ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ঈমানি চেতনার অপূর্ব পাঠশালা

 উবায়দুল্লাহ তাসনিম ।।

১৭ ই রমযান ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের দিন। দ্বিতীয় হিজরী সনে এ যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক এ বদর দিবসে একজন ইতিহাস পাঠকের চোখে নিশ্চয় ভেসে বেড়ায়, সাহাবায়ে কেরামের সেদিনের ঈমানদীপ্ত উপাখ্যান ও মহান বিজয়ের কথা। ঈমানি চেতনায় উদ্দীপ্ত অল্প বয়সের দুই ভাই বাজপাখির মতো ছুটে এসে কাফের সর্দার আবু জেহেলকে হত্যা, ৭০জন কাফেরকে তরবারি দিয়ে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায়, বদরের কূপে তাদের মরা লাশ নিক্ষেপ, মুসলমানদের চূড়ান্ত বিজয়, প্রচুর গণীমত অর্জন, এসবই এদিনে একজন ইতিহাস পাঠকের চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

ইতিহাসের এই অবাক করা বিজয়ের নেপথ্যে বাহ্যিক কোন কার্যকারণের প্রভাব ছিল না। সাহাবায়ে কেরামের উল্লেখযোগ্য সামরিক অস্ত্র, সৈন্য কিছুই ছিল না।মাত্র ৩১৩ জন প্রায় নিরস্ত্র সাহাবায়ে কেরাম ( যাদের কাছে মাত্র ২ টি ঘোড়া,৭০ টি উট, দূর্বল কয়েকটা তরবারি জাতীয় সামান্য কিছু সম্বল ছিল) এক হাজর সশস্ত্র, সুশৃঙ্খলিত বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় এনেছিলেন, তা আজো ইতিহাসের এক বিস্ময়। কিভাবে সম্ভব হলো এই অভূতপূর্ব বিজয়, বাহ্যিক বাস্তবতায় যেখানে পরাজয় নিশ্চিত ছিল? কোন সন্দেহ নেই; সাহাবায়ে কেরামের তুলনাহীন ঈমানি শক্তি সেখানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। যার ফলে তারা গায়েবী সাহায্য পেয়েছিলেন। যা অসম্ভ বিষয়কে সম্ভব করে তুলছিল।

বদর যুদ্ধ ছিল সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী একটা যুগান্তকারী ঘটনা। কুরআনে বদরের দিনকে ‘ইয়াওমূল ফুরকান’ (সত্য মিথ্যার ফায়সালার দিন) বলে অভিহিত করা হয়েছে। ‘যদি তোমাদের বিশ্বাস থাকে আল্লাহর উপর এবং সে বিষয়ের উপর, যা আমি আমার বান্দার উপর নাযিল করেছিলাম ‘ইয়াওমুল ফুরকানে (ফয়সালার দিনে) যেদিন দু’দল পরস্পর সম্মুখীন হয়েছিল।’ (আনফাল,৪১) আল্লামা নদভীর ভাষায়, ‘ইসলামি ইতিহাসে যতগুলো বিজয় হয়েছে সবগুলো বদরের অপূর্ব বিজয়ের কাছে ঋণী।'(নবীয়ে রহমত)

ঈমানদীপ্ত চেতনার দৃষ্টান্ত: আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে ফেরার পথে রাসূল সা কর্তৃক কাফেলা ঠেকানোর পরিকল্পনা, এর প্রেক্ষিতে আবু সুফিয়ানের মক্কায় সাহায্য তলব, এরপর আবু জেহেল যখন সদলবলে বদর অভিমুখে রওয়ানা করে, তখন রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শে বসলেন। পরামর্শ চাইলে মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম তাকে সহযোগিতার চূড়ান্ত আশ্বাস দেন।

আনসারদের থেকে তখনো কোন কথা আসেনি (অবশ্য তারা এক্ষেত্রে বাধ্যও ছিলেন না, যেহেতু তাদের সহযোগিতার কথা ছিল মদিনার ভিতরে, আর বদর ইস্যু ছিল মদিনার বাইরের )। কিন্তু রাসূল সা.- এর মনের বিশেষ অনুরাগ ছিল আনসারদের প্রতি। তা বুঝতে পেরে আনসারী সাহাবী সা’আদ ইবনে মুয়াজ এক চেতনা জাগানিয়া বক্তৃতা করলেন, ‘…ইয়া রাসূলাল্লাহ!… আল্লাহর কসম করে বলছি, আপনি যদি সমুদ্রেও প্রবেশ করেন, সে ক্ষেত্রে আমরা আপনার সঙ্গে সমুদ্রেই ঝাঁপিয়ে পড়বো৷ (যাদুল মাআদ, ১ম খন্ড, ৩৭২ পৃ.)

মিকদাদ রা. তখন এক অনলস্পর্শী ভাষণ দিলেন, ‘আমরা আপনাকে এমন কোন কথা বলবো না, যেমন বলেছিল, মূসা আ. এর কওম। ”যাও তুমি তোমার রব উভয় মিলে যুদ্ধ করো, আমরা এখানেই বসে রইলাম।”(সূরা মায়িদা, ২৪) আমরা আপনার ডানে লড়বো, বামে লড়বো, সামনে লড়বো পিছনে লড়বো। ‘(যাদুল মাআদ খ,১, ৩৪২-৪৩, সীরাতে ইবনে হিশাম,খ১, পৃ ৬১৪, বুখারী, মুসলিম)

