ফিলিস্তিনে মুসলিম শাসকদের ঐতিহাসিক স্থাপনা: অতীত-বর্তমান কিছু দুর্লভ স্থিরচিত্র

ওলিউর রহমান ।।

কুদস। পবিত্রতম স্থান। কুরআনে কুদসকে বরকতময় স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কা-মদিনা ছাড়া আর যে শহরের দিকে সফর করতে হাদিসে বলা হয়েছে তা ‘কুদস’। নবীজীর মদিনায় হিজরতের পর দুই বছর পর্যন্ত কুদস মুসলমানদের কিবলা ছিল। সাহাবারা কুদস অভিমুখী প্রতিদিন সালাত আদায় করতেন।

উমর রাযি:-এর যুগে মুসলমানগণ কুদস বিজয় করেন। দীর্ঘদিন পর খ্রিস্ট বাহিনী কুদসের দখল নিলেও অল্পদিনের মধ্যেই সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী কুদসের দখল ফিরিয়ে নেন। তার পর থেকে বিশ শতকে উসমানি দাওলার পতনের আগ পর্যন্ত কুদস মুসলমানদের দখলেই থাকে।

দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে কুদসে অনেক মসজিদ, মাদরাসা, মুসাফির খানা ও নানা স্থাপত্যকর্ম নির্মিত হয়। মহান খলিফাগণ পবিত্র ভূ-খণ্ডের খাদেম হিসেবে সবসময় ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। খেলাফত যেই পরিচালনা করুন- উমাইয়্যা, আব্বাসীয়, মামলুক, উসমানীয়- কুদসের প্রতি সবার ছিল সজাগ দৃষ্টি। রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত অর্থায়নে খলিফাগণ সেখানে নির্মাণ করেছেন মসজিদ-মাদরাসা।

হাদিসের উপর আমল করতে মুসলমানরা যেতেন কুদস সফরে। থাকতেন খলিফাদের নির্মিত মুসাফিরখানায়। বহু নবীর জন্মভূমি বরকতময় কুদস যিয়ারতে ধন্য হতেন মুসলমানগণ।

তবে উসমানি দাওলার পতনের পর কুদসবাসীর উপর নেমে আসে দুর্দিন। প্রথমে ব্রিটিশরা শুরু করে কুদসবাসীর উপর নির্মম নির্যাতন। পরে পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট দখলদার ইসরায়েল শুরু করে মুসলিম উচ্ছেদ অভিযান। এখন কুদস কেবল মুসলমানদের কান্না ও মুনাজাতের অংশ।

ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় কুদসে। শহিদ করে দেওয়া হয় অনেক মসজিদ-মাদরাসা-সরাইখানা। ইয়াহুদিরাও কম যায় নাই কখনোই। প্রাচীন ঐতিহাসিক অনেক মসজিদকে গুড়িয়ে দিয়েছে মাটির সাথে। গড়ে তোলা হয়েছে সুরম্য শপিং মল। মসজিদকে নাইটক্লাবে পরিণত করার খবর পাওয়া গেছে পত্রিকায়। অস্তিত্বের প্রমাণ বিলুপ্ত করতে অনেক প্রাচীন দুর্লভ ছবিকেও পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্যও মানুষ দেখেছে।

তবে সম্প্রতি তুরস্কের ‘ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি গবেষণা বিভাগ’ শুরু করেছে নতুন উদ্যোগ। পবিত্র ভূমিতে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুসলিম স্থাপনাগুলোর ভগ্নাবশেষ মেরামতের উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে বিশ্ব মুসলিমের কাছে। তুরস্ক প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়িব এরদোগান এ কাজে সরাসরি সহায়তা করেছেন।

ইয়াহুদি এবং ব্রিটিশদের আক্রমণে শহিদ হয়ে যাওয়া অনেক স্থাপনার ঐতিহাসিক দুর্লভ ছবি সংকলন ও প্রকাশ মূলত তুরস্কের ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি গবেষণা বিভাগের প্রধান কাজ। ইতোমধ্যে ২০০৯ সালে ‘ফিলিস্তিন : অতীত বর্তমান’ নামে একটি এলব্যাম পুস্তক তারা প্রকাশ করেছে। সেখানে উসমানি খলিফা সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মাজিদের একটি ছবি সংকলন থেকে সহায়তা নেওয়া হয়েছে। প্রাচীন বিভিন্ন মুসলিম স্থাপত্যের গুরুত্বপূর্ণ নথিসহ ২০০৯ সালে প্রকাশিত এলব্যাম পুস্তকটি একটি ঐতিহাসিক দলিল।

