তা’লীমের  উদ্দেশ্য তাবলীগ, তাবলীগের উদ্দেশ্য তা’লীম

ইসহাক ওবায়দি।।

খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ রহ. একবার ফেনী শর্শদী মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে তাশরীফ এনেছিলেন। এক অবুঝ তাবলীগী ভাই হযরতকে বললেন, ‘হুজুর! অনেক কিছুই তো করলেন, এবার দ্বীনের কিছু কাজ করুন না।’ খতীবে আযম রহ. বললেন, ‘চলুন!  গাঁটরি-বুঁচকা মাথায় নিয়ে আমি তাবলীগে চললাম, তবে আমার কাজগুলো আপনাকে করতে হবে।’ লোকটি বলল, ‘তা কি করে সম্ভব?’ হযরত বললেন, ‘আমি তো আপনার কাজটি করতে সক্ষম, তবে কেন আপনি আমার কাজগুলো করতে পারবেন না?

 

তালীম জরুরি, নাকি তাবলীগ জরুরি- এ বিতর্ক অনেক পুরানো। এ বিষয়ে ‘মাজালিসে হাকীমুল ইসলাম’ গ্রন্থে হাকীমুল ইসলাম হযরত ক্বারী তৈয়্যেব রহ.-এর মনোমুগ্ধকর সুদীর্ঘ এক আলোচনা কয়েক পাতাব্যাপী বর্ণনা করা হয়েছে। তাতে হযরত রহ.-এর ভাষণের যে নির্যাস বেরিয়ে এসেছে তা হচ্ছে, তা’লীমের মাকসাদ বা উদ্দেশ্য হচ্ছে তাবলীগ, আর তাবলীগের উদ্দেশ্য হচ্ছে তা’লীম। যে তা’লীমের পরে দ্বীন-প্রচার থাকবে না তা সত্যিকারের তা’লীম নয়। আবার যে তাবলীগের পরে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণের প্রেরণা আসবে না তাও সত্যিকারের তাবলীগ হবে না। অর্থাৎ তা’লীম-তাবলীগ একে অপরের সম্পূরক বিধায় দু’টি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িত।

 

ওলামা বাজারের হযরত মাওলানা আবদুল হালীম ছাহেব রহ. বলতেন, হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর মালফুযাতে আছে যে, ‘একেকটি জামাতে যখন দুই দুইজন মুহাক্কেক আলেম থাকবেন তখন দাওয়াতের আসল কাজ আরম্ভ হবে।’

 

হযরত আরো বলতেন, মুহাক্কেক আলেম গাছের গোটা নয়, মুহাক্কেক আলেমের অস্তিত্ব একেকটা এলাকায় ফরযে-কেফায়ার বিধান রাখে। অথচ দ্বীনের যেকোনো সমস্যার শরয়ী সমাধান দিতে পারা আলেমকেই মুহাক্কেক আলেম বলা হয়। আর এই মুহাক্কেক আলেমের অভাবে এই ফরযটি আঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে মাদরাসাগুলোর অস্তিত্বের মাধ্যমে। এমতাবস্থায় একেকটি জামাতে দুই দুইজন মুহাক্কেক আলেমের বিষয়টি কত দুরূহ ব্যাপার, তা সহজেই বোঝা যায়।

 

হযরত আরো বলতেন, একটি জামাতে কেবল একজন নয়, দু’জন আলেম থাকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি অনেক দিন পর্যন্ত চিন্তা করেছি, শেষমেশ আল্লাহর ফযলে বুঝে এসেছে যে, বিমানে একজন পাইলট থাকে না, একাধিক পাইলট থাকে। যদিও বিমান চালনা করে একজনই। অন্য কো-পাইলট অবসর বসে থাকে এই জন্য যে, যেকোনো মুহূর্তে যদি চালক পাইলটটির কোনো সমস্যা হয়ে যায় সাথে সাথে যেন কো-পাইলট বিমানকে টেকআপ করতে পারে। এত কোটি টাকার সম্পদ এবং এতগুলো মানব সন্তানের জান-মাল নিরাপত্তাপূর্ণ করার লক্ষ্যেই এ ব্যবস্থা। নবীওয়ালা কাজ এই দাওয়াত ও তাবলীগের অবস্থা তো তার চাইতেও হাজার গুণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই হয়তো দুইজন মুহাক্কেক আলেম থাকার কথা হযরত রহ. বলেছেন।

 

আলেমদের থাকার ব্যবস্থা কীভাবে হতে পারে?

 

এখন কথা হচ্ছে, আলেমদের থাকার ব্যবস্থা কীভাবে হতে পারে? তা’লীমের কাজ তো দ্বীনের মূল ও অস্তিত্ব রক্ষার কাজ। আর এ কাজেই অধিকাংশ আলেম সমাজ ব্যস্ত আছেন। এ বিষয়টি নিয়ে তাবলীগের অন্যতম মুরববী মরহুম হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান ছাহেবের সাথে কাকরাইলে বসে একদিন আলোচনা করছিলাম। আমি বললাম, হুজুর! তা’লীম-তাবলীগ দু’টিই যখন জরুরি, তখন প্রতিটি মাদরাসায় এ নিয়ম করলে কেমন হয় যে, মাদরাসায় যেমন মোহাচ্ছেল বা চাঁদা উসূলকারী বেতন ভাতা দিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে তেমনি একজন করে মোবাল্লেগ রাখা হবে। চার মাস (তিন চিল্লা) করে একেকজন উস্তাদ তাবলীগে সময় নিয়ে চলে যাবেন, তিনি ফিরে আসলে পর আরেকজন তিন চিল্লার জন্য বেরিয়ে পড়বেন। যিনি তাবলীগে যাবেন তাঁর কিতাবগুলো ঐ মোবাল্লেগ নামের মুয়িনুল মোদাররেস বা অতিরিক্ত শিক্ষক দ্বারা চালানো হবে। তাহলে পালাক্রমে মাদরাসার সকল উস্তাদেরই তাবলীগের সাথে জড়িত হওয়ার সুযোগ হয়ে যাবে। এতে করে তাবলীগে-আসা সাধারণ মানুষের যেমন আলেমদের থেকে উপকৃত হবার সুযোগ হবে তেমনি ঐ আলেমগণের তাবলীগী ফরীযাহ আদায় হবার সাথে সাথে ইসলাহী ফায়দাও বিরাট আকারে হয়ে যাবে। সাথে সাথে গণমানুষের সাথে আলেম সমাজের একটা খালেস দ্বীনী সম্পর্ক গড়ে উঠবে।

