সকালের গল্প, গল্পের সকাল

আদম আলী ।।

ফজরের পর ঘরের পরিবেশ একটু গুমোট হয়ে আছে। ‘তিনি’ ঘুমাচ্ছেন। ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছে করল না। প্রতিদিন নিজ ‎‎থেকেই এক কাপ চা তৈরি করেন। তারপর সেটিকে আমার টেবিলে রেখে দেন। এক কাপ চায়ে দুই ঘণ্টা ‎অনায়াসে কাজ করা যায়। আজ চা বানানোর কোনো লক্ষণ নেই। নিজেই চা বানাতে গেলাম। চা-টা খেয়ে ‎কম্পিউটার অন করে কেবল বসেছি, অমনি একটা ফোন এল। সকালে ফোন ধরতে ইচ্ছে করে না। এসব ‎‎ফোনে বেশিরভাগই ‘অনুরোধ’ থাকে। সেই অনুরোধ মেটাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। আজও তেমন ‎কিছু পেলাম। যা পেলাম, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। ‎

মাওলানা আবুল বাশার সাহেব হযরতের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। সম্ভবত ফজরের পরে রওনা হয়ে ‎আসতে একটু দেরি করে ফেলেছেন। মাদরাসার দপ্তরে বসে আছেন। এখনো হযরতের দেখা পাননি। এর ‎মধ্যে আমাকে ফোন করেছেন। তিনি দেখা হলেই একটা কথা বলেন। তার কথাটা আমার ভালো ‎লাগে―‘হযরতের এখানে এসে আপনাকে না দেখলে ভালো লাগে না।’ সৌভাগ্য আসলে এমনই! আমি ‎কাজ ফেলে ছুটে গেলাম। ‎

তিনি এখনো দপ্তরেই। দেখা হতেই জড়িয়ে ধরলাম। ভালো লাগার মানুষদের দেখতেও ভালো লাগে। কথা-‎বার্তা হচ্ছে। এবার তার সঙ্গে একজন নতুন মানুষ এসেছেন। আগে কখনো দেখিনি। হুযুর পরিচয় করিয়ে ‎দিলেন। তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী। যশোরে থাকেন। সেখানে একটা মাদরাসা পরিচালনা করেন। হযরত ‎‎সেই মাদরাসা সফরও করেছেন। আজ কোনো কারণে ঢাকা এসেছেন। এই সুযোগে হযরতের সঙ্গে দেখা ‎করতে চান। সঙ্গে অনেক কিছু হাদিয়াও এনেছেন। ‎

একটু পরেই ডাক এল। ব্যবসায়ী ভদ্রলোকসহ হুযুর ভেতরে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে আমিও। আমি এসেছি, ‎এটা হযরত জানেন না। তিনি আমাকে আসতেও বলেননি। এজন্য শঙ্কায় পড়ে গেলাম। থাকব, না চলে ‎যাব? ‎

হযরতের কাছে লুকানোর কিছু নেই। আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কি থাকব, না চলে যাব।’ ‎হযরত কিছু বলছেন না। আমার আশঙ্কা বাড়ছে। এরকম হুট করে আসা মনে হয় হুযুর পছন্দ করেননি। ‎এখন যেতেও বলতে পারছেন না। দুজন ধরে হযরতকে বসালেন। বসেই মাওলানা আবুল বাশার সাহেবকে ‎জিজ্ঞেস করলেন, ‘আদম আলী থাকবে, না চলে যাবে? আপনি বললে থাকতে বলব।’ ‎
‘হযরত, আামদের কোনো সমস্যা নেই,’ হুযুর বললেন। ‎
সুতরাং আমার জায়গা হয়ে গেল। ঘরে আমরা চারজন মানুষ। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক হযরতকে তার হাদিয়া ‎‎পেশ করে বললেন, ‘হযরত, এটা একটা শাল।’ ‎
হযরত বললেন, ‘আমার তো শাল আছে।’ ‎
‘এটা আমি কাশ্মির থেকে আপনার জন্য আনিয়েছি।’ ‎
হযরত নিলেন। কিছু বললেন না।‎

ব্যবসায়ী ভদ্রলোক হযরতের কাছে বাইআত হতে চান। মাওলানা আবুল বাশার সাহেব এজন্য হযরতকে ‎অনুরোধ করলেন। তিনি হযরতের একজন বড় খলীফা। হযরত তার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। ‎এরকম হঠাৎ অনুরোধে হযরত সাধারণত সাড়া দেন না। হয়তো তার তখন হাফেজ্জী হুযুরের কথা মনে ‎পড়েছে। হাফেজ্জী হুযুর রহ. হযরতকে তারই একজন বড় খলীফার অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে বাইআত করে ‎নিয়েছিলেন। ‎
বাইআত করানোর আগে হযরত সবসময় প্রস্তুতি নেন। অযু না থাকলে অযু করেন। মানসিকভাবেও তৈরি ‎হন। এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। একজন মানুষ নিজেকে পেশ করছে। তার আমল-আখলাক ‎সংশোধনের দায়িত্ব দিচ্ছে। সুতরাং প্রস্তুতি প্রয়োজন। এটা পীর সাহেবের জন্য যেমন, যিনি বাইআত ‎হবেন, তার জন্যও জরুরী। ‎

