁকে দেখতাম।  আমার পরিচিত এক বড় ভাই একদিন বললেন, তিনিই হচ্ছেন হযরত মাওলানা কুতুবউদ্দিন সাহেব। বেফাকের নাযেমে ইমতিহান হিসেবে তখন বেফাক অফিসে দায়িত্ব পালন করছেন। সেই তাঁকে প্রথম দেখা। সাধারণ স্বাস্থ্যের মোটামুটি দীর্ঘদেহী মানুষ। অনুচ্চ স্বরে কম কম কথা বলেন। শ্যামল বর্ণের মানুষটির মাথায় কিসতি টুপি। আগে থেকেই বুকের ভেতর শ্রদ্ধা জমে ছিল। এরপর থেকে শ্রদ্ধাভরা চোখে দূর থেকে তাঁকে প্রায় দিনই দেখতাম। কাছে গিয়ে সাক্ষাৎ করার সাহস পেতাম না।

একদিন ওই বড়ভাই আমাকে হযরতের সঙ্গে আব্বার পরিচয় দিয়ে দেখা করিয়ে দিলেন। মুচকি হেসে তিনি কথা বললেন।  আব্বার নাম নিয়ে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করলেন। আর সংক্ষিপ্ত নসিহতের মধ্যে আমাকে বললেন, ভালোভাবে লেখাপড়া করতে, ভালো আলেম হওয়ার চেষ্টা করতে।  নসিহত করলেন আরও বিভিন্ন বিষয়ে। কয়েকবার আব্বার নাম নিয়ে বললেন, গোলাম রব্বানীর ছেলে তুমি!

পরীক্ষার আগে এবং পরীক্ষা চলাকালের দিনগুলো ফরিদাবাদেই ছিলেন তিনি। এরপর ওই সময় আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। যতটুকু মনে পড়ে, তিনি তখন ছিলেন নারায়ণগঞ্জ আমলাপাড়া মাদরাসার শায়খুল হাদিস। বেফাকের প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে দু-আড়াই সপ্তাহের জন্য ফরিদাবাদ বেফাক অফিসে অবস্থান করেছিলেন।

তখন আমাদের স্মৃতিতে এ কথাগুলো জাগ্রত ছিল যে, জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে যখন তিনি উস্তাদ ছিলেন,  তখন তাঁর ছাত্র ছিলেন হযরত মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ,  হযরত মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ,  হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান হাফেজ্জী,  হযরত মাওলানা আব্দুল হক সাহেব। এঁরা সবাই ছিলেন আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন।  এই শ্রদ্ধাভাজনদের তিনি ছিলেন উস্তাদ। সে হিসেবে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার মাত্রা ছিল অনেক ঊর্ধ্বে।

তিন.

এরপর লম্বা একটা সময় আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। বিভিন্ন সময় কানে এসেছে যে তিনি অসুস্থ।  অসুস্থতার কারণে মাদরাসায় নিয়মিত দরস দেওয়া ও মাদরাসায় অবস্থান করা তাঁর জন্য কঠিন। এজন্যই তিনি বেশিরভাগ সময় সিলেটের বাড়িতে থাকেন। ২০০৬ সনের দিকে হঠাৎ একটি প্রোগ্রাম হয় এবং উপলক্ষ দাঁড়িয়ে যায় বিশেষভাবে তাঁকে কেন্দ্র করে সিলেট যাওয়ার।  তখন তিনি অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। আমার কাছে এই প্রোগ্রাম ও উপলক্ষটাকে অনেক বড় একটি সৌভাগ্যেরই উপলক্ষ মনে হয়।

উপলক্ষটা ছিল ময়মনসিংহের হজরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ.-এর ওপর স্মারকগ্রন্থের জন্য লেখা, অনুলিখন ও সাক্ষাৎকার সংগ্রহ। ঢাকা থেকে তিনজনের একটি কাফেলা তৈরি হলো। কাফেলার প্রধান হলেন স্মারকের উদ্যোক্তাদের অন্যতম মাওলানা মাহবুবুল হক ভাই। তার সঙ্গে আমি এবং আমাদের একজন অভিভাবক মাওলানা মুহাম্মদ যোবায়ের মামা। তিনি স্মারকের একজন লেখক, আর সিলেট দরগাহ মাদরাসায় হজরত মাওলানা কুতুবউদ্দীন সাহেবের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। উস্তাদ-শাগরেদের এই নিসবতেই তিনি এই সফরে যুক্ত হতে বিশেষভাবে উৎসাহী হলেন। আমরাও তাকে পেয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলাম। আর সিলেট থেকে আমাদের কাফেলায় যোগ দিতে অপেক্ষা করছিলেন তখনকার বেফাকের কর্মকর্তা মাওলানা মাসউদুর রহমান ভাই। মাওলানা মাসউদ ভাইয়ের আম্মা হচ্ছেন হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ.-এর মেয়ের দিকের নাতনি।  সেই মাসউদ ভাই বেফাকের পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ওই সময়টাতে ছিলেন সিলেটে।

