রোযার বিধান প্রবর্তনে ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য, বস্তুবাদ ও ধর্মীয় বোঝাপড়া

সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদবী রহ. ।।

ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মেও রোযার বিধান ছিল। তবে রোযা শরিয়তসিদ্ধ করণে ইসলামের যে তরিকা তা ব্যাপক উপকার সমৃদ্ধ এবং রোযার উদ্দেশ্য আদায়ে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ। এ তরিকায়ই আল্লাহ তাআলার রোযার বিধান প্রবর্তনের হিকমত ‘প্রকাশিত’ হয় পরিপূর্ণভাবে।

ইসলামি শরিয়তে বরকতময় ও পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস রমযানে ধারাবাহিকভাবে পূর্ণ একমাস রোযা ফরজ করা হয়েছে। রমযানে দিনের বেলায় রোযা রাখা হবে এবং রাতের বেলায় খাওয়া দাওয়ার সুযোগ থাকবে। রোযার ব্যাপারে আরববাসীর মধ্যে এমন প্রচলনই ছিল এবং আরবদের প্রচলনকেই সাধারণভাবে ইসলামি বিধান প্রবর্তনের মানদণ্ড ধার্য করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম আহমদ ইবনে আবদুর রহিম দেহলভী বলেন, রোযার দিন ধার্য করা হয় ফজরের সময় থেকে সূর্য ডুবা পর্যন্ত সময়কে। কেননা আরবেদের মাঝে দিনের ব্যাপারে এ ধারনায় পোক্ত ছিল। তাদের সমাজে প্রচলিত আশুরার রোযাতে তারা দিনের এ হিসাব অনুযায়ীই আমল করত। আর মাস ধার্য করা হয়েছে এক চাঁদ থেকে নতুন চাঁদ উদয় হওয়া পর্যন্ত সময়টুকু। কেননা আরবদের কাছে মাসের হিসাব এটাই ছিল। তারা সৌরবর্ষের হিসেব করত না।

 

রমযান মাসকেই কেন রোযার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে

আল্লাহ তাআলা রমযান মাসে রোযাকে ফরজ করেছেন, একটিকে আরেকটির সাথে সংযুক্ত করেছেন, ফলে দু’টি কল্যাণ ও সৌভাগ্যের সম্মিলন হয়েছে। এর হিকমত প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে- রমযান মাসে আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেছেন। অতএব রমযান অন্ধকার দূরীকরণে সুবহে সাদিকের মতো। সুতরাং উত্তম হল এই মাসেই রোযার বিধান প্রবর্তন করা। যাতে রমযানের প্রতিটা সুবহে সাদিক রোযার মহান আমল দ্বার শুরু হয়। তাছাড়া রমযান মাস আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কেননা তাতে রয়েছে রহমত, বরকত ও কল্যাণ এবং এ মাসে  আল্লাহর সাথে বান্দার বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অতএব বরকত, রহমত, কল্যাণ যেন পূর্ণরূপে বান্দা অর্জন করতে পারে সেজন্য রোযার বিধান দেওয়া হয়েছে এ মাসে।

রোযা এবং কুরআনের মাঝে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে রাসূল সা. রমযান মাসে প্রচুর পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে- রাসূল সা. স্বভাবতই প্রচুর দান করতেন। রমযান মাসে জিবরীল আ.-এর সাথে যখন সাক্ষাতে কুরআনে কারিমের দাওর পড়তেন তখন দানের পরিমাণ আরও বেড়ে যেত। (বুখারি, মুসলিম)

একাদশ শতকের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও মুজাদ্দিদ শায়খ আহমদ সারহিন্দ রহ. তার কোনো পুস্তিকায় লেখেন, রমযান এবং কুরআনের মাঝে ব্যাপক সংযোগ রয়েছে। এই সংযোগের কারণেই রমযানে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং রমযান হল কল্যাণ এবং বরকতের আধার।   রমযান ছাড়া অন্য মাসে আল্লাহর রহমত ও বরকতের অফুরন্ত দরিয়া থেকে মানুষ সামান্যই লাভ করতে পারে। অতএব যে ব্যক্তি রমযানের বরকত ধারণ করতে পারল, সারাটি বছর তার জন্য বরকতময় হতে পারে। আর যে রমযানকে হেলায় কাটিয়ে দিল বছরের বাকী দিনগুলিও তার এমনি কেটে যেতে পারে। সুতরাং প্রশংসা ঐ ব্যক্তির, যে বরকতময় রমযানের বরকত ধারণ করতে সক্ষম হয়। আর আফসো তার প্রতি, যে মহিমান্বিত রমযানের বরকত থেকে বঞ্চিত হয়।

