ওলিউর রহমান ।।
জর্জ ফ্লয়েট নামে এক মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যার প্রতিবাদে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে ফুঁসছে যুক্তরাষ্ট্র। দিন যাওয়ার সাথে সাথে বেড়েছে প্রতিবাদের তীব্রতা। যুক্তরাষ্ট্রের শহরে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন। মার্কিন সীমানা পেরিয়ে ইউরোপেও পৌঁছে গেছে প্রতিবাদ। গোটা ইউরোপ এখন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল।
সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বর্ণবাদবিরোধী এ আন্দোলন নানারূপ পরিগ্রহ করে শ্রেণি আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে দাস ব্যবসায়ী কলম্বাসের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে উপনিবেশিক শাসক ক্লাইভ, চার্চিলসহ অন্যদের মূর্তি আছে হুমকির মুখে। তাদের মূর্তি রক্ষার্থে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তাকর্মী।
মার্কিন মুলুক এবং ইউরোপে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন আজ নতুন নয়। হোয়াইট সুপ্রিমেসি চরম বিভাজন তৈরি করে রেখেছে তাদের সমাজে। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে বা নিছক ‘সাদা’ না হওয়ার অপরাধে এ যাবৎকালে অগণিত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
অথচ ইসলাম বর্ণবাদ সমস্যাকে গোড়া থেকেই নির্মূল করে দিয়েছে। হাবশা গোলাম বেলাল রাযি. ছিলেন রাসূলের মুআযযিন। খলিফা উমর রাযি. তাকে ‘আমাদের সরদার’ বলে সম্বোধন করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এক হাদিসে এরশাদ করেছেন, (মর্মার্থ) যদি হাবশার কোনো কালো গোলামও খলিফা হয় তাহলে সমগ্র মুসলিম কমিউনিটির তার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে।
চলমান বৈশ্বিক বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন বিষয়ে ইসলামিক স্কলার এবং চট্টগ্রামের ওমর গণি কলেজের সাবেক অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, আমেরিকা, ইউরোপ-যারা অপরাপর বিশ্বকে মানবাধিকারের সবক দেয়- তাদের সমাজে এই আধুনিক সময়ে এসেও বর্ণবাদের উপস্থিতি মানবতার জন্য চরম অভিশম্পাত। বর্ণবাদ ইউরোপ, আমেরিকার বৈষয়িক উন্নতির পেছনের এক অন্ধকার অধ্যায়। হোয়াইট সুপ্রিমেসি ইউরোপ, আমেরিকার সমাজে যে উগ্রতা ধারণ করে আছে তা বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যই হুমকি স্বরূপ। আমেরিকায় শুধু জর্জ ফ্লয়েড নয় বর্ণবাদের শিকার হয়ে এ যাবতকালে অগণিত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অথচ আমেরিকার ইতিহাসে এই শেতাঙ্গরা বহিরাগত। আমেরিকার আদিবাসী কৃষ্ণাঙ্গদের অব্যাহত শোষণ করেই আজকের মার্কিন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই এই আধুনিক সময়ে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্বেই জোরদার আওয়াজ উঠা প্রয়োজন।
বর্ণবাদ এবং শ্রেণিঘৃণাকে জাহিলিয়্যাহ বলে মন্তব্য করলেন রাজধানীর মারকাযুদ্দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার শিক্ষক মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, যুগে যুগেই এই বর্ণবাদ ছিল। একেক যুগে একেক রূপে ছিল। সবই জাহিলিয়্যাহর অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এই জাহিলিয়্যাহর অপনোদনে বিদায় হজ্বের ভাষণে বিশেষ জোর দিয়েছেন।
ইসলাম বর্ণবাদকে কীভাবে দেখে? এমন প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, এই বর্ণবাদ বা শ্রেণিঘৃণা-চাই তা ভাষা বা ভূখণ্ড ভিত্তিক হোক অথবা অন্য কিছুর ভিত্তিতে-সমাজে ইনসাফ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। সাধরণভাবে ইনসাফ পরিপন্থী হিসেবে বর্ণবাদকে দেখা হয়। অমুসলিমরাও সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যই বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন করে। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ণবাদকে দেখার আরেকটি ক্ষেত্র আছে। ولقد كرمنا بني آدم- তথা সকল মানুষের সম্মানের ব্যাপারে কুরআনের যে ঘোষণা বর্ণবাদ সেই ফিতরাত পরিপন্থী ঘৃণিত জিনিস।
এ বিষয়ে ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ইসলাম সকল মানুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলামে সকল মানুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম সকল শ্রেণি বিভাজনকে অপনোদন করেছেন। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ইসলামে অনারবের উপর একজন আরবের বাড়তি কোনো মর্যাদা নাই। সাদার উপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নাই। এখানে ধনী, নির্ধন সবাই সমান। আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাটি একমাত্র তাকওয়া।
বর্ণবাদ বিষয়ে সমাজে ইসলামের শিক্ষার সুফল প্রসঙ্গে মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ বলেন, ইসলাম সমাজে এমন পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছে যে, বেলাল রাযি. কে রাসূলের মুআযযিন হিসেবে সবাই মেনে নিয়েছেন। অথচ জাহিলি সমাজে বংশীয় কৌলিন্যকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করা হতো। আরবের সে যুগে দাসদেরকে মানুষের পর্যায়ে ভবা হতো না। সে যুগে ইসলামের শিক্ষা পেয়ে আরবের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ গোত্রের অভিজাত পুরুষ এবং ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রাযি. সে বেলাল রাযি. কে সরদার বলে অভিহিত করতেন।
এর সাথে যুক্ত করে এ বিষয়ে অধ্যাপক মাওলানা খালিদ হোসেন বলেন, ইসলাম শুধু সব মানুষের সমান মর্যাদার বিষয়টি মৌখিখ স্বীকৃতি পর্যন্তই ক্ষান্ত রাখেনি। বরং ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, ইসলাম কখনোই শ্রেণি বিভাজন করেনি। কালো-সাদা, গোলাম-মনিবের পার্থক্য করেনি।
“বরং হাদিস এবং জীবনীর কিতাবগুলোতে যেভাবে কোনো সমাজে সম্ভ্রান্ত, অভিজাত ব্যক্তির রেওয়ায়েত বর্ণনা বা জীবনী আলোচনা করা হয়েছে একই রকম মর্যাদায় সমাজে অনুল্লেখযোগ্য গৌড় বা কালো বর্ণের সাহাবি, তাবেয়িদের জীবনীও আলোচনা করা হয়েছে।
ড. মাওলানা খালিদ হোসেন আরও বলেন, আমরা যদি বিভিন্ন ভূ খণ্ডে মুসলিম শাসকদের ক্রম তালিকা গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করি তাহলে দেখতে পাব সে তালিকার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আযাদকৃ ক্রিতদাস ছিলেন।
“সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্ণবাদ এবং শ্রেণি বিভাজন বিষয়ে চৌদ্দশত বছর আগেই ইসলাম যে ধারণা পেশ করে গেছে তা সর্বাধুনিক।
![](https://www.islamtime24.com/wp-content/uploads/2021/03/20210308_200803-scaled.jpg)