ড. মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের প্রফেসর। সম্প্রতি জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনফারেন্সে যোগদান উপলক্ষে তিনি কাশ্মীর সফর করেন। সেখানের শিক্ষক, স্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও কাশ্মীরের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের সাথে ভারতীয় সংবিধানের -৩৭০ ধারার বিলুপ্তি ও কাশ্মীরীদের ভাবনা নিয়ে মতবিনিময় করেন। নিচের প্রবন্ধটিতে সে বিষয়েই আলোচনা করা হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী ।।
অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিল জম্মু কাশ্মীর আদিগতভাবেই ভারতের অংশ। ম্যাপে তাই দেখে আসছিলাম এতো দিন। গত ডিসেম্বরে কাশ্মীর সফরে গেলে নতুন কিছু তথ্য জেনে আমার ধরণার পরিবর্তন হয়। জানতে পারি, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় কাশ্মীর ছিলো স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র।
১৯৪৮ সালে স্বাধীন ভরতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বিভিন্ন কৌশলে তৎকালীন কাশ্মীরী নেতা শেখ আব্দুল্লাহকে রাজি করিয়ে বর্তমান কাশ্মীরকে ভারতের সাথে যুক্ত করে নেয়। নতুন যুক্ত প্রদেশ কাশ্মীরকে দেওয়া হয় স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদা। কাশ্মীরের আলাদা পতাকা রয়েছে, সংবিধানও রয়েছে। নিজেদের অর্থনীতি নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করে। রয়েছে নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতি। তাদের আইন ও বিচার পদ্ধতিও আলাদা। মোবাইল নেটওয়ার্ক বা সিমও আলাদা। রাজ্য ভাষাও হিন্দির পরিবর্তে উর্দু। কাশ্মীরীরা নিজেদের ভারতীয় না বলে কাশ্মীরী হিসেবেই পরিচয় দেয়। এমনকি ভারত-বাংলাদেশের মাঝে ক্রিকেট খেলায় মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেই সাপোর্ট করে। নতুন এ তথ্য আমাকে নাড়া দেয়।
বিষয়টি নিয়ে যখন গবেষণা করছি তখনই প্রকাশ পায় ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারাটি। এ ধারাই বলে দেয়, আসলেই কাশ্মীর স্বাধীন রাষ্ট্র ছিলো। ভারত সেখানে অতিরিক্ত মিলিটারী পাঠিয়ে কাশ্মীরীদের নিয়ন্ত্রনের নামে এ যাবত প্রায় এক লক্ষ কাশ্মীরীকে শহীদ করেছে।
৫ আগস্ট ২০১৯ তারিখটি কাশ্মীরের ইতিহাসে একটি কালো দিবস। পার্লামেন্টে বিল পাশ করে এ দিনে কেড়ে নেয়া হয় কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন। কাশ্মীরকে ভারতের সাধারণ অংশে পরিণত করা হয়।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর একটি কনফারেন্স উপলক্ষে জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হলে কাশ্মীরের শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের সাথে মতবিনিময়ের সুযোগ হয়। বুঝতে পারি, আমাদের ২৫শে মার্চের মতো ওদেরকেও জাগিয়ে দিয়েছে ৫ই আগস্ট। কদিন আগেও যারা, বিশেষত সরকারি চাকরিজীবীরা ভারতের সাথে মিশে যাওয়ার পক্ষে ছিলো তারাও আজ স্বাধীন হওয়াতেই কল্যাণ দেখছে। আরেক দল তো আগে থেকেই স্বাধীনতা চাচ্ছিলো। অনেক তরুণ মনে করেন, শেখ আব্দুল্লাহর সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো। তখন মুসলিম প্রধান এলাকা হিসেবে পাকিস্তানের সাথেই থাকা ভালো ছিলো।
অনেকে মনে করছেন, ভারতের সাথে থাকলে মুসলিম সংস্কৃতি ধরে রাখা কঠিন হবে। এখন যেখানে একটিও সিনেমা হল নেই সেখানে গড়ে ওঠবে অসংখ্য সিনেমা হল। বহিরাগত হিন্দুদের আধিক্যের কারণে মুসলিমরা হয়ে যাবে সংখ্যালঘু, তাই অনেক যুবক জানিয়েছেন কিছুতেই তারা মেনে নিবে না ভারতের শাসন।
দেড় মাস যাবৎ টেলিযোগাযোগ বন্ধ, ইন্টারনেট নেই। কারফিউ উঠিয়ে নেয়া হলেও চলছে একটু পর পর তল্লাশী। প্রায় ১০হাজার যুবককে আটক করে দূর-দূরান্তের জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। জানা যাচ্ছে না তাদের ভাগ্যে কী ঘটছে।
নারীদের সম্ভ্রম হারানো, যুবকদেরকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেয়া- এ সব মেনে নিতে পারছে না কাশ্মীরীরা। তাই এক কাশ্মীরী শিক্ষক তো মন্তব্য করলেন, “এখন ঘুর্ণিঝড়ের পূর্বের নিস্তব্ধতা চলছে”।
জম্মু এলাকা হিন্দু প্রধান। এখানের পরিবেশ সব সময় শান্ত। বরং জম্মুর অনেকেই চাচ্ছিল ভারতের সাথে যুক্ত থাকতে। কিন্তু এভাবে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার বিষয়টি তারা মেনে নিতে পারেনি। কয়েকজন হিন্দু ব্যবসায়ীর সাথে কথা বললে তারা আক্ষেপ করছিলো।
-৩৭০ ধারার বিলুপ্তি সম্মিলিতভাবে কাশ্মীরীদেরকে আযাদীর জন্য উন্মুখ করে তুলছে। যদিও বাংলাদেশীদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো শক্তিশালী কোন দেশের সহযোগিতা পাওয়া কঠিন আর আযাদীর স্বাদ গ্রহণ করারও আরও কঠিন। তবে শান্তিপূর্ণ, অবাধ নিরপেক্ষ গণভোটের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করার সুযোগ দেয়া হলে স্বাধীনতাকামীরাই জয়ী হবে তা স্পষ্ট হয়েছে এ সফরে।