আর কখনও শুনতে পাব না তার তেলাওয়াত

আবদুল্লাহ মারুফ।।

অবশেষে তিনি চলেই গেলেন। কাল থেকে বুকের ভেতর দপদপ করছিলㅡ কখন যেনো দুঃসংবাদ আসে, কখন যেনো!
আমাদের শাহ সাহেব হুজুরের শাহী মুখখানা বারবার আমার চোখে ভাসছিল। আমি আতঙ্কিত ছিলাম প্রতিটা মুহূর্ত। বারবার হুজুরের কথা মনে পড়তো আর ভেতরটা হু-হু ক’রে কেঁদে ওঠতো; তিনি চলে যাচ্ছেন! আল্লামা আনোয়ার শাহ সাহেব!
এই এখন, আমি যখন তাঁর নামটি লিখতে বসেছি আমার বুক ভেঙে আসছে, অনেক্ষণ আঁকিবুঁকি করছি, লিখতে পারি না কিছুই। শুধু কান্না পাচ্ছে। আর বারবার তাঁর কুরআন তিলাওয়াতের সেই মধুর আওয়াজ কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে; আল্লাহু আকবার! কী চমৎকার তিলাওয়াত!

শ্রোতাদের যথার্থ স্বর্গীয় আনন্দ দেয় এমন তিলাওয়াতের পরিধি বর্তমান বাংলাদেশে সংকীর্ণ, স্টাইলে উচ্চারণে অনেক উন্নত হয়েছে বহুজনের তিলাওয়াত, কিন্তু তাঁর মতো স্বর্গীয় আবেশমেখে অমন তিলাওয়াত আর ক’জন করে? এইখানেও তো তিনি বাদশা ছিলেন।

আমার মনে পড়ে, প্রথম যখন তাঁর তিলাওয়াত শুনি, সেই হিফজখানায় পড়ার সময় মনতলা হাফেজিয়া মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে; আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলাম অনিমিখ দৃষ্টিতেㅡ কী মধুর আওয়াজ, কী চমৎকার লাহজা!

তারপর শুধু এই নামটি খুঁজে বেড়াতাম পোস্টারে পোস্টারে, শুধু একটুখানি তাঁর তিলাওয়াত শুনবো বলে বহু জায়গায় গিয়েছি কাছেপিঠের মাহফিলে। জেনেছিলাম, চরপাড়ার জামিয়া ইসলামিয়ায় তিনি নিয়মিত আসেন, আমি যেতাম, অনেকবার তাঁর তিলাওয়াত শুনবার জন্যই গিয়েছিলাম জামিয়া ইসলামিয়ার মাহফিলে।
কিন্তু আমার এই মুগ্ধতা, হৃদয়ের মণিকোঠায় সযত্নে ধারণা করা কুরআনের এই কোকিলের নামটি যে দিনদিন আরও আকৃষ্ট করে চলছে আমায়ㅡ তাঁকে বলতে পারছিলাম না। বারবার চাইতাম, একটুখানি কাছে যাই। কিন্তু সুযোগ হতো না। ছোট বলে ঢুকতে দিতো না ভেতরে। তবুও আমি মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসতাম।

সেদিন হলো কি, হঠাৎ সংবাদ পেলাম কিশোরগঞ্জের আল্লামা আনোয়ার শাহ সাহেব হুজুর মালিবাগ জামিয়ায় এসেছেন। থাকবেন আজ রাতে, দস্তারবন্দী রুমে আছেন এখন। এই সংবাদ পেয়ে আমি জলদি দস্তারবন্দী রুমে গিয়ে সেই গভীর রাতেই মশার মতো চারপাশে ঘুরে ঘুরে প্রিয়ব্যক্তিটির শরীরের ঘ্রাণ শুঁকি; তিনি ঘুমোচ্ছিলেন। আমি একাকি কতোক্ষণ রুমে পায়চারি করে ফিরে আসি।

ফজরের সময় তিনি নামাজ পড়ান। থেমে থেমে মধুর কণ্ঠে কী অসাধারণ তিলাওয়াত! আজও আমি সেদিনের ওই ফজরের নামাজের স্বাদ অনুভব করি।

