স্মৃতিতে সাদ্দাম হোসায়ন : সারা ইরাক চষে ফেলেও মার্কিনীরা দু’টি জিনিস পায়নি

আবু তাহের মেসবাহ ।।

মুহসিন বললেন, আমরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে যাচ্ছি। আদী ও কুছাঈ-এর গৃহশিক্ষক সেখানে আছেন। তিনি আপনার জন্য পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছেন। আমরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে পৌঁছলাম। অবাক হওয়ার বিষয়, এখানে আমাদেরকে সকালের মত কোন রকম নিরাপত্তা-পর্যবেক্ষণের সম্মুখীন হতে হলো না। আমাদের বসতে দেয়া হলো যে কামরায় আদী ও কুছাঈ গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছিলো।

তাদের ছবি দেখেছি গত বছর ইরাকী পত্রিকা ‘আলিফ-বা’-এর একটি সংখ্যায়। আজ সরাসরি দেখলাম। আলিফ-বায় প্রেসিডেন্টের ছেলেমেয়েদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিলো। তাতে পিতার প্রতি সন্তানদের অভিযোগ ছিলো যে, বাবাকে তারা অনেক সময় চোখের দেখাও দেখতে পায় না। সেদিক থেকে ঐ ইরাকী শিশুরা তাদের চেয়ে ভাগ্যবান যারা সবসময় বাবার সান্নিধ্য লাভ করে এবং যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারে।

আমি তাদেরকে সাক্ষাৎকারটির কথা স্মরণ করালাম। তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে শুধু মৃদু হাসলো; কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মনে হলো। কতই বা বয়স, কাছাকাছি দশবারো। কিন্তু মনে হলো, এখন থেকেই সুনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে ওঠছে। কথা, হাসি সবকিছু পরিমিত। গৃহশিক্ষকের সঙ্গে আচরণ সম্ভ্রমপূর্ণ। আমার ভালো লাগলো।

আজ সাতাশ বছর পর যখন এ সফরনামা লিখছি তখন আমার স্মৃতিপটে বারবার ভেসে ওঠছে আদী ও কুছাঈ নামের সেই বালক দু’টির ছবি, যারা মৃদু হেসে আমাকে বলেছিলো, বাংলাদেশ ইরাকের বন্ধুদেশ। আমি বলেছিলাম, শুধু বন্ধুদেশ নয়, ভ্রাতৃদেশও। আমরা সকলে ‘আল-উখুওয়াতুল ইসলামিয়্যা’-এর বন্ধনে আবদ্ধ। তখন তারা লাজুক হেসে বলেছিলো, অবশ্যই। সেদিন আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তাদের বালক বয়সের ব্যক্তিত্বে এবং সাহসিকতার অভিব্যক্তিতে।

যথাসময়ে ডাক এলো। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের সামনে। এটা তার নিজস্ব পড়াশোনার কামরা। বিরাট কামরা। তাকে তাকে অসংখ্য বই। প্রথম দর্শনেই আমি অভিভূত হলাম। প্রেসিডেন্ট কিছু পড়ছিলেন। তিনি চেয়ার থেকে উঠে এসে মুছাফাহা করলেন। আমি প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করে কথা শুরু করতেই, তিনি আন-রিক হাসির সঙ্গে বললেন, তুমি এখন ইরাকের রাষ্ট্রীয় মেহমান নও, সাদ্দাম হোসায়নের ঘরের মেহমান।

সকালের বৈঠকে সামরিক পোশাকে প্রেসিডেন্টের গর্বিত আসনেও তাকে মার্জিতরুচি ও সুশীল ব্যক্তি মনে হয়েছিলো, এখন ঘরোয়া পরিবেশে তাকে আরো খোলামনের, আরো আন-রিক মনে হলো। হায়, এ মানুষটি যদি অতীতের দিল্লীর শাসকদের মত কোন শায়খের ছোহবত লাভ করতেন, যদি সঠিক পথের সন্ধান পেতেন, তাহলে আরব ও মুসলিম জাহানের দুর্ভোগের কারণ না হয়ে হতে পারতেন গর্ব ও গৌরবের সম্পদ।

