দিল্লির মসনদে শের শাহ সূরী : সারাদিন কীভাবে কাটাতেন

আবু নোমান ।।

১৫৩৯ সালে দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে শের শাহ খুব সহজেই বিনা বাঁধায় মুঘল সাম্রাজ্যের মসনদ দখল করেন এবং  নিজেকে  প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে।

কিন্তু বাস্তবতা হল তিনি মুঘলদের রাজ্য দখল করে যতটা ক্ষতি করেছেন তার চেয়ে বেশী তাদের উপকার করেছেন। তিনি বিচক্ষণতা ও কর্মকুশলতার দ্বারা মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করে দিয়ে যান।

একজন মানুষকে মনে রাখা হয় তার কাজের মধ্য দিয়েই। শের শাহ অল্প কয়েক বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু এই অল্প কয়েক বছরেই তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন, তাতে হিন্দুস্তানের ইতিহাসে তার নামটি আজীবন অক্ষয় হয়ে থাকবে।

মানুষ হিসেবে শের শাহ বেশ সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি ঘুম থেকে উঠতেন খুব সকালে। উঠে গোসল করে ফজরের সালাত আদায় করতেন। ফজরের সালাত আদায় করেই রাজকীয় কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে বসে যেতেন। এসময় প্রশাসনিক বিভিন্ন রিপোর্ট তার কাছে পাঠানো হতো। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে এগুলো দেখতেন। কোথাও সংশোধনের প্রয়োজন হলে কর্মচারীদের তা বলে দিতেন। এ সময় রাজসভার মন্ত্রীরাও নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণী পেশ করতেন।

কাগজ-পত্রের কাজ শেষ হলে শের শাহ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাসহ অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা করার জন্য সময় দিতেন। এ সময় তিনি তাদের ও তাদের পরিবারের খোঁজ নিতেন। প্রয়োজন হলে তাদের মাঝে জায়গীর বন্টন করতেন। এসব কাজ শেষ হলে মনোযোগ দিতেন বিচারকাজের প্রতি।

বিচারকার্যের জন্য বিচারপতি তো ছিলোই, কিন্তু তারপরেও কেউ যদি সেই বিচারে সন্তুষ্ট না হতো, তাহলে নির্দ্বিধায় শের শাহের দরবারে উপস্থিত হয়ে যেতে পারতো। শের শাহও তার প্রজাদের অভাব, অভিযোগ মন দিয়ে শুনতেন ও ন্যায়বিচারের চেষ্টা করতেন। কেবলমাত্র ন্যায়বিচারই পারে একটি সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে, এই বিষয়টি শের শাহ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। প্রায়ই তিনি বলতেন, ন্যায়বিচারই হলো ধর্মীয় কার্যক্রমের মধ্যে সবচেয়ে সেরা।

বিচারকার্যের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শের শাহ সেনাবাহিনীর প্রতি নজর দিতেন। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন নথিপত্র নিজে প্রায়ই যাচাই করে দেখতেন। সেনাবাহিনীতে নতুন কেউ চাকরি নিতে এলে তিনি নিজেই তার সাথে কথাবার্তা বলতেন। এরপর তাদের দক্ষতা যাচাই করতেন। সন্তুষ্ট হলে আরো যাচাই বাছাইয়ের পর তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়ে নেয়া হতো।

এগুলো শের শাহের দৈনন্দিন কার্যক্রমের অংশ ছিলো। এসব কার্যক্রমের মাঝে যদি সাম্রাজ্যের কোনো প্রান্ত থেকে রাজস্ব চলে আসতো, তাহলে তিনি নিজে তা পরীক্ষা করে হিসাব মিলিয়ে দেখতেন। বিভিন্ন রাজ্য থেকে দূতেরা তার দরবারে এলে তাদের সাথে দেখা করতেন।

এতসব কাজের মাঝখানে কোনো এক ফাঁকে সকালের নাস্তা সেরে ফেলতেন শের শাহ। এসময় প্রায়ই তার সাথে আলেমরা থাকতেন। নাস্তার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুপুর পর্যন্ত চলতো রাজকীয় কার্যক্রম।

দুপুরে যোহরের সালাত আদায়ের করে খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। এরপর আবারও রাজকার্য চলতো। বিকালের দিকে বিভিন্ন জনসমাবেশে যোগ দিয়ে আসরের সালাত আদায় করে কিছুক্ষণ পবিত্র কুরআন পাঠ করতেন। এরপর আবারও রাজকার্যে মনোযোগ দিতেন।

এভাবেই সারাদিন প্রচন্ড ব্যস্ততার সাথে কেটে যেত হিন্দুস্তানের সম্রাট শের শাহের দিনগুলো। তার এই দৈনন্দিন কার্যক্রমে তিনি কখনোই অলসতা প্রদর্শন করেননি। কারণ তিনি জানতেন, তিনি অলসতা দেখালে তার সাথে সাথে গোটা প্রশাসনেই অলসতা চলে আসবে।

শের শাহ কোনো রাজপরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে দিল্লির মসনদ লাভ করেননি। তার পিতা ছিলেন একজন ঘোড়া ব্যবসায়ী এবং তিনি নিজেও একেবারে সাধারণ পর্যায় থেকে উঠে এসেছিলেন। এ কারণে তিনি রাজকীয় কৃত্রিম গাম্ভীর্য ত্যাগ করে খুবই সাদাসিধে জীবনযাপন করেছিলেন। ফলে শের শাহের সেনারা তাকে যেমন ভালোবাসতো, তেমনই প্রজারাও তাকে ভালোবাসতো।

তিনি ছিলেন একজন দক্ষ যোদ্ধা, দুর্ধর্ষ জেনারেল আর বিচক্ষণ শাসক। হতবুদ্ধ আফগান জাতির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করে নিজের দূরদর্শিতার বলে তিনি নিজেকে হিন্দুস্তানের মসনদে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

শের শাহ সুরি সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন মাত্র ৫ বছর, ১৫৪০ সাল থেকে শুরু করে ১৫৪৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। আর এই ৫ বছরেই রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি যুগান্তকারী যেসব সংস্কার করেছিলেন, তা পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্য সরাসরি গ্রহণ করেছিলো।

পূর্ববর্তি সংবাদকরোনা ভাইরাস : ভারতের ইসালাম বিদ্বেষী আচরণে এবার সরব মুসলিম ‍বিশ্ব
পরবর্তি সংবাদমুক্তির পয়গাম নিয়ে আসছে মাহে রমজান