ওলিউর রহমান ।।
বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে সমবেত জনতা এবং সরকার ও জাতির উদ্দেশে দৃপ্ত কণ্ঠের ভাষণে মরহুম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক বলছেন, ‘ভারত অভিমুখে আমাদের এ মহান লংমার্চ বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন নয়। আমাদের এ লংমার্চ পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে মানবতার মহাযাত্রা। লংমার্চের কারণে এদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর আশঙ্কারও কোনো কারণ নেই। আমাদের এ লংমার্চ হবে অহিংস। আমাদের শ্লোগান হবে আল্লাহু আকবারের জিকির’।
২ জানুয়ারি, ১৯৯৩ সাল। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছেন। মুজাহিদে মিল্লাত মুফতি আমিনী রহ.-এর প্রস্তাবে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর ডাকা ভারত অভিমুখী বাবরি মসজিদ লংমার্চে যোগ দিতে ঈমানি চেতনায় উজ্জীবিত আপামর তাওহিদী জনতা সমবেত হয়েছেন বায়তুল মোকাররমে।
১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর। ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা এবং বিজেপির করসেবকরা শহিদ করে দেয় অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ। বাবরি মসজিদের দেয়ালে চালানো প্রত্যেকটি আঘাত বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে শেল হয়ে বিঁধে। ভারতে তখন কেন্দ্রীয় সরকারে ছিল স্যাকুলার দল কংগ্রেস। দেশটির তদানীং প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পাশবিক এ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে টু শব্দও করেনি।
তবে ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে উঠে ভারতীয় মুসলিম। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনাকে ভারতে নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে চূড়ান্ত আঘাত হিসেবে দেখে তারা। মুসলিম বিশ্বে তুমুল প্রতিবাদ শুরু হয় তখন। তদানীং সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়। পাকিস্তান, মালয়েশিয়াসহ অপরাপর মুসলিম দেশগুলোও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ঘটনার প্রতিবাদ করে। তবে ভারতীয় মুসলিমদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে সবচেয়ে জোড়ালো ভূমিকা পালন করে পাশের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বাংলাদেশের তাওহিদী জনতা। অযোধ্যার ঐতিহাসিক মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ইসলামি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ভারত অভিমুখে লংমার্চের ডাক দেওয়া হয়।
শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর ডাকা ভারতমুখী লংমার্চে যোগ দিতেই ১৯৯৩ সালের ২ জানুয়ারী জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জমায়েত হয়েছেন লাখো মানুষ। ‘আল্লাহু আকবার’ জিকিরের শ্লোগানে শ্লোগানে সমবেত জনতা ছুটে চলে ভারত-বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্তের দিকে। পথ চলার প্রতিটি এলাকা থেকে নতুন করে মিছিলে যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ। ঢাকা থেকে শুরু হওয়া লংমার্চ বিভিন্ন স্থানে পথসভা এবং যশোর বাসস্ট্যান্ডে সমাবেশ শেষে বেনাপোলের দিকে ১৬ মাইল পথ অতিক্রম করে ৪ জানুয়ারি ঝিকরগাছা পৌঁছলে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে মিছিলে বাধার সৃষ্টি করা হয়। দেশে তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। তাওহিদী জনতা নিজেদের ঈমানি দাবিতে আরও সামনে অগ্রসর হতে চাইলে পুলিশ ও বিজিবির যৌথ-আক্রমণের শিকার হয়। ‘নিরাপত্তাকর্মীদের’ গুলিতে হারুন, কামরুলসহ চারজন দ্বীনপ্রাণ মানুষ শহিদ হন। হতাহতের সংখ্যাও ১০০ ছাড়িয়ে যায়। ঝিকরগাছায় মাগরিবের নামায আদায়ের পর শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক লংমার্চ স্থগিত ঘোষণা করেন। সমবেত তাওহিদী জনতা সংঘবদ্ধভাবে পুনরায় ঢাকায় ফিরে আসে।
সেদিন তাওহিদী জনতার অগ্রযাত্রা যশোরের ঝিকরগাছায় গিয়ে বাহ্যত থেমে গেলেও বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ৯৩ সালের ভারত অভিমুখে লংমার্চ এবং পরবর্তী বছর তাসলিমা বিতাড়ন আন্দোলন দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যেই ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়। তদানীং ক্ষমতাসীন বিএনপি আলেমদের সাথে জোট করার পরিবল্পনা করে। বিরোধীদল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বেশ-ভূষা ও কৌশলেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
তাছাড়া বাংলাদেশের লংমার্চের ঘটনায় ভারতীয় মুসলমানরাও দারুণভাবে উজ্জিবিত হন। তাদের আত্মবিশ্বাস এবং হিম্মত বেড়ে যায়। নিজেদেরকে তাদের আর একা মনে হয় না। রাষ্ট্রীয় সকল বাধা উপেক্ষা তাদের পক্ষে কথা বলবার জন্য একটি ক্ষুদ্র শক্তির উপস্থিতি দেখে তারা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হন।