একজন মায়ের গল্প

মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব ।।

বিপ্লবী মানুষের গুণাগুণ সম্পর্কে আমার জানাশোনা খুবই অল্প। তবুও কখনো কোনো সুন্দর উদ্যোগ দেখে কিংবা শুভ কোনো পরিণামের সূত্র ধরে এগিয়ে মনে হয়—এই তো বিপ্লব, এই তো বিপ্লবী মানুষের চিন্তা।

ছোটবেলা রাশিয়া বিপ্লবের ইতিহাস পড়েছিলাম। হাতের কাছে পেয়েছিলাম তাই। অথচ বিপ্লব কিংবা বিপ্লবের অর্থ-মর্ম কিছুই বুঝতে পারিনি তখন। শুধু অনুভব করেছি—এক এক করে কিভাবে একটা চেতনা, একটা বিশ্বাস পুরো সমাজে সমাদৃত হয়ে উঠে। সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশেও কিভাবে একটা নতুন পরিবেশের  জন্ম হয়। সেই বয়সে সেই ইতিহাস একটা নিছক গল্প ছাড়া আর কিছু মনে হবার কথা নয়। বাস্তবেও হয়তো এর চে’ বেশি কিছু মনে হয়নি। তবে আজ একজন মায়ের কথা লিখতে গিয়ে কেনো যেন খুব মনে পড়ছে সেই না বুঝা ইতিহাস, আমার শৈশবে পড়া ‘নিছক গল্পটি’।

আমরা দুই ভাইবোন। আম্মা-আব্বার ইচ্ছা ছিলো দুজনকেই গড়ে তুলবেন দীনিশিক্ষায়। সেজন্যে আমাদের ঘরোয়া পরিবেশ একেবারে প্রতিকূল ছিল না। তবে সম্পূর্ণ আনুকূল্যের দাবিও বোধ হয় অবাস্তব। বিষয়টি আম্মার বিবেচনায় ছিল। তাই তিনি অদ্ভুত এক পরিকল্পনা সাজালেন যেন পরিবেশের কোন ছোঁয়া না লাগে আমাদের গায়ে। খেলাধুলা থেকে নিয়ে হাসিআড্ডা এবং পড়াশোনা থেকে নিয়ে কোথাও বেড়ানো—সবকিছু চলতে লাগল আম্মার নির্দেশনায়। কড়া নজরদারিতে। ফল ‘খেলতে যাব’ এমন একটা আবেদন পেশ করার আগেই প্রশ্নে উঠত—কোথায়? কার সাথে? কী খেলা? ব্যস, জবাব দেবার সাহসও নেই। খেলতে যাওয়ার ‘ইচ্ছেও’ নেই।

অবশ্য ভাগ্য ভালো থাকলে কখনো বড় বোনের সাথে বেরুতে পারতাম। এরপর তার নির্দেশনায় খেলাধুলায় অংশ নিতাম। সেখানের খেলাধুলার তালিকায় থাকতো গোল্লাছুট, দাইরাবান্ধা, বউছি, কপালটোকা এসব। এর বাইরে ক্রিকেট ফুটবল কিংবা এ জাতীয় কিছু স্বাভাবিকভাবেই কল্পনায় আসত না। কার সাথে খেলব? কোথায় খেলব? কার তত্ত্বাবধানে? তবে এছাড়াও আরেকটা খেলার পরিবেশ আমি পেয়েছি। সেটা ঘরে। খেলার ধরণ— লুডু, চোরপুলিশ, সেট, ধাপ্পা ইত্যাদি। খেলার সঙ্গী কখনো আম্মা, কখনো বোন, আবার কখনো উভয়েই।

