করোনায় লকডাউন: শ্রমিকরা ভাতে মরে, নেতারা কাটায় আরামের ঘরবন্দী জীবন

তারিক মুজিব ।।

সামাজিক মাধ্যমে দিন কতক আগে একটা খবর প্রচার হয়েছিল। পল্লবির মিনা বাজার বা স্বপ্ন থেকে বাজার করে ফেরা এক ভদ্র মহিলার সদাই-এর ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালাচ্ছিলো বছর ত্রিশের এক ব্যক্তি। পরে স্থানীয় লোকদের তৎপরতায় তাকে ধরা হলে জানা গেলো, ছিনতাইকারী রাজধানীর উত্তরা-বসিলা রুটে চলা প্রজাপতি বাসের কনট্রাক্টর। লকডাউনের সঙ্কটময় মুহূর্তে তিন চার দিন ঘরে খাবার নেই। কোনো ত্রাণ, অনুদান বা সাহায্যও সে পাচ্ছে না। তাই বেঁচে থাকার তাড়নায় বাধ্য হয়েই সে এমন ন্যাক্কারজনক পথে পা বাড়িয়েছে।

করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে সরাসরি সবচেয়ে ক্ষতির মুখে যারা পড়েছে তাদের অন্যতম হলো পরিবহন শ্রমিকেরা। রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে থাকা প্রায় সব পরিবহন শ্রমিকের অবস্থা-‘দিন আনে দিন খায়’। বাড়তি কোনো সঞ্চয় পরিবহন শ্রমিকদের খুব কমজনেরই থাকে বা আছে। সরকার বিভিন্ন খাতের জন্য প্রনোদনা ঘোষণা করলেও পরিবহন খাতের জন্য আলাদা কিছু উল্লেখ করেনি। ফলে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের এখন ত্রাহি অবস্থা।

করোনার এই মহা দুর্যোগে পরিবহন শ্রমিকেরা পাশে পাচ্ছে না তাদের ‘মহান নেতাদের’। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনকেও শ্রমিকদের জন্য কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ দেশের বাণিজ্যিক প্রতিটি যানবাহন থেকে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে ঘোষণা দিয়ে প্রতিদিন ৭০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। আর সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে সংগঠনটির ঘোষিত আয় বছরে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর বাইরে অঘোষিত চাঁদার তো কোনো হিসেবই নেই।

মালিক-শ্রমিক সংগঠনটির নেতৃত্ব দুই ভাগে বিভক্ত। শ্রমিকদের অংশের নেতৃত্বে আছেন ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী। যিনি সরকার গৃহীত বিভিন্ন সড়ক আইনের প্রতিবাদে নেপথ্যে থেকে শ্রমিকদেরকে দিয়ে ধর্মঘট করান। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে তার নির্দেশেই শ্রমিকেরা রাস্তায় নামে। এমনকি পরিবহন শ্রমিকেরা সড়কে কোনো দুর্ঘটনা ঘটালেও মিডিয়ার সামনে হাসতে হাসতে তিনি তাদের সমর্থন দেন।

চাঁদা প্রদানকারী শ্রমিকদের প্রতি অসময়ে যার এত দরদ প্রকাশ হতে আগে দেখা গেছে; শ্রমিকদের প্রকৃত বিপদে তার টিকি পযর্ন্ত দেখা যাচ্ছে না এখন। এ নিয়ে সাধারণ শ্রমিকদেরও ক্ষোভের অন্ত নেই। আমাদের পরিচিত অনেকে শ্রমিকদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে গিয়ে মালিকদেরকে কয়েক প্রস্থ গালি দিতে শুনে এসেছে। শ্রমিকদের অনেকের মনোভাব এমন-‘সারাবছর চাঁদা দিয়ে আমরা যাদের পুষি; আমাদের দুর্দিনে তারা আছে গা ঢাকা দিয়ে’। এই না হলে মহান নেতা!

সারাবছর যাদের দিনরাত হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনিতে পরিবহন মালিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফুলে ফেপে উঠে, তাদের দুর্দশার দিনে আরামের ঘরবন্দী সময় পার করছেন মালিকেরাও। নূন্যতম মানবিকতার পরিচয় দিয়ে বিশাল বিত্তের সামান্যতম অংশও যদি নিজের পরিবহনের শ্রমিকদের তারা দিতেন তাহলে খুব বেশি সম্পদ কমে যেত না তাদের। শ্রমিকদের দিনগুলোও কিছুটা স্বস্তিতে কাটতো হয়তো।

আর মালিক-শ্রমিক সংগঠনের মালিক পক্ষের নেতৃত্বে থাকা সরকার সহযোগী একটি দলের মহাসচিবের পদবীধারী ব্যক্তিটি! পরিবহন বন্ধের একমাস হলো তারও কোনো খোঁজ নেই। তিনি বরং এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলে দিয়েছেন- আমি তো শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করি না। তাদের সমস্যাদি দেখা আমার দায়িত্বও না। আমি পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি।অথচ সংগঠনটি টিকেই আছে সাধারণ শ্রমিকদের দিনান্তের হাড় খাঁটুনি পরিশ্রমের উপার্জিত অর্থ দিয়ে।

শ্রমিকদের কপাল এমনই হয়। দুইদিন রাস্তায় না বেরোলেই তাদের ভাত-কাপড়ের অভাব পড়ে যায়। একটু খেয়ে বাঁচার তাড়নায় চুরি-ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়তে হয় তাদের। তাদের সন্তানদের স্বাদ আহ্লাদ থাকতে নেই।

অথচ লকডাউনের ফলে উদ্ভত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং দেশের সকল নাগরিকের সুস্বাস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া এই রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য ছিল। চুরি-ছিনতাই নিঃসন্দেহে অন্যায় কাজ। তবে খাদ্য সঙ্কট পরিস্থিতিতে ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে শ্রমিকের ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ার দায় সরকারের কাঁধেও বর্তায়।

একইভাবে এই অপকর্মের দায় শ্রমিকদের উপার্জিত অর্থে বিত্তের মালিক হওয়া ওইসব নেতাদের কাঁধেও বর্তায় যারা শ্রমিকদের দুর্দিনে যারা আরামের ঘরবন্দী জীবন যাপন করছে।

পূর্ববর্তি সংবাদকরোনা পরিস্থিতিতে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোকে একটি ফান্ড গঠনের প্রস্তাব বাংলাদেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
পরবর্তি সংবাদকরোনা ভাইরাস : বারেডেমের আইসিইউ কার্যক্রম বন্ধ