চীনে বন্যপ্রাণী বাণিজ্য স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধের দাবি

ইসলাম টাইমস ডেস্ক: করোন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা ক্যাম্পেইনাররা চীনের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা বন্যপ্রাণী বাণিজ্য স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করে। জীবিত প্রাণী বিক্রি হয় যেসব বাজারে, সেসব বাজার থেকে মানবদেহে নতুন ধরনের রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবানা বেশি থাকে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরকমও ধারণা করা হচ্ছে যে উহান অঞ্চলের সেরকমই একটি বাজার থেকে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে।

করোনা ভাইরাস যেন আরো বেশি ছড়িয়ে না পড়তে পারে, তা নিশ্চিত করতে সাময়িকভাবে বন্যপ্রাণী-সংক্রান্ত ব্যবসা বন্ধ করেছে চীন। তবে সংরক্ষণবাদীরা মনে করেন, এই পদক্ষেপ নেওয়া যথেষ্ট নয়। তাদের বক্তব্য, বন্যপ্রাণী-সংক্রান্ত বাণিজ্য স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হলে তা মানুষের স্বাস্থ্যজনিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর অবৈধ চোরাকারবার বন্ধ করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ক্যাম্পেইনাররা মনে করেন, ঐতিহ্যগতভাবে চীনা ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন বণ্যপ্রাণীর দেহের অংশ ব্যবহার হওয়ায় এবং চীনাদের খাবার হিসেবে বিভিন্ন রকম বন্যপ্রাণীর চাহিদা থাকায় বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের নিয়ে বাণিজ্য বেড়ে চলেছে।

মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণের ৭০ শতাংশের বেশি ধরনের সংক্রমণই বিভিন্ন প্রাণী থেকে, বিশেষ করে বন্যপ্রাণী থেকে শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন করোনা ভাইরাস বাদুড় থেকে ছড়ানোর বড়ো একটি সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার আগে এই ভাইরাস অন্য কোনো অচেনা প্রাণীর মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) ও মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিনড্রোমের (মার্স) পেছনে থাকা ভাইরাসও বাদুড় থেকে এসেছে বলেই ধারণা করা হয়। তবে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার আগে সেগুলো সিভেট-জাতীয় বিড়াল ও উটের মধ্যে ছড়ায় বলে অনুমান করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের ডক্টর বেন এমব্রেক বলেন, ‘এমন ধরনের বন্যপ্রাণী ও তাদের বাসস্থানের সংস্পর্শে আমরা আসছি, যেগুলোর সঙ্গে একসময় মানুষের কোনো সম্পর্কই ছিল না।’ ‘হঠাত্ই আমরা এমন সব ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছি, যেগুলো আমাদের জন্য একেবারেই নতুন।’

‘আর সম্পূর্ণ অচেনা এসব ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া আর পরজীবীর কারণে অনেক রকম নতুন রোগ ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মধ্যে।’ বলেন ডক্টর এমব্রেক। ভূ-পৃষ্ঠে থাকা প্রায় ৩২ হাজার জাতের মেরুদণ্ডি প্রাণী সম্পর্কে এক গবেষণায় জানা যায় যে এসব প্রাণীর ২০ শতাংশই বৈধ বা অবৈধভাবে বৈশ্বিক বন্যপ্রাণী বাজারে বেচাকেনা হয়ে থাকে।

সংরক্ষণবাদী গ্রুপ ডব্লিউডব্লিউএফের এক গবেষণায় উঠে আসে, বৈশ্বিক বন্যপ্রাণী বাজারে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়, টাকার অঙ্কের হিসাবে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের পরেই যা বিশ্বব্যাপী অবৈধ ব্যবসার তালিকায় চতুর্থ সর্বোচ্চ।

চীনের অর্থনীতির একটি বড়ো অংশ এই বন্যপ্রাণী-সংক্রান্ত ব্যবসা। বহু প্রাণী বিলুপ্তপ্রায় হওয়ার কারণ হিসেবে এই বাণিজ্যকে দায়ী মনে করা হয়। ডক্টর এমব্রেক মনে করেন, করোনা ভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী রোগ যেন ভবিষ্যতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে এখনই বন্যপ্রাণী-সংক্রান্ত বাণিজ্য বন্ধ করা উচিত।

‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ মেয়াদে বন্যপ্রাণী-সংক্রান্ত বাণিজ্য বন্ধ করা উচিত। কারণ আমরা জানি যে প্রাণঘাতী রোগ ছড়ানোর মতো ভয়াবহ কোনো ঘটনা আবারও ঘটতে পারে।’ তবে চীনের সরকারের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা যে অস্থায়ী হবে, তা নিশ্চিত করেছে তারা।

তিনটি চীনা সংস্থার যৌথভাবে প্রকাশিত এক নির্দেশনায় বলা হয়, ‘চীনে মহামারি অবস্থা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের বন্যপ্রাণী বিক্রি, স্থানান্তর ও পোষা নিষিদ্ধ থাকবে।’ ২০০২ সালে সার্স ছড়িয়ে পড়ার পর বেইজিং একই ধরনের একটি নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিল। তবে সংরক্ষণবাদীরা বলছেন, সে সময় নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ নজরদারিতে কিছুটা ঢিল দেয় এবং বন্যপ্রাণীর বাণিজ্যও ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যায়।

সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমগুলোর সম্পাদকীয়তেও তাদের দেশের নিয়ন্ত্রণহীন বন্যপ্রাণী বাজারের সমালোচনা করা হয়েছে। সংরক্ষণবাদীরা বলছেন জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে চীন যে আসলেই ইচ্ছুক, তা এই করোনা ভাইরাস ছড়ানোর ফলে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছে তারা।

উদাহরণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা তুলে ধরছেন চীনে হাতির দাঁত আমদানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সফলভাবে বাস্তবায়নের বিষয়টি। আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর অনেক বছর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগের পর চীন সরকার এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বন্যপ্রাণীর দেহের অংশ দিয়ে তৈরি করা পণ্যের বিষয়ে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা শুধু চীনে নয়, সারা বিশ্বে বাস্তবায়ন করা উচিত।

পূর্ববর্তি সংবাদবনানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনির আগুন নিয়ন্ত্রণে
পরবর্তি সংবাদহযরত মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রাহ. : কুরআনের খেদমতে নিবেদিতপ্রাণ মনীষী