এভাবেই পার হয়ে গেছে আমার শৈশব। এবং এই পরিবেশটাই প্রিয় হয়ে উঠেছে নিজের অজান্তে। ফলে একসময় অন্য কোনো খেলা আর আমাকে আকর্ষণ করেনি। অন্য কোনো গল্প-আড্ডাও তেমন মুগ্ধ করেনি। পরিণামে যে সুফল আমি পেয়েছি তার ফিরিস্তি বেশ দীর্ঘ। অপ্রাপ্তি-বঞ্চনাও হয়তো কিছু থাকবে। তবে যে পরিমাণে সময় আমার বেঁচেছে তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা প্রায় অসম্ভব।

পরবর্তীতে যখন মাদরাসায় ভর্তি হয়েছি, নানান অঞ্চলের নানান শ্রেণির সাথীদের সাথে থাকা হয়েছে। তখন ধীরে ধীরে সেই মন-মানসিকতা এবং শৈশবের সেই বৃত্তবদ্ধতা অনেকটাই কেটে গেছে। তবে খেলাধুলা আর শেখা হয়নি কখনো। তাই বিভিন্ন টুর্নামেন্ট, দেশীয় খেলা, আন্তর্জাতিক খেলা ইত্যাদি আমার কাজে, পড়াশোনায় কখনো কোনো প্রভাব সৃষ্টি করেনি।

এরপরও যদ্দুর মনে পড়ে, হেদায়াতুন্নাহুর বছর একবার ক্রিকেট খেলার আগ্রহ জন্মেছিল। সাথীসঙ্গীদেরকে বিষয়টা জানালাম। ওরা খুব আহ্লাদ করে আমাকে মাঠে নামাল। রামপুরা আফতাবনগর বালুর মাঠ। সময়টা আসরের পর। এ সময় এমনিতেই সেখানে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ থাকে। এখানে সেখানে জটলা বেঁধে অনেক মানুষ খেলা দেখে। আমাদের খেলাটাকে ঘিরেও বেশ বড় জটলা। আমি সবার সামনে দিয়ে ব্যাট হাতে নামলাম । কী যেনো ভয়, কী যেনো আনন্দ!

ওপাশ থেকে বল করা হলো। কিংবা আমাকে লক্ষ্য করে কেউ ঢিল ছুঁড়ল। এত তীব্র তার গতি! আমি হালকা হালকাভাবে কাঁপলাম। পিটুনি দিতে পারলাম না। এরপর দ্বিতীয় বল। এবারও পারলাম না। দর্শকদের অনেকেই মিটিমিটি হাসছে। তৃতীয় বলের সময় আমি একটু সরে দাঁড়ালাম। ভয়ে। চোখে মুখে যদি লেগে যায়! ইতিমধ্যে দেখলাম, আমাদের দলের কয়েকজন একে অপরকে তিরস্কার করছে। বিষয়বস্তু— আমাকে মাঠে নামানোর পাগলামি। আমি লজ্জায় কাচুমাচু করছি। সংকল্প— চতুর্থ বলে পিটুনি দেবই। বল হলো। আমি ব্যাট উঁচু করতে গিয়ে স্ট্যাম্পে লাগিয়ে দিলাম। তাতে একটা স্ট্যাম্প পড়ে গেল। তখন একঝাঁক অট্টহাসি আমাকে ঘিরে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন সময় মাহদী ভাই এসে আমার হাত থেকে ব্যাটটা নিয়ে গেলেন। আমি আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম যেন অগণিত তাচ্ছিল্যদৃষ্টি বিঁধে আছে আমার চোখে মুখে গায়ে।

সেই যে খেলা! এরপর আর কোনোদিন মাঠে নেমেছি মনে পড়ে না। সেদিনের খেলায় আমরা ঠকলাম। আমাদের দল ঠকলো। শুধু জিতে রইল আমার মায়ের ক্ষীণ বিপ্লব।

পূর্ববর্তি সংবাদমুসলমানদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ৯২ বছর বয়সী বৃদ্ধার ইসলাম গ্রহণ
পরবর্তি সংবাদঅপদার্থ নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া উচিত : হারুনুর রশীদ