মুজাহিদ বাহিনী রওয়ানা করেছে। উমাইর ইবনে আবি ওয়াক্কাস। ছোট্ট সাহাবী। বয়স ষোল। তিনিও মুজাহিদ বাহিনীর সঙ্গ নিয়েছেন। কিন্তু রাসূল সা. তাকে দেখে ফেললে নিবেন না এই ভয়ে তিনি লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তার এই কান্ড দেখে ভাই সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. জিজ্ঞাসা করলে তিনি তার ভয়ের কথা ব্যক্ত করেন৷  পরে, রাসূল সা. তাকে দেখার পর ফেরত পাঠাতে চাইলে তিনি কেঁদে ফেললেন। শেষে নবীজি সা. তাকে অনুমতি দিলেন। তিনি এই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। (উসদুল গাবাহ ফি মারিফাতিস সাহাবা, খ,৪, পৃষ্ঠা,১৪৮)

যুদ্ধের ময়দান সরগরম। প্রচন্ড গতিতে যুদ্ধ চলছে। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা. বলেন, আমি আমার বাহিনীর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় হঠাৎ দু’জন বালকের উপর আমার চোখ পড়ল। অল্প বয়সের দু’জন  আমার ডানে বাঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে আমি খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারলাম না৷ আমি ভাবনায় ছিলাম৷ এমন সময় তাদের একজন আরেকজন চুপিসারে আমার কানে কানে বলল, চাচাজান! আপনি আবু জেহেলকে একটু দেখিয়ে দিন।আমি বললাম, তাকে দিয়ে তোমার দরকার কিসের? বলল, আমার প্রতিজ্ঞা, আমি যেখানেই তাকে পাবো, তাকে খতম করে ছাড়ব, না হয় আমি আমার জীবনটাই বিলিয়ে দেব। অপরজনও প্রায় একই কথা বলল। হঠাৎ আবুল জেহেলকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ইশারা করতেই বাজ পাখির মতো দু’জন ছুটে গেলো। ঝাঁপিয়ে পরে মহূর্তেই তাকে শেষ করে দিলো। (বুখারি, মুসলিম, মতন [পাঠ ]বুখারি, কিতাবুল মাগাযি

ঈমানের তাজা ফলাফল:বাহ্যিক দৃষ্টিতে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের কোন কারণই ছিল না৷ তারা ছিলেন, একদম অসহায়ের মতো। কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতিতে ঈমানি শক্তির বলে আল্লাহর গায়েবি সাহায্য পেয়েছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। এটা ছিলো মুসলমানদের জন্য বিশাল নিয়ামত। সে কথাটাই কুরআন এভাবে ব্যক্ত করেছে,’আর আল্লাহ তোমাদের বদর যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন। সেসময় তোমরা ছিলে অসহায়। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সূরা আল- ইমরান১২৩)

বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের ভাগে যে স্থান পড়েছিল, সেটা ছিল বালুকাময়। যা চলাফেরার জন্য তেমন সুবিধাজনক নয়। তাছাড়া পানিরও ভালো কোন ব্যবস্থা ছিল না সেখানটায়। সবমিলিয়ে একটা প্রায় অনুপোযোগী পরিবেশ। অন্যদিকে কাফেরদের ভাগে যা পড়েছিল, সেখানে মাটির প্রাচুর্য ছিল। যাতে চলাফেরা করতে আরাম বেশি। আবার পানির ব্যবস্থাও ছিলো ভালো। এরপর সাহায্য স্বরূপ আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন বৃষ্টি হলো, তখন পরিস্থিতি পাল্টে গেলো। মুসলমানদের আবাসস্থল এখন তাদের চেয়ে বেশি সুবিধাজনক। বৃষ্টির ফলে বালু বসে গেল, চলাফেরায় তাই আর কোন অসুবিধা রইল না৷ তারা পানির পাত্রগুলো ভরে নিলেন। পানি জমা করে রাখলেন। অন্যদিকে কাফের বাহিনীর স্থান হয়ে পড়ল পিচ্ছিল। তারা পড়ল বিরাট সমস্যায়। কুরআন সেই সাহায্য বৃষ্টির চিত্রটা এভাবে এঁকেছে, ‘আর তিনি তোমাদের উপর আকাশ থেকে পানি নাযিল করেন, যাতে তোমাদের পবিত্র করে দেন এবং যাতে তোমাদের থেকে অপসারিত করে দেন, শয়তানের অপবিত্রতা,আর যাতে রক্ষিত করে দিতে পারেন তোমাদের পা গুলো। ‘(সূরা আনফাল, ১১)

রণাঙ্গনে যখন দুইপক্ষের যুদ্ধ বাঁধল, তখন আল্লাহ তায়ালা অদৃশ্য ফেরেশতার মাধ্যমে মুসলমানদের সাহায্য করছিলেন। ফেরেশতারা কাফেরদের কচুকাটা করছিলেন। সাহল ইবনে হুনাইফ বলেন, আমাদের কেউ যখনি কোন মুশরিককে হত্যার জন্য ধাওয়া করতো, তখন সে তরবারির নাগালে আসার পূর্বেই তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো৷ কুরআনুল কারিম ফেরেশতাদের এই গায়েবি সাহায্যের কথাই এভাবে তুলে ধরেছে, ‘আর স্মরণ করো যখন তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদেরকে, আমি সাথে আছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের অবিচলিত রাখো। আমি কাফেরদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দিবো। সুতরাং তাদের গর্দানের উপর আঘাত করো এবং আঘাত করো তাদের সর্বাঙ্গে।'(সূরা আনফাল,১২)

পূর্ববর্তি সংবাদরাজধানীতে চলছে বাস ছাড়া সব ধরণের যানবাহন
পরবর্তি সংবাদভার্চুয়াল আদালতে বিচার শুরু, কাল বসছে আটটি কোর্ট