আমার জন্য এটাই ছিল সিলেটে প্রথম সফর। ২০০৬ সনের ১৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে সিলেটের বাসে চড়ে বসি।  ফজরের আগ মুহূর্তে আমাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হয় দরগা গেট স্টপেজে।  সেখান থেকে রিকশায় আমরা চলে যাই খাসদবির দারুস সালাম মাদরাসায়। ফজরের নামাজ সেখানেই পড়ি।  ফজরের পর ওই মাদরাসার মুহতামিম এবং হযরত গহরপুরী রহ.- এর খাস শিষ্য মাওলানা আব্দুল আজিজ দয়ামিরী রহ.-এর সঙ্গে দেখা হয়।  অতিথিপরায়ণ, হৃদয়বান এই মানুষটি নাস্তার ব্যবস্থাসহ আমাদের গোটা সফরের নানা আয়োজন নিয়ে সহযোগিতা করেন।

চার.

আমাদের প্রথম গন্তব্য কানাইঘাটে শায়খুল হাদিস হযরত মাওলানা কুতুবউদ্দিন রহ- এর বাড়ি।  সকাল নয়টা- দশটার দিকে বাসে চড়ে বসি চারজন।  জুমার কিছুক্ষণ আগে আগে আমরা হযরতের বাড়িতে পৌঁছে যাই।  মাওলানা মাসউদ ভাই আগেই হযরতের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে রেখেছিলেন। সেই দিন এই মহান মানুষটিকে আরেকবার দেখার সুযোগ পাই। এবং সেটা অনেকদিন পর।  সানন্দে হাসিমুখ অভ্যর্থনা জানান তিনি আমাদেরকে।  মাওলানা যোবায়ের মামাকে পেয়ে বিশেষভাবে তিনি যেন অতীত যুগের শিক্ষক-ছাত্রের সময়টাতে ফিরে যান।

সেদিন আমি তাঁকে দেখে মুগ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা অবাকও হই। কারণ বাহ্যিক অবয়ব ও চলাফেরায় তাঁর অসুস্থতার বিশেষ কোনো আলামত আমার চোখে পড়েনি। প্রায় ১৮ বছর আগে তাঁকে যেমন দেখেছি ঢাকার ফরিদাবাদে, ঠিক তেমনটিই মনে হয়েছে।  তখনও জেনেছি, পরেও বুঝেছি,  আসলে তিনি অসুস্থতায় ঠিকই ভুগছিলেন, কিন্তু তাঁর সৌজন্যমূলক ও নিয়ন্ত্রিত আচরণ ও চলাফেরায় সে অসুস্থতার কোনো রকম প্রকাশই ছিল না।  এটা কোনো সাধারণ ব্যাপার ছিল না, এটা ছিল অনেক বড় এক শারাফাত ও উন্নত মানবিকতার বৈশিষ্ট্য।

হযরতের বাড়ির পাশেই গ্রামের মধ্যে সুন্দর একটি মসজিদ।  হযরতের পেছনে পেছনে খুতবা শুরু হওয়ার আগেই আমরা মসজিদে প্রবেশ করি।  নামাজের পর আবার তাঁর বাড়িতে ফিরে আসি।  আমাদের জন্য দস্তরখানের ব্যবস্থা হয়।  একই সঙ্গে কথা চলতে থাকে।  স্মিত হাসি মুখ নিয়ে টুকরো টুকরো ভাষায় কথা বলতে থাকেন। কিছু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ, কিছু দেশ, সমাজ ও অঙ্গনগত প্রসঙ্গ।  আর কিছু তো অবশ্যই ছিল স্মারকগ্রন্থ সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তরের কথোপকথন।  অত্যন্ত নিরুত্তেজিত ভঙ্গিতে তিনি কথা বলে চলছিলেন।