তারপর তো কাছে যাই। প্রথম দেখায় আমি কি বলেছিলাম মনে নেই, তবে মালিবাগ জামিয়ায় সেদিন বলেছিলামㅡ ‘ছেলেবেলায় নাকি আপনি দুষ্টু ছিলেন? অনেক দুষ্ট? ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন…।’ তিনি আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠলেন। তারপর শব্দ ভেঙে ভেঙে, পানমুখে মিষ্টি করে বললেনㅡ ‘দুষ্টু নয়, চঞ্চল বলতে পারো,ㅡ’

সেদিন তাঁর থেকে আমি মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে নিয়ে একটি লেখা নিই, তখন আমাদের স্মারকের কাজ চলছিল। তিনি হেরার জ্যোতি’র পুরাতন কিছু সংখ্যা দেখে ভালোমন্দ বলে নিজের পুরনো স্মৃতি, যেগুলো তোলা ছিলো সযত্নে, নামিয়ে খুলে খুলে আমাদের শুনাতে লাগলেন।

দীর্ঘ অনেক রাত পর্যন্ত আমরা গল্প করি। তাঁর সম্পর্কে, তাঁর বাবা হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে, তাঁদের পরিবার, পাকিস্তান আমলㅡ ইত্যকার নানান কথা জিজ্ঞেস করি। তিনি মিষ্টি করে করে বলেন, আমি অবাক হই, আমাদের মতো ছোটদের সঙ্গেও তিনি বন্ধুর মতো আচরণ করছেন! রুকন ভাই তো দুষ্টুমিও করলো, তিনি হাসেন, তারপর আবার সেখান থেকে নিজেও শুরু করেন! কী আশ্চর্য! বড়োরা বোধহয় এমনই হয়।

এইপ্রথম হুজুরের সঙ্গে আমার পরিচয়। জামিয়া এমদাদিয়ায় যাই যেনো, তিনি বলে যান। মাঝেমধ্যে ফোন করি। কিন্তু কিশোরগঞ্জে যাওয়া হয়নি আর, দেখা করতে পারিনি তারপর। অনেক ইচ্ছে ছিলো প্রিয় এই মানুষটির সোহবতে যাবো আরও, কিন্তু ভেঙে পড়লো; সবকিছু ভেঙে পড়লো। খসে পড়লো নক্ষত্রটি। এখন যে নিভে গেলো উজ্জ্বল আলো, থেমে গেলো সেই স্বর্গীয় সুর, আমি কার কাছে গিয়ে কানে কানে বলবো ‘আমার না আপনার তিলাওয়াত খুব ভালো লাগে, একটু শুনাবেন?!’
তিনি আর মুচকি হেসে বলবেন না, ‘এখন না’, তারপর কথা রক্ষার্থে ভেঙে ভেঙে শুরু করবেনㅡ কুরআনুল কারীমের তিলাওয়াত। কুরআনুল কারীমের আয়াত।
আহা, আর কখনও শুনতে পারবো না! তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এখন আর কোনওদিন শুনবো না সেই স্বর্গীয় সুর।

দিনদিন শুধু আমরা এতিমই হচ্ছি, আমাদের বড়োরা আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছেন। এভাবে যদি আমাদের বটবৃক্ষগুলোর ছায়া আমাদের ওপর থেকে সরে যায়, আমরা বাঁচবো কীভাবেㅡ হে প্রভু!
ঝড়ের মোকাবেলায় কে আমাদের পাশে দাঁড়াবে? ডানা মেলে কে নিজের পাখার তলায় আমাদের আগলে নিবে!ㅡ প্রভু, রহম করো!

লেখকের পেইজ থেকে নেয়া

পূর্ববর্তি সংবাদনির্বাচনি এলাকার উন্নয়নে ২০ কোটি করে বরাদ্দ দিবে সরকার
পরবর্তি সংবাদআল্লামা আহমদ শফীর ইমামতিতে দুপুর ২টায় শাহ সাহেবের জানাজা, এখনই জনস্রোত