 

আমার প্রস্তাব শোনার পর হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান ছাহেব বললেন, আমরা তো হুবহু এটাই চাই। তবে তিন চিল্লার পরিবর্তে এক বৎসর কামনা করি। কারণ একজনের কিতাব বছরের মাঝে অন্যজন পড়াতে গেলে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে। তাই বলি যে, এক বছরের জন্যই একেকজন বেরিয়ে যাক, তাহলে কিতাবের সমস্যাটা আর থাকবে না। আরেক বছর অন্যজন বের হবেন। এভাবে একটি মাদরাসার সকল উস্তাদই তাবলীগের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন।

আমার এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার ব্যাপারেও আমি কোনো কোনো মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম। চট্টগ্রাম হীলা বড় মাদরাসার শ্রদ্ধেয় মুহতামিম মরহুম মঞ্জুর ফকির সাহেব অত্যন্ত খুশি মনেই তা বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নেবেন বলে আমাকে জানিয়ে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখন তা কি অবস্থায় আছে আমার জানা নেই।

 

প্রতিটি মাদরাসায় বেতন করা একজন মোবাল্লেগ থাকা জরুরি

 

ইতোমধ্যে আমার এই প্রস্তাবের উপর দলীল পেয়ে গেছি। আমার পড়ার টেবিলে এখন যে কিতাবটি আছে, তা হচ্ছে, হাকীমূল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর বয়ান- সংকলন‘আল ইলমু ওয়াল উলামা’। সময় পেলেই সেখান থেকে পড়তে থাকি। ক’দিন আগে দেখলাম, হযরত থানভী রহ. অত্যন্ত জোরালো ভাষায় কয়েকটি বয়ানে বলেছেন, প্রতিটি মাদরাসায় বেতন করা একজন মোবাল্লেগ থাকা জরুরি। যার কাজই হবে শুধু আমজনগণকে দ্বীনের দিকে আহবান করা ও তাদের দ্বীন শেখানো। এই ওয়াজ বা তাবলীগের জন্য কোনো রকম বিনিময় তো দূরের কথা, হাদিয়া-তোহ্ফাও নেওয়া উচিত হবে না। এমনকি মাদরাসার জন্য চাঁদা বা টাকাও উসুল করা ঠিক হবে না। কেউ যদি স্বেচ্ছায় মাদরাসায় চাঁদা দিতে চায়, তাকে মাদরাসার ঠিকানায় সরাসরি মাদরাসায় পাঠানোর কথা ঐ মোবাল্লেগ সাহেব বলে দেবেন। এতে মাদরাসার চাঁদা আরো বেড়ে যাবে এবং বিনিময় ছাড়া তাবলীগ করার কারণে জনগণের উপর তার প্রভাব পড়বে অনেক বেশি। মাদরাসা-কর্তৃপক্ষকে মনে করতে হবে এই মোবাল্লেগ সাহেবও মাদরাসারই একজন উস্তাদ। অন্যরা যদি খাছ ছাত্রদের উস্তাদ হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি আমজনতার উস্তাদ। এটাও মাদরাসার উদ্দেশ্যের মধ্যে শামিল।

 

হযরত রহ. আরো বলেন, চাঁদা উসুলকারী মোহাচ্ছেল আলাদাভাবে থাকবে, আর মোবাল্লেগ আলাদা থাকবে। মাদরাসা যদি বড় হয়, যেমন দেওবন্দ মাদরাসা, তাহলে মাদরাসার পক্ষ থেকে প্রতিটি এলাকায় একাধিক মোবাল্লেগ থাকা চাই। হযরত আরো বলেন, এটা একটা এভাব বিস্তারকারী কার্যকরী ফর্মূলা। কারো সন্দেহ থাকলে তা পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন করে দেখতে পারেন। যদি ফলপ্রসু না হয়, তবে বন্ধ করে দেওয়ার এখতেয়ার তো আছেই। (আল ইলমু ওয়াল উলামা পৃ. ১০৬-১০৮)

 

আমাদের আলেমদের মধ্যে যারা শুধু তা’লীমী দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন তাদের পক্ষে যদি তা’লীম-তাবলীগের মধ্যে সমন্বয় সাধন সম্ভব না হয়, তাহলে কমছে’ কম তালীমী দায়িত্বের পাশাপাশি তাবলীগের কাজে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা আমরা অবশ্যই করতে পারি।

 

 

 

 

পূর্ববর্তি সংবাদঅভয়নগরে ট্রাকচাপায় ইজিবাইকের দুই যাত্রী নিহত
পরবর্তি সংবাদব্রাজিলে ১০ লাখ ছাড়াল আক্রান্ত, মৃত্যু ৪৯ হাজার