শায়খ আহমদ সারহিন্দ অপর পুস্তিকায় বলেন, রমযান মাসে যার নেক আমল এবং কল্যাণময় কাজ করার তৈফিক হয় সারাবছরই তার নেক কাজের তাওফিক হবে। আর যার রমযান কাটবে হেলায়, খেল তামাশায় বছরের বাকী সময়ও তার কাটবে বঞ্চনায়।

সাহাবি আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্নিত, রাসূল সা. বলেছেন, রমযান মাসে জান্নাতের দরজাসমুহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজা সকল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানদের করা হয় শিকলাবদ্ধ।

 

রমযান বিশ্বব্যাপী নেক আমলের মওসুম

রমযানে বিশ্বব্যাপী ইবাদত, যিকির, তিলাওয়াত এবং খোদাভীতির পরিবেশ তৈরি হয়। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সকল মুসলমানের মাঝে সামাঞ্জস্ব দেখা যায়। পড়ুয়া- নিরক্ষর, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ঘুচে যায়। সকল দেশেই রমযান। শহরেও রমযান, গ্রামেও রমযান। দালান কোঠাতেও রমযান, গলির খুপরিতেও রমযান। রমযানে কারও চেয়ে কারও অগ্রগামিতা নেই। রোযার ব্যাপারে কারও নিজস্ব কোনো মত নেই। শাবান পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই সফর করা হোক রমযানের সৌন্দর্য্য ও মাহাত্ব ফুটে উঠবে। পরিবেশের ওপর নুরানী পর্দার একটি আবরণ চোখে পড়বে সবার। রমযানে রোযা ছেড়ে দেওয়া ব্যক্তিটিও প্রকাশ্যে পানাহার করতে বা অন্য অপকর্মে লিপ্ত হতে কুণ্ঠিত হয়। অসুস্থ এবং মুসাফির রোযার ব্যাপারে যাদের ছাড় দেওয়া হয়েছে তারাও প্রকাশ্যে খানাপিনা থেকে বিরত থাকে। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। বিশ্বব্যাপীই রোযাময় পরিবেশ। এমন পরিবেশে রোযা রাখা সহজ হয়, অন্তর আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। দিলে ইবাদতের আগ্রহ তৈরি হয়। ইবাদত, সদাচার এবং সহমর্মিতার প্রতি মানুষ উৎসাহিত হয়।

রোযার বৈষয়িক উপকার এবং প্রভাব প্রতিক্রিয়া   

মানুষ অনেকসময় প্রিয় বস্তুর আকর্ষণে মত্ত থাকে। প্রবৃত্তির বেড়াজালে আবদ্ধ থাকে। কঠিন কাজ করার হিম্মত পায় না।  তবে প্রবৃত্তি সবসময় মানুষের ওপর প্রবল হতে পারে না।  কখনো চূড়ান্ত কঠিন কাজ সহজ মনে করে নিমিষেই মানুষ সেরে ফেলে। মানুষ কঠিন কাজের হিম্মত পায় যখন কাজের উত্তম ফলাফল সন্মন্ধে তার বিশ্বাস থাকে। উত্তম পরিণতির বিশ্বাসেই কৃষক কনকনে শীতে বা প্রচণ্ড গরমেও চাষাবাদে উৎসাহিত হয়। ব্যবসায়ী বা চাকুরিজীবী পরিবার ছেড়ে কর্মস্থলে অবস্থান করে। পরিবার পরিজনের ভালবাসা ছেড়ে জীবন বাজি রেখে যোদ্ধা যুদ্ধ করতে যায়।