খুবই মুগ্ধতা ও বিষ্ময়ের সঙ্গে একটি বিষয় আমি লক্ষ করলাম।  পেছনের দিনের  বেশকিছু সুখ- দুঃখের প্রসঙ্গ এলো, খুবই স্মিত ভাষায় তিনি সেসব নিয়ে কথা বললেন।  হাসি হাসি মুখ, যেন হালকা স্বরে রসিকতা করছেন। এভাবেই কথা বললেন দুঃখ মেশানো প্রসঙ্গগুলি নিয়ে।  জীবনের এ এক অদ্ভুত সহজিয়াকরন। সবাই এটা পারেন না, যারা পারেন তারা সাধারণ মনস্তত্ত্বের অনেকটা উপরেই বাস করেন।

বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ.- এর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের শুরু, পরবর্তী সময়ের তাঁদের সম্পর্কের উন্নয়ন এবং বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধা মেশানো ভাষায় কথা বললেন। ১৯৭১ -এর পরপর ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁকেও কারাগারে থাকতে হয়েছে প্রায় দু বছরের মতো সময়।  ওই সময় ওই কারাগারে আরো ছিলেন হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ., এবং হযরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ., -আমি সেটা জানতাম। আরেকটি ব্যাপার জানতাম, ওই সময়ে এক রমজানে তিনি পুরো কোরআন শরীফ হেফজ করেছেন।  এই হেফজের বিষয়টি নিয়ে যখন প্রশ্ন করলাম,  তিনি যেন কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলন। যেন এ তথ্যটি প্রকাশ হয়ে যাওয়া বড় লজ্জার একটা ঘটনা! লুকোতে পারলেই বাঁচেন।  তারপর অনেকটা ‘ দায়ে ঠেকে’ জবাব দেওয়ার মতো করেই ঘটনাটি খুলে বললেন।  তারাবির প্রয়োজনে মুরুব্বিদের নির্দেশ ও দোয়ায় একদিন এক পারা করে তিনি হেফজ করেছেন এবং ওই পারাটিই ওইরাতে তারাবিতে পড়েছেন।  আল্লাহ তাআলা এই মহান মনীষীকে দিয়েছিলেন অসাধারন স্মৃতিশক্তি। দিয়েছিলেন ইবাদত ও নামাজের প্রতি নিমগ্নতার অসাধারণ গুণ-বৈশিষ্ট্য।

পাঁচ.

সফর, ক্লান্তি, দুপুরের দস্তরখান ইত্যাদি আমাকে পেয়ে বসেছিল।  বেশিরভাগ প্রশ্ন করছিলাম আমিই,  আবার মাঝেমাঝেই তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম।  আশ্চর্য ব্যাপার হলো,  এ নিয়ে আমার সঙ্গীরা সঙ্গত কারণেই একটু বিচলিত হয়ে উঠলেও হযরতের চেহারায় ছিল হাসিমুখ প্রশ্রয়।  তিনি ধরেই নিয়েছিলেন এই সিরিয়াস ও সংরক্ষণমূলক আলোচনাতেও আমার একটু-আধটু ঘুম যেন পেতেই পারে। হৃদয়শুদ্ধিমূলক ও পবিত্রতামন্ডিত এই মজলিস শেষ হয় আসরের সময়।  আসরের নামাজ হযরতের সঙ্গে আমরা ওই মসজিদেই পড়ি।  এরপর আবার নামি ফিরতি পথে।

ওইদিনের পর হযরত শায়খুল হাদিস মাওলানা কুতুবউদ্দিন রহ, -এর সঙ্গে আমি আর দেখা করার সুযোগ করতে পারিনি।  কিন্তু ওই দিনের ওই সফর ও মজলিস আমার স্মৃতিতে অক্ষত হয়ে আছে।  এমনকি কানাইঘাটে হযরতের বাড়িতে যাওয়া -আসার পথটুকুও নানা কারণে আমার স্মৃতি ও মানসে আজও ভাস্বর।  গ্রামে চলার পথে সাধারণ শিশুরা দলবেঁধে বারবার দ্বীনদার মানুষদের এভাবে সালাম দিতে পারে, এরকম দৃশ্য আমি খুব কম জায়গায় দেখেছি। কানাইঘাটে হযরত শায়েখ কুতুবউদ্দিন সাহেবের বাড়ির পাশে দেখেছি।  আর দেখেছি হযরত মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ.- এর বাড়ির পাশে কুমিল্লার পাহাড়পুর এলাকায়। অভিভূত হওয়ার মতো দৃশ্য। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বিপথগামিতা তৈরির এই সময়গুলোতে এজাতীয় দৃশ্য বড়ই আশাজাগানিয়া, বড়ই মধুর এবং একই সঙ্গে বড়ই স্মৃতি জাগরুক।

