গানবাদ্য এবং শরিয়ত: বয়াতিদের আকিদা নিয়ে দুই আলেমের বিশ্লেষণ

ওলিউর রহমান ।।

গোনাহ করতে পারার যোগ্যতা ও প্রবণতা দিয়ে আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। গোনাহ করতে পারার যোগ্যতা সত্ত্বেও মানুষ কেবল আল্লাহর ভয়ে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকবে; এটাই অপরাপর প্রাণি থেকে মানবের শ্রেষ্ঠত্বের মূল রহস্য। কখনো গোনাহ হয়ে গেলে তওবা করে নিবে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, গোনাহ করে ফেলার পর তওবাকারীদের তিনি ভালবাসেন। গোনাহ করে ফেলা তো অন্যায় বটেই। তবে শরিয়ত যে কাজকে গোনাহের কাজ ধার্য করেছেন সেটিকে বৈধতা দানের চেষ্টা আরও ভয়াবহ অন্যায়। সরাসরি শরিয়তপ্রণেতার সাথে দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন।

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের শরিয়ত সরকার নামের এক বয়াতি গায়ককে ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তিমূলক ও আপত্তিকর বক্তব্যের কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন টাঙ্গাইলের ফরিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি।

মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে যে, শরিয়ত সরকার বয়াতি কয়েকদিন আগে ঢাকার ধামরাই এলাকায় এক অনুষ্ঠানে গানের আগে বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘গান-বাজনা হারাম বলে ইসলাম ধর্মে কোনো উল্লেখ নেই। কেউ প্রমাণ দিলে তিনি গান ছেড়ে দেবেন।’ এই বক্তব্য মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে।

শরিয়ত বাদ্যযন্ত্রসহ গানকে হারাম করেছে সাধারণভাবেই। এছাড়াও অশ্লীল কথাবার্তাও ইসলামের মৌলিক নিষিদ্ধ বিষয়ের একটি। সুতরাং বাদ্যযন্ত্রসহ বা অশ্লীল গান কখনোই শরিয়ত সমর্থিত হতে পারে না। গানের ব্যাপারে এটা মূলনীতিতুল্য কথা। এর বাইরে বয়াতিদের বিভিন্ন গানে থাকে হারাম হওয়ার বাড়তি উপাদান। বয়াতিদের সাধারণ প্রবণতা দেখা যায় ধর্মীয়করণ। নিজেদের অন্যায় কর্মকাণ্ডকে তারা ধর্মের আবরণ পরাতে সচেষ্ট থাকে। এর জন্য তারা আশ্রয় নেয় কুরআনের অপব্যাখ্যা, নিজেদের স্বপক্ষে বানিয়ে বানিয়ে হাদিস বলার মতো হীন কর্মকাণ্ডের। এছাড়া নামায, রোযা, পর্দার ব্যাপারেও বয়াতীদের অনেককে ভয়াবহ কথাবার্তা বলতে শোনা যায়। তাদের বেশিরভাগের আক্বিদা মারাত্মক ভুলের শিকার।

টাঙ্গাইলের শরিয়ত সরকার বয়াতিকে গ্রেফতারের ঘটনায় সামাজিক মাধ্যম এবং শিল্পী পাড়ায় শুরু হয়েছে মাতম। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেক মানুষকে বয়াতির পক্ষাবলম্বন করতে দেখা গেছে। ‘আধুনিক শিক্ষিত’ অনেক তরুণকে গানের ব্যাপারে বয়াতির চেয়েও আরও চটকদার ‘ফতোয়া’ হাজির করতে দেখা গেছে।

বাউল গান এবং বয়াতিদের বিশ্বাস

‘ধর্মীয় দৃষ্টিতে বয়াতিদের বাউল গান’ বিষয়ে ইসলাম টাইমসের সাথে কথা বলেছেন, তালিমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক বিশিষ্ট আলোচক মাওলানা লুৎফুর ফরায়েজী। তিনি বলেন, বাউলদের গানের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ শিরক এবং কুফরি কথা থাকে। বয়াতিদের ব্যাপারে জানতে আমি বাউল গানের কয়েকটি বই সংগ্রহ করেছি এবং তাদের কিছু গানও আমাকে শুনতে হয়েছে। আল্লাহ এবং নবীর শানে এমন সব উদ্ভট কথা তাদের গান ও বইয়ে রয়েছে যা মুখে আনা একজন সাধারণ মুসলমানের পক্ষে কখনোই সম্ভব হতে পারে না।

বয়াতিদের আক্বিদা প্রসঙ্গে মাওলানা লুৎফুর ফরায়েজি বলেন, বাউলদের গান এবং তাদের বই থেকে তাদের যে বিশ্বাসের ব্যাপারে জানা যায় তাতে তাদেরকে মুসলমান বলা শক্ত। তাদের অনেকেই নিজেদের লালন ফকিরের ভাবশিষ্য দাবি করে সকল ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে যেতে চায়। নিজেদের ‘প্রেমধর্মে’র অনুসারী দাবি করে। অথচ পবিত্র কুরআনে ইসলামকেই একমাত্র মনোনীত ধর্ম বলা হয়েছে। সুতরাং এ বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের উপর শরিয়তের হুকুম আরোপিত হবে।

মাওলানা ফরায়েজী বলেন, মারেফত তথা তাসাউফ বা আধ্যত্মবাদের কথা বলে তারা সরাসরি শরিয়তকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। বিভিন্ন গানে ও অনুষ্ঠানে শরিয়তকে নিয়ে কটাক্ষ করতে থাকে। এর স্বপক্ষে বিচ্ছিন্ন যত মত আছে সেগুলোকে হাজির করে। অথচ এসব মতের প্রবক্তাদের শরিয়তের সাধারণ বিধান অনুযায়ী কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তারা নিজেদের বক্তব্য প্রাণের কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা করে, বানিয়ে বানিয়ে হাদিস বলে। নিজেদের যাবতীয় অনাচারকে ‘মারেফতে’র চাদর পরিয়ে বৈধতা দিতে চায়। অথচ মারেফাতের মূল কথা হল, নিজেকে আল্লাহর দিকে অধিক মনোনিবেশ করা।