বাহ্যিক এসব ফলাফল ছাড়াও মানুষের অন্তরে প্রভাব বিস্তারকারী আরও চমৎকার পুরস্কার রয়েছে। যে পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় এবং বিশ্বাসে মানুষ  উপরে উল্লেখ করা কার্যাদি থেকে আরও কঠিন কাজ সহজেই করে ফেলতে পারে। আর তা হল পার্থিব ও পরকালীন ঐসকল পুরস্কার যেগুলোর ব্যাপারে নবী, রাসূলগণ বলে গেছেন, ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে যেগুলোর উল্লেখ আছে। যেগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়।

রোযার বৈষয়িক উপকারের বিষয় তো স্বাস্থ্য সচেতন সকলের জানাই। তথা, কয়েকদিন খানাপিনা থেকে বিরত থাকা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য বছরে কয়েকদিন উপোস থাকা উচিত। সুস্বাদু নানা প্রকারের খাবার সবসময় খাওয়ার কারণে মানুষের অনেক রোগব্যাধী দেখা দেয়। এসব তো স্বীকৃত বিষয়। রোযা স্বাস্থগতউপকারের ব্যাপারে মানুষ বিশ্বাস করে এবং রোযা রাখার কারণে অর্থনৈতিক উপকারের ব্যাপারে মানুষের জানা আছে।

তবুও যদি প্রশ্ন করা হয়- সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপোস থাকার কারণে রোযাদারদের শারীরিক এবং আর্থিক কী উপকার? এবং রোযা রাখার মধ্যে কী-ই বা কল্যাণ নিহিত?

এর উত্তরে বলা হবে- রোযার নানাবিধ স্বাস্থ্যগত এবং আর্থিক ফায়েদা থাকলেও রোযাদার তা বিবেচনায় নিয়ে রোযা রাখে না। বরং প্রতিজন রোযাদার তো এই বিশ্বাসে রোযা রাখে যে, মহান আল্লাহ তাআলা রোযাকে ফরজ করেছেন। পুরস্কার হিসেবে তাঁর সন্তুষ্টি এবং অনেক সওয়াবের ঘোষণা দিয়েছেন। আর রোযাদার এটাকেই সর্বাধিক কল্যাণ এবং উপকারের বিষয় মনে করে। এ কারণেই প্রচণ্ড গরমের দেশে অনেক লম্বা দিনেও রোযাদার সন্তুষ্টচিত্তেই রোযা রাখতে উৎসাহিত হয়। রাতে তারাবির দীর্ঘ নামায ও অন্য ইবাদতে নিমগ্ন হয়। রোযা রাখার পেছনে তারা বস্তুগত কল্যাণ তালাশ করে না। নবীদের যবানে এবং আসমানি কিতাবে রোযার যে ফজিলত বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর সামনে তারা স্বাস্থগত এবং অর্থনৈতিক ব্যাপারকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। কেননা দ্বীনী বিষয়াদি এবং তার সওয়াবের ব্যাপারে ঈমান বা বিশ্বাস মুমিনদেরকে চিকিৎসক এবং অর্থনীতিবিদদের কথাকে অগ্রাহ্য করতেও হিম্মত যোগায়।

আর রোযার ফজিলতের ব্যাপারে তো মুমিনরা রাসূলের যবানে হাদিসে কুদসিতে শুনেছে- বনী আদম তার প্রতিটি কাজ নিজের জন্য করলেও রোযা  বান্দা কেবল আমার সন্তুষ্টির জন্যই রাখে। আমি নিজে এর প্রতিদান দিব। রোযাদারের জন্য খুশি হওয়ার বিশেষ দু’টি  মুহূর্ত আছে। একটি হল ইফতারের মুহূর্ত। দ্বিতীয়টি হল রোযার প্রতিদান হিসেবে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের মুহূর্ত।

এই হাদিসে কুদসি উল্লেখ করার পর রাসূল বলেন, ঐ সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয় রোযাদারের মুখের ‘গন্ধ’ আল্লাহর কাছে মেশকের ঘ্রাণের চেয়েও পছন্দনীয়।

আবু হুরায়রা রাযি. রোযার ফজিলত সম্পর্কে রাসূলের এই হাদিস বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রোযা রাখবে তার পূ্র্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’।

 