তিনি যে আরব আভিজাত্যের অধিকারী সেটি প্রমাণ করতেই যেন এই সামান্য সময়ের ফাঁকেও আমার সামনে পরিবেশিত হলো তাজা খেজুর ও ধূমায়িত কফি। আমি হযরতের পত্র অর্পণ করলাম। তিনি তখনই খুলে পড়লেন। তারপর বললেন, ‘শায়খকে আমার সালাম বলো, আর বলো, তাঁর ইখলাছ ও আন-রিকতাকে আমি শ্রদ্ধা করি।… ’

বিদায়ের সময় প্রেসিডেন্ট আমার হাত ধরে, সেই কামরা পর্যন্ত এলেন যেখানে আদী ও কুছাঈ পড়ছিলো এবং মুহসিন আমার অপেক্ষায় ছিলেন। প্রেসিডেন্ট আমাকে তার পুত্রদ্বয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি হাসির ছলে তাদের সাক্ষাৎকারের কথা বললাম। প্রেসিডেন্ট অবাক হয়ে বললেন, আচ্ছা, আমি জানি না তো! আদি, অথবা কুছাঈ, এখন মনে নেই; আমাকে ওর হাতের কলমটি উপহার দিয়েছিলো। শিস কলম, মাথায় ইলেক্ট্রনিক ঘড়ি ছিলো। আমি অবাক হলাম, প্রেসিডেন্ট তার পুত্রের পিঠ চাপড়ে বললেন, শোকরান! অর্থাৎ মেহমানের ইকরাম করায় তিনি খুশী হয়েছেন। আরব পিতার তারবিয়াত দেখার এটা ছিলো এক দুর্লভ সুযোগ। পরবর্তীতে অবশ্য এসুযোগ আরো অনেক হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের বাসভবন থেকে বের হওয়ার আগে একটা কথা আমি বলতে চাই। সারা বিশ্বের আলোচিত সমালোচিত এবং এখন পশ্চিমা- বিশ্বের কাছে ধিকৃত প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের বাসভবনে আসবাবপত্রের কোন বাহুল্য দেখিনি। তাঁর ধার্মিকতা প্রচার করার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অনেক পোস্টার ও বুকলেট প্রকাশ করা হলেও আমি তা দ্বারা প্রভাবিত হইনি, কিন’ আমাকে কেউ বলে না দিলেও স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, রাষ্ট্রীয় সম্পদে তার সামান্যতম হস-ক্ষেপও ছিলো না। পরবর্তীতে তো তা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেছে। কারণ সারা ইরাক চষে ফেলেও মার্কিনীরা দু’টি জিনিস পায়নি। গণবিধ্বংসী অস্ত্র এবং সাদ্দামের আর্থিক দুর্নীতি। অস্ত্রের ‘অ’ এবং দুর্নীতির ‘দ’ও যদি তারা পেতো, বিশ্বমিডিয়া তোলপাড় করে ছাড়তো। আসলে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধই সাদ্দামকে ফাঁসির রজ্জুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। নইলে আমরা সাদ্দামের যেসব বিষয়ের সমালোচনা করি, আমেরিকার চোখে সেগুলো তো সাদ্দামের গুণ।

একথা হয়ত পৃথিবী কোনদিন জানতে পারবে না যে, বন্দী সাদ্দামকে কতভাবে প্রলু্ব্ধ করা হয়েছিলো এই বলে যে, এখনো তুমি ইরাকের তেল আমাদের হাতে তুলে দাও, ইরাকের ক্ষমতা আমরা তোমার হাতে তুলে দেবো। তখন তোমার চেয়ে পছন্দের মানুষ আমাদের কাছে আর কেউ হবে না। কিন’ সাদ্দাম মুসলমান যতটুকুই ছিলেন, আরব ছিলেন পুরো মাত্রায়, আর ইরাকী ছিলেন আরো বেশী মাত্রায় এবং সেটাই হয়েছে তার জন্য কাল।

সংক্ষেপিত: লেখকের বায়তুল্লাহর  মুসাফির থেকে নেয়া

পূর্ববর্তি সংবাদঅবশেষে বিদায় নিচ্ছেন সামীম আফজাল, ইফার দায়িত্বে আ. হামিদ জমাদ্দার
পরবর্তি সংবাদচলে গেলেন আল্লামা আশরাফ আলী, জানাযা দুপুর ২.৩০ কুমিল্লায়