ভয়াল দুর্যোগেও ছেদ পড়েনি নোংরা মানসিকতায়!

জহির উদ্দিন বাবর।।

চরম দুর্যোগকাল অতিক্রম করছে গোটা বিশ্ব। এর আগে একসঙ্গে সারা পৃথিবী দুর্যোগে পড়ার নজির বোধহয় নেই। বিভিন্ন সময় মহামারি এসেছে, সেটা কোনো একটি অঞ্চল বা বেশ কিছু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবারের করোনা দুর্যোগে বিপর্যস্ত প্রায় পুরো পৃথিবী। এর সর্বগ্রাসী সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কেউ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও এর ব্যতিক্রম নয়। গত তিন মাস ধরে প্রতিটি দিন আবির্ভূত হচ্ছে নতুন শঙ্কা নিয়ে। আমরা যেন এমন এক সুরঙ্গের মধ্যে ঢুকে গেছি যেখান থেকে আলোর কোনো ঝলকানি আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এই সংকট থেকে কবে নাগাদ উত্তরণ ঘটবে সেটা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না। এই অবস্থায়ও জাতি হিসেবে আমরা যে নোংরা মানসিকতায় অভ্যস্ত সেটা থেকে বের হতে পারছি না। বরং উল্টো আমাদের মধ্যে নতুন নতুন নোংরামি জায়গা করে নিচ্ছে।

মানুষকে ঠকানো, প্রতারণা-ধোঁকাবাজি, অন্যকে ঘায়েল করে নিজে বড় হওয়া, অন্যের সুখ কেড়ে নিয়ে নিজে সুখী হওয়া, নিজে একটু ভালো থাকতে অপরের জন্য মৃত্যুকূপ কুড়তেও আমরা পিছপা হই না। জাতি হিসেবে এসব প্রবণতা আমাদের চিরায়ত অভ্যাস। মহান রাব্বুল আলামিনের ভয়ংকর আজাব হিসেবে আবির্ভূত হওয়া করোনাভাইরাসের কারণে আমরা কিছুটা পরিশুদ্ধ হবো-এমনটাই ছিল কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু না, আল্লাহর আজাব-গজব থোড়াই কেয়ার করছি আমরা। আমাদের জাতিগত বদঅভ্যাসগুলো আরও বেশি করে জেঁকে বসেছে আমাদের ভেতরে। এর মধ্য দিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের দুর্যোগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছি।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, হ্যান্ড সেনিটাইজার, ফেস-শিল্ড, সার্জিক্যাল ক্যাপ, পিপিই, জীবণুনাশক বিভিন্ন তরল পদার্থ এসবের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। আর এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে কিছু অসাধু মানুষ। তাদের প্রস্তুতকৃত মানহীন, ক্ষতিকর, নকল সামগ্রীতে এখন বাজার সয়লাব। যে যেভাবে পারছে মানুষকে ঠকাচ্ছে। অনৈতিক মুনাফা লাভ করছে। তাদের এই সর্বনাশী অসততার কারণে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিয়েছে। তাদের এই হীন মানসিকতা করোনার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলছে।

সম্প্রতি ইসলাম টাইমসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রাজধানীর মিডফোর্ড এলাকায় ইথানল-মিথানল অ্যালকোহলের সঙ্গে কাপড়ের রঙ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে মানহীন স্যানিটাইজার। মিডফোর্ডের বিভিন্ন দোকানে এসব তৈরি হলেও নেই ল্যাব বা কেমিস্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে করোনাভাইরাস সুরক্ষা তো মিলবেই না, উল্টো ঝুঁকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। খবরে বলা হয়, চাহিদা থাকায় মিডফোর্ডের অনেক ক্যামিক্যাল ব্যবসায়ীই রাতারাতি বনে গেছেন স্যানিটাইজার প্রস্তুতকারক। কারোরই নেই ল্যাব বা কেমিস্ট। এমনকি আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল, হাইড্রোজেন পারক্সাইড ও গ্লিসারলের মিশ্রণের নেই কোনো মাপজোক। বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা লিটার। তোপখানা রোডে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রেখে বিক্রি হচ্ছে স্যানিটাইজার, নকল স্যাভলন। মিডফোর্ডের স্যানিটাইজার তৈরির অ্যালকোহলে ভেজাল পেয়েছে বুয়েটের কেমিক্যাল বিভাগ। তারা বলছেন, এসব স্যানিটাইজারে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার ক্ষমতা নেই। বাণিজ্যিকভাবে স্যানিটাইজার বিক্রির জন্য অনুমতি নিতে হয় ওষুধ প্রশাসনের। বোতলের গায়ে লেখা থাকতে হয় উপরণের মাত্রা। কিন্তু কেউ তোয়াক্কা করছে না এসব নীতিমালার।

হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ করোনা থেকে সুরক্ষা সামগ্রীর চাহিদা এখন তুঙ্গে। এসব পণ্য আগে যে পরিমাণ বিক্রি হতো এখন এর চাহিদা বেড়ে গেছে বহু গুণ। এ কারণে যারা এই খাতের ব্যবসায়ী নন তারাও রাতারাতি ব্যবসায়ী বনে গেছেন। চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেওয়ার জন্য সরবরাহকারী বাড়া খারাপ কিছু নয়। কিন্তু কোনোভাবেই এটা মানহীন কিংবা জালিয়াতির আশ্রয়ে হওয়া উচিত নয়। কারণ এখানে শুধু মুনাফার বিষয় নয়, মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। মানহীন, ভেজাল ও ক্ষতিকর এসব হ্যান্ড সেনিটাইজার এবং জীবাণুনাশকের কারণে হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। করোনার থাবা থেকে রক্ষা পেতে এসব ব্যবহার করতে গিয়ে অনেকে নিজের অজান্তে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।

আত্মঘাতী এই লোভ যাদের পেয়ে বসেছে তারা এই সমাজেরই অংশ। এই করোনা দুর্যোগে গোটা দেশবাসীর সঙ্গে তারাও চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন। সমাজের উঁচু লেভেল থেকে নিয়ে নীচু স্তর পর্যন্ত কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না করোনা। এই অবস্থায় যেখানে মানুষের সংকট লাঘবের চেষ্টা করার কথা সেখানে নতুন সংকট সৃষ্টি করছেন যারা, তাদের মনুষ্যত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আপনি হয়ত একজন ব্যবসায়ী, মানুষের সংকটকে পুঁজি করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছেন, আজ চলে গেলে আগামীকাল দুইদিন! কাফনের তো পকেট থাকবে না, করোনাকালের মুনাফা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন তো!

আরো পড়ুন: করোনাকালে বেহাল স্বাস্থ্যখাত ও বড়লোকের হাহাকার!

ব্যবসা তো এমনিতেই করছেন, স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন। সেখানে আরেকটু লাভের জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য চরম হুমকিতে ফেলছেন। আপনার বিবেক-বিবেচনাবোধ থাকলে এটা কখনও করতেন না। করোনাকালে যখন অধিকাংশ খাতের ব্যবসা একদম নেই বললেই চলে, সেখানে আপনারা রমরমা ব্যবসা করতে পারছেন, সেটা তো অনেক বড় প্রাপ্তি। এর জন্য আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করা উচিত। কিন্তু সেটা না করে অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছেন। মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতে আপনি কতটা উত্তীর্ণ নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করুন, উত্তর পেয়ে যাবেন।

দুই.

এটা তো গেল ব্যবসায়িক অসততা ও জালিয়াতির কথা, করোনাকালে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির নিত্যনতুন ঘটনাও কম ঘটেনি। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা মাস্কসহ যে সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করেন এর বেশির ভাগই ওয়ান টাইম। কিন্তু দেখা গেছে, ব্যবহৃত সেই সুরক্ষাসামগ্রীগুলো ধুয়ে-ইস্ত্রি করে বাজারজাত করছে অসাধু চক্র। র‌্যাবের কয়েকটি অভিযানে এ ধরনের প্রচুর সামগ্রী উদ্ধার হয়েছে। মহল্লার ফার্মেসি কিংবা ফুটপাত থেকে এক টাকারও কম মূল্যের (পূ্র্বের পাইকারি মূল্য) সার্জিকেল মাস্কটি আপনাকে কিনতে হচ্ছে কমপক্ষে ১০ টাকা দিয়ে। কিন্তু সেই মাস্কটি যে ওই অসাধু চক্রের প্রক্রিয়াজাত করা নয় এর কোনো গ্যারান্টি নেই। হ্যান্ড সেনিটাইজার ও জীবাণুনাশক তরল পদার্থ এখন হাতের নাগালেই মিলছে। কিন্তু এটা কতটা মানসম্পন্ন কিংবা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কিছু এর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না।

নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রীতে শুধু সাধারণ মানুষই যে ঝুঁকিতে তা নয়, করোনাকালে সামনে থেকে যারা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেন সেই চিকিৎসকেরাও ঝুঁকিতে। গতকাল সোমবার (১৫ জুন) দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি জানিয়েছে, করোনা দুর্যোগে ৫৯ শতাংশ হাসপাতালেই সরবরাহ করা হয়েছে সবচেয়ে নিম্নমানের সুরক্ষাসমাগ্রী। আর এসবের ১০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে লাভবান হয়েছে একটি চক্র।

‘করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ এই শিরোনামে গবেষণা চালায় টিআইবি। সেখানে দেশের ৪৭টি জেলা পর্যায়ের হাসপাতালের আর ৪৩টি জেলার নাগরিকদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গবেষণার ফলাফলে উঠে আসে ৫৯ শতাংশ হাসপাতালে সবচেয়ে নিম্নমানের সুরক্ষা সমাগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। ২৩ শতাংশ হাসপাতালে দায়িত্বে অবহেলা করেছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী পাঁচ থেকে ১০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে লাভবান হয়েছে একটি চক্র। ৫.১ শতাংশ সুরক্ষা সামগ্রী বণ্টন করা হয়েছে পছন্দের সহকর্মী ও কর্মকর্তাদের। এভাবে ব্যক্তি পর্যায় থেকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি আর অসততার মহড়া চলছে।

আরো পড়ুন: বাজারে নকল স্যানিটাইজার: ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

জাতিগতভাবেই আমাদের মধ্যে রয়েছে নানা বদঅভ্যাস। এসব সঙ্গী করেই আমরা টিকে আছি। কিন্তু করোনার মতো ভয়ংকর খোদায়ি ধাক্কাও আমাদের সেই চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আনতে পারলো না-এটাই হলো আফসোসের। করোনাভাইরাসের পজেটিভ-নেগেটিভ ‘সার্টিফিকেট’ কেনাবেচা হচ্ছে এমন খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। পৃথিবীর দুই শতাধিক রাষ্ট্রে করোনার সংক্রমণ ঘটেছে। আর কোথাও এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, আমাদের এই দুশ্চরিত্রের প্রকাশ ঘটছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় করোনার জাল সার্টিফিকেট বিক্রির দায়ে পাঁচ বাংলাদেশি গ্রেফতার হয়েছে। জাতি হিসেবে এরচেয়ে আমাদের লজ্জার আর কী হতে পারে!

কুরআনে কারিমের ভাষ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে জলে-স্থলে যেকোনো বিপর্যয়ের জন্য মানুষের কৃতকর্ম দায়ী। করোনা মহামারি গোটা বিশ্বকে গ্রাস করেছে, অবশ্যই এটা মানুষের কৃতকর্মের ফসল। কে বেশি পাপী আর কে কম সেটা বলার সময় এখন নয়, আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেকে নিজে পরিশুদ্ধ করা। করোনার মতো গজবের জন্য আমি নিজেও দায়ী-এই বোধ সবার ভেতরে জাগানো। বৈশ্বিক এই দুর্যোগে নিজের ভেতরে অপরাধবোধ কাজ করলে কারও পক্ষে ভয়ংকর প্রতারণা আর আত্মঘাতী জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া কখনও সম্ভব নয়। হে আল্লাহ! এই জাতির মধ্যে বোধোদয় সৃষ্টি করে দিন, করোনাকালে এটাই তোমার দরবারে আমাদের মিনতি।

লেখক: আলেম সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তি সংবাদদুবাইয়ে আটকে পড়া ১৫৮ বাংলাদেশি দেশে ফিরলেন
পরবর্তি সংবাদচিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