রোযার তাৎপর্য ও মাহাত্ম

রমযান মাসে মসলিম সমাজে প্রকৃতিগতভাবেই এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় সকলেই রোযা রাখে। তবে অনেকে সমাজে সবার সাথে চলতে এবং মানুষের ভর্ৎসনা-তিরস্কার থেকে বাঁচার জন্য রোযা রাখে।  কেউ কেউ আবার রোযাটাকেও বস্তুগত তথা, শারীরিক সুস্থ্যতা এবং অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে পালন করে। রোযা রাখতে না থাকে তাদের ঈমানের মজবুতি, না থাকে পরকালে সওয়াবের আশা। এসব কারণেই মহান শরিয়ত আল্লাহর কাছে রোযা কবুল হওয়ার জন্য ঈমান এবং ইহতিসাবের ( সওয়াবের আশায় ইবাদত করা ) শর্ত করেছেন। হাদিসে এরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি ঈমান এবং ইহতিসাবের সাথে রোযা রাখবে তার পূর্বের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।

বান্দার ওপর রোযার বিধান আরোপ করে আল্লাহর তাআলার উদ্দেশ্য এটা নয় বান্দা নিছক অভূক্ত দিন কাটাবে। বরং রমযানে রোযা রেখে এর মাহাত্ম অর্জনই শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য। এ কারণেই রোযা অবস্থায় কেবল খানা-পিনা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়নি বরং রোযার উদ্দেশ্য তথা তাকওয়া হাসিলের অন্তরায় সকল কাজ থেকেই রোযা অবস্থায় বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখে তখন সে কোনো প্রকার অসংলগ্ন বা কটূ কথা বলবে না। তাকে যদি কেউ গালি দেয় তবে জানিয়ে দিবে-ভাই, আমি রোযাদার।

অপর হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, রোযা রেখেও যে মিথ্যা বা গিবত ছাড়তে পারল না তার রোযা রেখে খানা-পিনা ছেড়ে দেওয়ার প্রতি আল্লাহর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাকওয়া এবং পবিত্রতা শূন্য রোযাকে অন্তসার শূন্য দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে- ‘অনেক রোযাদার আছে সারাদিন অভূক্তই থাকা ছাড়া আর কিছু তাদের লাভ হয় না। আবার রাত জেগে অনেক ইবাদতকারী আছে, বিনিদ্রা ছাড়া কোনো ফজিলত তাদের লাভ হয় না’।

আবু উবায়দা রাযি. রাসূলের একটি হাদিস বর্ণনা করেন, -রোযা ঢাল স্বরূপ যতক্ষণ না সেটিকে ফাটিয়ে ফেলা হয়।

 

রোযা কেবল কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা নয়

ইসলামি শরিয়তে প্রবর্তিত রোযা কেবল খানা-পিনা, জৈবিক চাহিদা, মিথ্যা, গিবত-শিকায়াত এবং অনাচার থেকে বিরত থাকার নাম নয়। বরং রমযান তো ইবাদত, ‍যিকির, তিলাওয়াত, তাসবিহ, কল্যাণকামিতা এবং সহানুভূতির মাস।

রমযানে বেশি বেশি ইবাদত করতে উৎসাহ প্রদানে রাসূল সা. ইরশাদ করেন, রমযানে একটি নফল আমলের সওয়াব রমযান ছাড়া একটি ফরজ আমলের সমান। আবার রমযানের একটি ফরজ আদায়ের সওয়াব রমযান ছাড়া সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান। রমযান সবর ও সহানুভূতির মাস। সবরের প্রতিদান জান্নাত।

যায়দ আবনে খালেদ জুহানী রাযি. রাসূল সা.-এর এই হাদিস বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে তাকে রোযাদারের সমান সওয়াব দেওয়া হবে। তবে রোযাদারের সওয়াবের অংশ সামান্যও কমানো হবে না।