অতীত
বর্তমান

এক.  আল মাদরাসাতুস সালাহিয়্যাহ। ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর শাসনামলে নির্মিত একটি মাদরাসা। খ্রিস্টানদের হাত থেকে পবিত্র ভূমি কুদসের দখল ফিরিয়ে আনার পর সুলতানের নির্দেশে এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। তদানিং মুসলিম বিশ্বের বিশিষ্ট আলেমদের নিয়োগ দেওয়া হয় এ মাদরাসায়। মাদরাসার জন্য ওয়াকফ করে দেওয়া প্রচুর সম্পত্তি।

ইংরেজ সরকার ১৯১৭ সালে মাদরাসার অবকাঠামোতে পরিবর্তন করে এটিকে গীর্জায় পরিণত করে।

 

অতীত
বর্তমান

দুই.  এই মসজিদটির প্রথম নির্মাণের ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের মত থাকলেও দৃশ্যমান নির্মাণ ৯৪৫ হিজরীতে উসমানি খলিফা সুলতান সুলাইমান আল কানুনীর শাসনামলে হয়েছে। আর ১৯০৭ সালে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল সুদৃশ্য মিনার। ছবিতে উড্ডীন দেখা যাচ্ছে মিনারের উপর উসমানি সালতানাতের চাঁদ-তারা খচিত পতাকা। তবে ১৯১৮ সালে মিনারটিকে বৃটিশ সরকার ধ্বংস করে দেয়।

 

 

তিন

তিন. ছবিটিতে কুদসের একটি অংশ দৃশ্যমান। ছবিটি উসমানি সালতানাতের শুরুর দিকের। ছবি বেষ্টিত এলাকাজুড়ে রয়েছে- ১০০০ বসত ভিটা, ২৬ টি মসজিদ, ৬৩ টি মাদরাসা, ১১ টি খানকাহ।

চার

 

চার.  সালাহুদ্দীন আইয়ূবী মিম্বার। সুলতান নুরুদ্দীন যিনকীর নির্দেশ ছিল- কুদস বিজয় হলে সালাহুদ্দীন আইয়ূবী যেন একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি ছিল তদানীং সময়ে নির্মিত বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট স্থাপনার অন্যতম। মসজিদের দেয়ালে কুরআনের আয়াতের কারুকার্য ছিল। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনাও খোদাই করা ছিল মসজিদের দেয়ালে।

১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট দখলদার ইসরায়েল সরকার ঐতিহাসিক এই মসজিদটিকে গুড়িয়ে দেয়।

 

পাঁচ

পাঁচ.  কুদসের সর্ববৃহত মিনার এটি। সুলতান বাইবার্সের নির্দেশে ১২৭৮ সালে এ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। নানা রকম কারুকার্য খচিত এ মিনারটির উচ্চতা ৩৮৫০ মিটার। ২০০২ সালে এটিকে পুন:নির্মাণ করা হয়।

ছয়

ছয়.  মাদরাসায়ে আশরাফিয়ার ছাত্রাবাস। মামলূক সুলতান আশরাফ বারসাভী ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে এই ছাত্রাবাস নির্মাণ করেন। পাশেই ছিল খলিফা বারসাভী নির্মিত মাদরাসায়ে আশরাফিয়া। ছাত্রাবাসটি সে যুগের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিযুগে নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯২২ সালে বৃটেন সরকার মাদরাসাসহ এ ছাত্রাবাসটিকে ধ্বংস করে ফেলে।

 

পূর্ববর্তি সংবাদ১৪ হাজার অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাকে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের বাড়ি দেবে সরকার
পরবর্তি সংবাদচট্টগ্রামে আ. লীগের সম্মেলনে সংঘর্ষ-ভাংচুর, আহত কয়েকজন