বাউলদের মুখরোচক গান এবং কথার কারণে অনেকেই ভ্রান্তির শিকার হয় জানিয়ে বিশিষ্ট এ আলোচক বলেন, গভীরভাবে উপলব্ধি ছাড়া বাউলদের সব গানের ত্রুটিগুলো চোখে পড়ে না। মুখরোচক কথাবার্তার কারণে অনেকে তাদের ভক্ত হয়ে যায়।

গ্রাম বাংলার সরল মানুষেরাই তাদের ভক্ত বেশি হয়। গ্রামের মানুষদের সরলতার সুযোগ নিয়ে বয়াতিরা তাদের অবস্থান মজবুত করেছে জানিয়ে মাওলানা লুৎফুর ফরায়েজি বলেন, দীর্ঘদিন যাবত বাউলরা তাদের অন্যায় কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। তবে সম্প্রতি মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হওয়ায় এখন আর তাদের ‘পূর্বের হাল’ নেই। তাই তারা ভীষণ চটেছে। প্রকাশ্যেই উলামায়ে কেরামকে ‘হুমকি-তাম্বিহ’ শুরু করেছে। আলেমদের উচিত বয়াতি বাউলদের ভ্রষ্টাচার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে আরও বেশি তৎপরতা চালানো।

ইসলামে গানের অবস্থান

শরিয়ত বয়াতি তার বক্তব্যে দাবি করেছে ইসলামে গান নিষিদ্ধ নয়। কুরআনে কোথাও গানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আসেনি। গানের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান জানতে কথা বলা হয় রাজশাহীর রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ড. মাওলানা ইমতিয়াজ আহমদের সঙ্গে। তিনি বলেন, শরিয়ত বয়াতির এ বক্তব্য ইসলাম ও শরিয়ত সম্পর্কে তার অজ্ঞতার পরিচয় তুলে দিয়েছে।

প্রথমত কোনো অন্যায় কাজ নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য কুরআনেই নিষেধ থাকতে হবে এমন কোনো কথা শরিয়তে নেই। শরিয়তের দলিল তো শুধু কুরআন নয়। বুখারি শরিফের হাদিসে সরাসরি গানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তিরিমিযী শরিফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, صوتان ملعونان، صوت مزمار عند نعمة، وصوت ويل عند مصيبة অর্থাৎ, দু’টি আওয়াজের ব্যাপারে অভিষম্পাৎ করা হয়েছে। তন্মেধ্যে একটি হল, বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ।

এছাড়া গান প্রসঙ্গে বুখারি শরিফে আছে ليكونن من أمتي أقوام يستحلون الحر والحرير والخمر والمعازف، ولينزلن أقوام إلى جنب علم، يروح عليهم بسارحة لهم، يأتيهم لحاجة، فيقولون: ارجع إلينا غدا، فيبيتهم الله، ويضع العلم، ويمسخ آخرين قردة وخنازير إلى يوم القيامة

তাছাড়া ইসলামের শুরু যামানা থেকেই বাদ্যসহ গানকে হারাম বলেই মানা হয়েছে। সুতরাং কুরআনে নেই এ কথা দ্বারা কোনো নিষিদ্ধ বিষয়েরর বৈধতা প্রমাণ করতে চাওয়া মুর্খতা ছাড়া কিছু নয়।

দ্বিতীয়ত, কুরআনে গানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নেই এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা। সূরা লুকমানে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, {وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّـهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا ۚ أُولَـٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ } এই আয়াতের গান-বাদ্যের ব্যাপারে কঠিন শাস্তির হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

এই আয়াতের তাফসিরে ইবনে কাসির রহ. হযরত ইবনে আব্বাস রাযি.-এর এই বক্তব্য নকল করেছেন, ‘এই আয়াত গান এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।

সূরা বনী ইসরায়েলের এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, {وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُم بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِم بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا} তাফসিরে জালালাইনে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এখানে ‘ছওত’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল গান।

অতএব কুরআনেও গান-বাদ্যের ব্যাপারে কঠিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সুতরাং কুরআনে গান নিষেধ করা হয়নি এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন মনগড়া বক্তব্য। এসব আয়াত ও হাদিস দ্বারা সাধারণভাবে বাদ্যযন্ত্রসহ এবং অশ্লীল সকলপ্রকার গানকেই হারাম বলা হয়েছে।

তাছাড়া শরিয়ত বয়াতিদের গাওয়া বাউল গান তো নানাবিধ কারণেই আরও ভয়াবহ রকমের হারাম। কারণ তাদের গানে বিভিন্ন কুফরি ও শিরকি কথাবার্তা অহরহ শোনা যায়।

তবে আল্লাহ এবং রাসূলের শানে প্রশংসামূলক যেসব হামদ-নাত পাঠ করা হয় এবং ভাল অর্থবহ যেসব নাশীদ বা সংগীত গাওয়া হয় তা শরিয়ত নিষেধ করেনি। শরিয়তে নিষেধ এসছে অশ্লীল, ফাহেশা, অনর্থক এবং বাদ্যযন্ত্রের গানের ব্যাপারে।

পূর্ববর্তি সংবাদমালয়েশিয়া থেকে পামওয়েল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত, সিএএ বিরোধিতায় অটল মাহাথির
পরবর্তি সংবাদপ্রথম বারের মত সংসদ থেকে ওয়াক আউট করল বিএনপি