করোনা চিকিৎসা সামগ্রী মজুদ: ধ্বংসাত্মক খাসলত কবে দূর হবে!

শরীফ মুহাম্মদ ।।

ঘটনা ১৬ এপ্রিলের। অনলাইন পোর্টালগুলোতে খবর এসেছে ১৭ এপ্রিলে। ঢাকা বাংলামোটর এলাকার জহুরা টাওয়ারের একটি দোকান থেকে পুলিশ বিপুল পরিমাণ করোনা চিকিৎসা সামগ্রী উদ্ধার করেছে। এসব সামগ্রী গোপন পথে বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে এবিসি কর্পোরেশন নামের ওই দোকানে মজুদ করে রাখা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, সুযোগ বুঝে চড়া দামে সেসব পণ্য বিক্রি করা। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আতঙ্কে গোটা দুনিয়া যেখানে কাঁপছে, সেখানে আমাদের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ভাইয়েরা মুনাফার বাকশোটা আরো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করার চেষ্টায় নিয়োজিত। এ যেন মৃত্যুর ঘাটে দাঁড়িয়েও বাণিজ্যের মহড়া।

করোনা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই নানারকম ব্যাবসায়িক ফেরেববাজির খবর গণমাধ্যমে আসছিল। চড়া দামে মাস্ক, গ্লাভস ও সেনিটাইজার বিক্রির খবরগুলো ছিল বেশ চালু। অনেক দোকানে এজাতীয় পণ্য জমা রেখেও গ্রাহকদের বিদায় করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিলো। পরিস্থিতি আরেকটু খারাপ হলে আরো বেশি দামে বিক্রির টার্গেট ছিল তাদের। এপ্রিলের শুরু থেকে দেশে প্রায় লকডাউন পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর এজাতীয় কালো ব্যবসার খবর তেমন একটা পাওয়া যায় নি। ধারণা করা হয়েছিল, ব্যবসার পর্ব শেষ, ভয়ের পর্ব শুরু হয়ে গেছে! কিন্তু কীসের কি! ১৬ এপ্রিলের বাংলামোটরের ঘটনা আবার যেন মনে করিয়ে দিল, কবরে এক পা চলে গেলেও এ জাতির বাজে খাসলত যেতে চায় না।

খবরে দেখা গেছে, জহুরা টাওয়ারের ওই দোকান থেকে উদ্ধারকৃত করোনা চিকিৎসা সামগ্রীর মধ্যে ছিল: ২৭৫ পিস করোনা পরীক্ষার কিট, ১৯৮ পিস পিপিই, ৯ হাজার ৫০ পিস সাধারণ মাস্ক, ১০০ পিস বিশেষায়িত এন-৯৫ মাস্ক, ৯৬০ পিস হ্যান্ড গ্লাভস, ২৫০ পিস চশমা, ৯০০ পিস ক্যাপ আর ১৪৪০ পিস শু কভার।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, করোনা পরীক্ষার কিট খোলাবাজারে পাওয়া যাওয়ার কথা নয়। এটা নিশ্চিতভাবেই গোপন পথে অথবা চোরাচালানী করে দোকানটিতে এনে জমা করা হয়েছে। অন্যান্য যেসব বস্তু মজুদ করা হয়েছে, সেগুলো খোলাবাজারে খুব দুর্লভ নয়, কিন্তু মজুদ করে রাখলে সহজ মূল্যে সেগুলো ক্রেতারা সংগ্রহ করতে পারবেন না। যুক্তি ও মানবিকতার কথা হলো, সংকটকালে চিকিৎসা সামগ্রীর সংগ্রহ ও সরবরাহ ঠিক রাখলে অন্য পদ্ধতিগত বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে। সরকারি ব্যবস্থাপনার বাইরেও ভুক্তভোগী মানুষ যদি খোলা বাজার থেকে সহজে বা সাধারণ বাজার মূল্যে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী সংগ্রহ করতে পারেন তাহলে সেটা একদিক থেকে মন্দ নয়। কিন্তু উদ্দেশ্যই যখন অসৎ হয়, পদ্ধতি ও ফলাফল তখন আর ভালো থাকে না। এসব মজুদের পেছনের গল্পটার মতলবই খারাপ। ভালো কিংবা সহযোগী পর্যায়ের কোনো সেবা তারা দিতেই চায় না। মনে হয়, মুনাফার কড়কড়ে নোটের বাইরে মানবিক অন্যকিছু তারা জানেই না। সংকট অথবা বিপর্যয়ের সময় এমন মানসিকতা ও খাসলত অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।

গত দু সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণের চালসহ তৃণমূল পর্যায়ের ‘জনপ্রতিনিধিরা’ পুলিশের কাছে ধরা পড়ছে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো নেতাও গ্রেফতার হয়েছে। প্রায় মাসখানেক যাবত গরিব মানুষের আয় রোজগার বন্ধ। চুলায় হাঁড়ি নেই, পেটে ভাত নেই। ব্যক্তিগত এবং বেসরকারি নানা পর্যায়ের উদ্যোগে বহু জায়গায় চাল ডাল তেলের প্যাকেট সরবরাহ করা হচ্ছে। সে সময়টাতে গরিবের জন্য বরাদ্দ করা চালের বস্তা যারা চুরি করার জন্য ঘরে- গুদামে জমা করে রাখে, তারা কি মানুষ! রোগে মারা যাচ্ছে মানুষ, আতঙ্ক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ঘরবন্দি হয়ে আছে মানুষ, কাজকর্ম বন্ধ ক্ষুধার্ত দিন পার করছে কোটি মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে যারা মানুষের হকের চাল মেরে দিতে চায়, যারা চিকিৎসা সামগ্রী মজুদ করে রেখে চড়াদামে বেচতে চায়, তারা কি কবরে যাওয়ার ভয় পায় না? তারা কি কোনদিনই মরবে না? করোনার সঙ্গে কি তারা আঁতাত করে ফেলেছে? নাকি এসব কিছুর পেছনেই রয়েছে ভয়ঙ্কর খাসলতের দোষ!

বহু পাপী পাপ ছেড়ে দেয় মৃত্যুভয় সামনে এলে। খাসলত খারাপ -বহু মানুষ জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়লে ভালো হয়ে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের এদেশ এবং এদেশের ‘জাতিগত’ এমন কিছু ভিন্নতা মনে হয় রয়েছে, খোলা কবরের সামনে দাঁড়িয়েও আমরা বদ খাসলত বদলাতে পারি না! এটাতো গোটা সমাজের জন্যই একটি গভীর ভয়ের সংকেত! করোনা ভাইরাসের মারণভীতির চেয়েও এই খাসলতের ভীতি তো আরো মারাত্মক।

বিপদ, আপদ, দুর্দশা এলে তওবা করে সুপথে ফিরে আসাই মানুষের কাজ। পকেটের সম্পদই   তো সব সম্পদ নয়। এই জীবনেও আরও অনেক ‘সম্পদের’ ব্যাপার আছে, আর আছে অনন্ত পরকালের পাথেয় সংগ্রহের প্রেরণা ও দায়িত্ব। আমাদের বোঝা দরকার। আমাদের একটু থেমে ভাবা দরকার। আল্লাহ তাআলা আমাদের মাফ করুন।

পূর্ববর্তি সংবাদভারতে করোনা আক্রান্ত আশি ভাগের কোনো উপসর্গ নেই!
পরবর্তি সংবাদসুস্থ হয়ে উঠছেন আল্লামা আহমদ শফী, করোনা টেস্ট নেগেটিভ