আরেকটি ব্যাপার ছিল চোখে পড়ার মতো।  সিলেট শহর থেকে গ্রাম এলাকার দিকে যাওয়া আসা করে সাধারণ লোকাল বাস। এসব বাসে নামাজের সময় যাত্রীদের নামাজ পড়তে বলে প্রায় দীর্ঘ একটি বিরতি দেওয়া হয়।  ফরজ-সুন্নত পড়ে চা খেয়ে বাসে উঠলেও কারো  চোখে কোনো ভ্রূকুঞ্চন দেখতে পাওয়া যায় না। জানি না, এদৃশ্যটি এখনও এমনই আছে কি না।

ছয়.

সেদিনটি ছিল ১৫ ডিসেম্বর।  রাতে আবার আমরা আশ্রয় নিই খাসদবির দারুস সালাম মাদরাসায়।  রাতে এক ভাইয়ের মোটর বাইকে চড়ে ঘুরে আসি দরগাহ মাদরাসা এবং হযরত শাহজালাল রহ,-এর কবর। পরদিন আমাদের সফর চলে হবিগঞ্জে।  এরপর রাতে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা। সে-ও আরেক স্মৃতিময় অধ্যায়।

আমাদের এই সফর এবং হযরত মাওলানা কুতুবউদ্দিন রহ.-এর সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটি ছিল ২০০৬ -এর ডিসেম্বরে। হযরতের ইন্তেকাল হয় ২০১৩ সনের ডিসেম্বরে। মাঝে প্রায় সাত বছর সময় তিনি হায়াতে ছিলেন।  প্রবীণ বরেণ্য এই আলেমেদ্বীন অসুস্থতার ক্লান্তি থেকে আর ফিরে আসেননি। কোনো মাদরাসায় কিংবা নিয়মতান্ত্রিক দ্বীনী দরসি খেদমতে নিজেকে যুক্ত করার মতো শারীরিক সক্ষমতা আর ফিরে পাননি। তবে মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতে হতো তাঁকে।  তখন কেবলই চিকিৎসার জন্য।  তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই থাকতেন।  তরুণ মুফতি আনোয়ার হুসাইন ভাইয়ের কাছে শুনেছি,  সে সব সময়ে তাঁর অনেক ছাত্রই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। বহুদিন পর তাঁর মেজ ছেলে মাওলানা রেজাউল করিম আবরারকে আমি পেয়েছি মারকাযুদ দাওয়াহর একটি আলোচনায়।  কেউ একজন মহান পিতার পরিচয়ে সেদিন তার পরিচয় দিলে আমার কাছে মনে হয়েছে, একজন মেধাবী হৃদয়বান আখলাকী আল্লাহওয়ালা আলেমে দ্বীনের একটি নিসবতের সঙ্গে আমার আবার দেখা হলো।

সেদিন নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে, আবার নিজেকে বড় অপরাধীও মনে হয়েছে। কারণ ততদিনে হযরত শায়খুল হাদিস কুতুবউদ্দিন রহ. এই নশ্বর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন।  অথচ এই মহান মানুষটির দুয়ারে গিয়ে আরেকবার হাজির হওয়া, হাসপাতালে তাঁর বিছানার পাশে গিয়ে ইয়াদাতের জন্য একটু দাঁড়ানোর মতো ‘ফুরসত’ করতে পারিনি।  একবারের জন্যও মনে জাগেনি, দেখা করার সুযোগটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আমাকে ক্ষমা করুন।

প্রিয় পাঠক, এই মহান মানুষ, এই কিংবদন্তি মুহাদ্দিস হযরত শায়খুল হাদিস কুতুবউদ্দিন রহ. ৬ বছর আগে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।  আমাদের সৌভাগ্য হবে, আমরা যদি তাঁর মাগফিরাত ও দারাজাত বুলন্দির দোয়ায় নিজেদের শামিল করতে পারি।

# ২২ সেপ্টেম্বর ।। ইসলাম টাইমস, পল্লবী

 

পূর্ববর্তি সংবাদ‘ক্যাসিনো-কাণ্ডে ধরা পড়া সবাই বিএনপি জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী’
পরবর্তি সংবাদদেশ ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলেন জি কে শামীম