ভারতে লকডাউনের ভয়াবহ চিত্র : দিল্লির সাংবাদিকের কলমে

ইসলাম টাইমস ডেস্ক : ১৫০ কিলোমিটার পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল ১২ বছরের মেয়ে। একটু খাবারের আশায়। পথেই মৃত্যু হল। এ নিয়ে জার্মান ভিত্তিক এক গণমাধ্যমে কলাম লিখেছেন সাংবাদিক স্যমন্তক ঘোষ।  কলামটি নীচে তুলে ধরা হল-  

হ্যাঁ, আপনাদের বলছি। দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া রাজনীতিবিদ। রুপোলি সেলিব্রিটি। সুখী গৃহকোণে লকডাউন-উদযাপনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা মধ্যবিত্ত। করোনা সংকটে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষতে বসা কর্পোরেট। হ্যাঁ, আপনাদের সকলকে বলছি– একটু চুপ করুন। তাকিয়ে থাকুন ১২ বছরের আদিবাসী মেয়ে জামলো মাড়কমের নিথর শরীরটার দিকে। চিনে নিন আসল ভারতবর্ষ। হ্যাঁ, এটাই এ দেশের বাস্তব চিত্র। বাস্তবকে স্বীকার করুন।

গত ১৮ এপ্রিল বাড়ি থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে নিথর হয়ে যায় জামলোর শরীর। দু’বার বমি। ব্যস, তারপর আর সাড়া দেয়নি মেয়ে। প্রশাসন তাঁর দেহ উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পরে প্রথমে করোনার পরীক্ষা করেছিল। রিপোর্ট নেগেটিভ। প্রশাসন বুঝতেই পারেনি হার গিলগিলে ওই শরীরে করোনা নয়, অপুষ্টি বাসা বেঁধেছে। সেটাই তার মৃত্যু কারণ। খিদে হেরে গিয়েছে রোদ-জল-জঙ্গলের ধকলের কাছে।

জামলোরা আসলে ‘মরিয়া’ প্রমাণ করছে, এ দেশে তাদেরও অস্তিত্ব আছে। তারাই এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। তাদের ভারত ডিজিটাল নয়। নেতামন্ত্রীদের ভার্চুয়াল ভাষণ তাদের কানে পৌঁছয় না। তাদের ভারতে স্বাভাবিক সময়েই দু’বেলা রান্না হয় না। লকডাউন একবেলার ভাতও বন্ধ করে দিয়েছে। এটাই সেই ভারত, যেখানে অসুস্থ স্ত্রীকে কাঁধে তুলে মাইলের পর মাইল হেঁটে হাসপাতালে নিয়ে যান খাটো ধুতি খালি গায়ের স্বামী। অ্যাম্বুলেন্স তো অনেক পরের কথা, পথ চলতি গাড়িতে ওঠারও তাঁদের অধিকার নেই। অন্য ভারত যখন বিদেশে আটকে পরা নাগরিকদের দেশে ফেরানোর ভাবনায় বিমান পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, রাজস্থানে আটকে থাকা ছেলেকে বিহারে ফিরিয়ে আনছেন রাজনীতিক বাবা, জামলোদের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তখন সামান্যতম ব্যবস্থাটুকুও করতে পারেন না এ দেশের সরকার বাহাদুর। প্রশাসনের কর্তারা। জামলো মরেছে, তাই অন্তত তার জীবনের দাম নির্ণয় হয়েছে। এক লাখ টাকা দেওয়া হবে পরিবারকে।

না, সকলে ঘরে বসে থাকছেন না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও ভোটের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন রাজনীতিবিদরা। গরিবের কাছে যত না ত্রাণ পৌঁছচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ছবি পোস্ট হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে রাজনীতিবিদরা বলছেন, কী ভাবে তাঁর দল এই ভয়াবহ সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কী ভাবে এত কিছুর পরেও দেশকে সচল রেখেছে। আর আমরা? এ দেশের মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণী সোশ্যাল মিডিয়ায় লকডাউনের নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে আলোচনায় মগ্ন। রাজনীতিতে কার পয়েন্ট বাড়ছে, কার কমছে, সেই হিসেব নিয়ে ভার্চুয়াল বিতর্ক জমজমাট। চলছে নানাবিধ ভার্চুয়াল চ্যালেঞ্জ। টেলিভিশন চ্যানেলের সান্ধ্য আসরে বিশ্ব অর্থনীতির আলোচনা। করোনা থেকে বাঁচার উপায় জানাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। শেখাচ্ছেন স্যানিটাইজারের ব্যবহার।

চালিয়ে যান। এই সব কিছুই চালিয়ে যান। আপত্তি নেই। এ সব ছাড়া ভারতীয় সভ্যতা এগোবে কী করে? গণমাধ্যমে আপনারাই হেডলাইন ছিলেন, আছেন, থাকবেন। শুধু একটি বার, একটু সময়ের জন্য চুপ করুন। স্তব্ধ হয়ে যান। ১২ বছরের জামলোর ওই নিথর শরীরটার দিকে তাকান। মুহূর্তের জন্য হলেও চিনে নিন নিজের দেশটাকে। কষ্ট হলেও ওই নিথর মুখটার দিকে তাকিয়ে নিজের শিশুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরুন। অহংকার, গর্ব, ক্ষমতা– এই সব কিছু বিসর্জন দিয়ে লজ্জা পান।

হ্যাঁ, আপনাদের বলছি। দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া রাজনীতিক, রুপোলি গ্ল্যামার, ডিজিটাল মধ্যবিত্ত– আপনাদের সকলকে বলছি। জামলোর নিথর লাশের সামনে একবার মাথা নত করুন।

পূর্ববর্তি সংবাদকরোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশী পুলিশ
পরবর্তি সংবাদওমান থেকে দেশে ফিরলেন ২৮৮ প্রবাসী