রমযানের অপর গুরুত্বপূর্ণ আমল হল তারাবীহর নামায। তারাবীহ সরাসরি রাসূল থেকে প্রমাণিত। রাসূল সা. রমযানে তিনদিন দীর্ঘসময় ধরে তারাবী পড়েছেন। তবে দীর্ঘ সময় ধরে তারাবীহর নামায উম্মতের ওপর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রাসূল সা. তারাবী নিয়মিত পড়েননি। রাসূলের পর সাহাবায়ে কেরাম মজবুতির সাথে তারাবীহর আমল চালু রেখেছেন। এরপর সব যুগে সব এলাকাতেই তারাবীহ চলে আসছে। তারাবীহ আহলে সুন্নাতের ‘শিআরে’ পরিণত হয়েছে।

তাছাড়া সিনায় ধারণ করে কুরআনের হেফাজত এবং কুরআন চর্চার ধারা অব্যাহত থাকার ক্ষেত্রে তারাবীহর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তারাবীহ উপলক্ষে সাধারণ মানুষ রমযানে কিয়ামুল লাইলের আমলে শরীক হতে পারে।

এসব কারণে রমযান হল ইবাদত ও তিলাওয়াতের মওসুম। রমযান খোদাভীরু, মুত্তাকীদের জন্য বসন্তকাল। এ মাসে পরস্পরে ইবাদত এবং কল্যাণকামিতার প্রতিযোগিতা হয়। রমযান মাসে বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।

 

রোযা শরিয়তসিদ্ধকরণে ইসলামের বৈশিষ্ট্য     

বিধান আরোপের ক্ষেত্রে মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি উপযোগী হওয়ার যে মানদণ্ড স্বভাবত ইসলামে অনুসৃত হয় রমযানে মাসব্যাপী রোযা ফরজ করার মাধ্যমে তার ব্যত্যয় কিছু ঘটেনি। শরিয়তে মুহাম্মদিতে রোযার বিধান প্রবর্তনে যে সকল আদাবের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে এবং রোযাকে সহজ ও মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি উপযোগী করে ফরজ করা হয়েছে, সমাজ এবং মানুষের মনস্তত্বে এর প্রভাব অনেক বেশি এবং ব্যাপক। ইয়াহুদি এবং ঈসায়ীসহ অপরাপর শরিয়তে রোযার বিধানে অনেক পার্থক্য ছিল। ইয়াহুদি শরিয়তে রোযাকে শাস্তি, অলুক্ষণে এবং নৈরাশ্যের প্রতীক মনে করা হত। বড় ধরনের কোনো অপরাধের কারণে গোনাহ মুক্তির জন্য তাদের ওপর রোযা ফরজ করা হত। তাদের শরিয়তে রোযার ধরনও ছিল অনেক কঠিন। ইয়াহুদিদের ধর্মগ্রন্থসমূহে এ ব্যাপারে পরিস্কার ভাষ্য রয়েছে।

কিন্তু ইসলামি শরিয়তে রোযাকে কখনোই অপরাধের প্রতিবিধান বা শাস্তি মনে করা হয় না। এ ব্যাপারে কুরআন হাদিসের কোথাও একটি শব্দও নেই। বরং শরিয়তে মুহাম্মদিতে রোযাকে অন্যতম ইবাদত ধার্য করা হয়েছে। যার দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সমর্থ হবে। রোযার ফজিলত নিয়ে হাদিসে অনেক বর্ণনা এসছে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলছেন, রোযা বান্দা একমাত্র আমার জন্য রাখে। আমি নিজে এর প্রতিদান দিব।

ইসলামি শরিয়ত রোযাতে এমন কোনো কঠিন কাজও আবশ্যক করেনি যাতে মানুষ এটাকে শাস্তি মনে করতে পারে। বরং রোযার দিনে সাহরি খাওয়াকে সুন্নাত ধার্য করা হয়েছে। যথাসম্ভব শেষ সময়ে সাহরি খাওয়াকে মুস্তাহাব বলা হয়েছে। সূর্যাস্তের পর তাড়াতাড়ি ইফতার করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাতের বেলা ঘুম-বিশ্রাম, খানা-পিনাকে হালাল করা হয়েছে। এ ছাড়া রোযা অবস্থায় ব্যবসা বা অন্য কোনো দুনিয়াবি কাজে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারেও কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি।