এজন্য হযরত সময় নিলেন। ঘরে গেলেন। একটু পরেই ফিরে এলেন। বাইআত করলেন। তারপর ‘কসদুস ‎সাবিল’ বইটি থেকে তাকে কিছু নসীহত করতে চাইলেন। কিন্তু পকেটে চশমা খুঁজে পেলেন না। বইয়ের ‎‎লেখা খালি চোখে এখন আর পড়তে পারেন না। হুযুরের চশমা দিয়ে চেষ্টা করলেন। হলো না। অগত্যা ‎আবার উঠলেন। বললেন, ‘আমি একা উঠতে পারি না। বসতে পারি।’ ‎

আমরা ধরে হযরতকে উঠালাম। এসময় ব্যবসায়ী ভদ্রলোককে বললেন, ‘মাওলানা আবুল বাশার সাহেব ‎আমার পীর সাহেবের মতো। এত বড় আলেম, আমার কাছে এসে বাইআত হয়েছেন! আমি ইংরেজি ‎শিক্ষিত মানুষ।’

তারপর মাওলানা আবুল বাশার সাহেবকে বললেন, ‘আপনি কিছু কথা আলোচনা করুন। বাইআত হওয়ার ‎প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু কথা বলুন। আমি আসছি।’ ‎

হযরত চশমা আনতে গেছেন। আবুল বাশার সাহেব চুপচাপ বসে আছেন। কিছু বলছেন না। আমি বললাম, ‎‘হযরত আপনাকে কিছু কথা বলতে বলেছেন। বলুন।’
‘আপনি থাকতে আমি কী বলব,’ আবুল বাশার সাহেব জবাব দিলেন। ‎

আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। এটা তিনি কী বললেন! তার কাছে প্রফেসর হযরতের কথা যেমন ‎‎লেগেছে, তার কথা আমার কাছে এমনই মনে হলো। একেকজন একেক স্তরের মানুষ। আল্লাহ তাদের ‎বিনয় থেকে আমাদের শেখার তাওফীন দিন! ‎

হযরত চশমা নিয়ে ফিরেছেন। তিনি কসদুস সাবিল থেকে কিছু অংশ পড়ে শোনালেন। এর মধ্যে নাস্তা ‎নিয়ে আসা হলো। নাস্তা খেতে খেতে মাওলানা আবুল বাশার সাহেব হযরতকে বললেন, ‘হযরত, আদম ‎আলী ভাইয়ের ব্যাপারে একটা নালিশ আছে।’ সাধারণত এ ধরনের কথায় হযরত বিব্রতবোধ করেন। ‎পরিচিত কারও বিরুদ্ধে নালিশ মানে ভয়ানক ব্যাপার। তারপর হুযুরের মতো কেউ নালিশ পেশ করছেন। ‎হযরত হেসে দিয়ে বললেন, ‘কী নালিশ?’
‘আগে আপনার কোনো সফর মানেই আদম আলী ভাইকে পাওয়া যেত। এখন আর তাকে পাওয়া যাচ্ছে ‎না।’

আমি এ নালিশ শুনে ভড়কে গেলাম। হযরত আমাকে জবাব দিতে বললে কী বলব, এ নিয়ে পেরেশান হয়ে ‎‎গেলাম। যুৎসই কোনো জবাব আমার কাছে নেই। যা আছে, তা বলার মতো না। ‎

হযরত আমাকে মুহূর্তেই এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘আপনরাই ‎‎তো বলেন, ফরয ইবাদতের পরে হালাল রিযিক তালাশ করা সবচেয়ে বড় ফরয।’ ‎

এ কথায় হুযুর আর কিছু বলতে পারেননি। আমিও বেঁচে গেলাম। ‎

এখন বিদায়ের পালা। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক হযরতকে বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই আবার দেখা করতে ‎আসব।’
হযরত বললেন, ‘এখন থেকে অনুমতি ছাড়া আর হাদিয়া আনবেন না। প্রথমবার কিছু বলিনি।’
‘হযরত আমাকে আপনার আপন করে নিন,’ ব্যবসায়ী খুব অনুনয় করে বললেন।‎
‘আপন হতে হলে হাদিয়া আনা যাবে না,’ হযরত সাফ বলে দিলেন। ‎

‎মেহমানগণ তাদের গাড়ির দিকে এগুচ্ছেন। হযরত একা হাঁটতে পারেন না। ওয়াকার দিয়ে হাঁটছেন। ‎‎মেহমানদের বিদায় দিতে গেটের বাহির পর্যন্ত এলেন। মেহমানের গাড়ি ছাড়ার পর ঘরের দিকে পা ‎বাড়ালেন। ‎

হযরত ফিরে যাচ্ছেন। তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী! বয়স আর অসুস্থতা তার মন দুর্বল করতে পারেনি। ‎এখনো কঠিন সব সুন্নাত আমল করে যাচ্ছেন। ‎

হযরত নীরবে হেঁটে যাচ্ছেন। তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। ‎

লেখকের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া।

পূর্ববর্তি সংবাদসিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হামলায় তুরস্কের ৪ সেনা নিহত, আহত আরো ৯
পরবর্তি সংবাদফিলিস্তিনি উলামা পরিষদের ফতোয়া, ট্রাম্পের ‘শান্তিচুক্তি’ সমর্থন হারাম