অনেক ধর্মে রোযাকে শ্রেণি বিশেষের সাথে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। খ্রিস্ট ধর্মমতে রোযা কেবল পাদ্রী বা যাজকদের উপর ফরজ ছিল। ইউনানদের মহিলারাই কেবল রোযা রাখত। সেসব ধর্মে অসুস্থতা বা কঠিন বিপদেও রোযা ভাঙ্গার কোনো নিয়ম ছিল না।

ইসলাম রোযাকে সবার জন্য ব্যাপক করেছে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,- ‘যে ব্যক্তিই রমযান মাস পাবে সেই রোযা রাখবে’। অসুস্থ বা রোযা আদায়ে অক্ষমদের জন্য বিশেষ ছাড়ও দেওয়া হয়েছে ইসলামে। কুরআনের সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে, -‘তোমাদের কেউ যদি রমযান মাসে অসুস্থ বা মুসাফির থাকে সে পরে কখনো রোযা কাযা করে নিবে। যারা একেবারেই রোযা রাখতে অক্ষম তারা ফিদয়া আদায় করে দিবে’।

কোনো কোনো ধর্মে ছিল টানা চল্লিশ দিন না খেয়ে থাকার বিধান আবার কোনো কোনো ধর্মে ছিল রোযা অবস্থায় ফল ও পানীয় খাওয়ার অনুমতি। কিন্তু ইসলাম তো বরাবরই মধ্যপন্থী ধর্ম। তাই ইসলামে নেই টানা উপোস থেকে দৈহিক শাস্তির বিধান বা রোযা রেখেও ফলাহারে অমোদে থাকার কোনো সুযোগ।

রোযার দিনগুলিতে ইয়াহুদিরা কেবল ইফতারের সময়ই কিছু খেতে পারতো আর আরবদের তো সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছিল খাবারের অনুমতি। কিন্তু ইসলাম এসব শর্তকে রহিত করে দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে,- ‘রোযার দিনে তোমরা খেতে পারবে সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত’। তাছাড়া রোযা অবস্থায় কেউ যদি ভুল করে খেয়েও ফেলে তাতেও রোযা নষ্ট হয়ে যাবে না। বমি করলে বা নাকে রক্ত পড়লেও রোযা নষ্ট হবে না।

অনেক ধর্মে রোযাকে ধার্য করা হয়েছিল সৌরবর্ষের হিসেব অনুযায়ী। যা বড় বিভ্রাটের ব্যাপার ছিল। কেননা একে তো সৌরবর্ষের হিসেব মিলাতে জ্যৈতির্বিদ্যার প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত সৌরবর্ষের হিসেব অনুযায়ী রোযা হত প্রতিবছরই ঠাণ্ডা বা গরম- নির্দিষ্ট সময়ে।

কিন্তু ইসলাম রোযাকে ধার্য করেছে চান্দ্রমাসের সাথে। মাসের শুরুতে চাঁদ দেখলে রোযা শুরু হবে আবার চাঁদ দেখলেই রোযা শেষ হবে। যা খুবই সহজ হিসেব। তাছাড়া রোযাকে চান্দ্রমাসের সাথে সংশ্লিষ্ট করার কারণে কখনো রোযা হয় গরম মওসুমে, কখনো শীতে। যা মানসিক স্বস্তির কারণ।

মোটকথা, রোযার মতো আপাত কঠিন একটি বিধান আরোপেও ইসলামে যে আদাব এবং মাকসাদের ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা হয়েছে  তা বিবেচনার পর যে কোনো রোযাদার কুরআনের এই আয়াত পাঠ করবে- وقالوا الحمد لله الذي هدانا لهٰذا ،وما كنا لنهتدي لولا ان هدانا اللهঅর্থাৎ  –আল্লাহর অগণিত শোকর যে তিনি আমাদেরকে এই সত্য দ্বীনের পথ দেখিয়েছেন। আমাদের তো কিছুই করার ছিল না তিনি যদি পথ না দেখাতেন।

 

 

পূর্ববর্তি সংবাদগরিবদের সাহায্য না করে সরকার ত্রাণ দিয়ে দলীয় লোকদের পেট ভরাচ্ছে: রিজভী
পরবর্তি সংবাদসার্সের তুলনায় করোনা আক্রান্তরা সেরে ওঠার পর ‘বেশি ভালো থাকছেন’